X
সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪
১৬ আষাঢ় ১৪৩১

সাইবার অপপ্রচারের ক্ষত সারানোর কাজটি সবার

পলাশ আহসান
১৮ জুন ২০২৪, ১৬:২৮আপডেট : ১৮ জুন ২০২৪, ১৭:২৩

২০২৩ সালের শেষের দিকে আমাদের জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে একটা গবেষণা প্রতিবেদন বেশ আলোচিত হয়েছিল। ‘রিউমার স্ক্যানার’ নামের একটা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করেছিল প্রতিবেদনটি। কিছু দিন ধরে রিউমার স্ক্যানার বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপপ্রচার নিয়ে গবেষণা করে পরিচিত হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে সবচেয়ে বেশি ভুয়া সংবাদের শিকার হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভুয়া খবর ছড়ানো হয়েছিল।

রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়ায়। যা মোট ভুল তথ্যের ২৩ শতাংশ। ২৪৮টি রাজনৈতিক গুজবের ৪৩টি ছিল শেখ হাসিনার নামে। যা মোট  ভুল তথ্যের ১৭ শতাংশ।

এছাড়া, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে গুজব ছিল ১২টি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে নিয়ে ১০টি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে ৮টি এবং গণঅধিকার পরিষদ নেতা  নুরুল হক নুরের বিষয়ে ৭টি তথ্য প্রচার হয়।

এবার আরেক রকম তথ্য দেই। সম্প্রতি সংঘবদ্ধভাবে অসত্য প্রচারের অভিযোগে বাংলাদেশের ৫০টি ফেসবুক আইডি ও ৯৮টি পেজ বন্ধ করেছে ফেসবুক। ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটা’র ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, এই অসত্য প্রচারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)-এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাই এই অপপ্রচারের সঙ্গে যারা রয়েছে, তারা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই চিহ্নিত হয়েছে এবং তাদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সমন্বয়ক তন্ময় আহমেদের টুইটার অ্যাকাউন্টও রয়েছে৷

এ নিয়ে তন্ময় আহমেদ গণমাধ্যমে বলেছেন, ওই অ্যাকাউন্ট কে চালান তা তিনি নিশ্চিত নন। এর পরেও মেটা ঢালাওভাবে যে অভিযোগ করেছে, সেটা সত্যি নয়। তার টুইটার অ্যাকাউন্টটি চালু আছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসি জানায়, তাদের কাছে এ নিয়ে কোনও তথ্য নেই। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটও জানায় তাদের কাছেও কোনও তথ্য নেই। অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোনও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে হলে স্পষ্ট অভিযোগ দরকার হয়। সেই অভিযোগ হয় কোনও ব্যক্তিকে করে, না হয় রাষ্ট্র অথবা সংগঠন করে। কিন্তু এরইমধ্যে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন জানিয়েছেন, তারা মেটার কাছে কোনও অভিযোগ করেননি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যে কোনও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে পারবেন না তা নয়। সম্প্রতি বন্ধ হওয়া পেজগুলোর ব্যাপারে মেটা যে বিবৃতি দিয়েছে তাতেও মনে হয়েছে তারা নিজেরাই কাজটি করেছে। ধরে নিচ্ছি, মেটা যে ব্যাখ্যা দিয়েছে সেটা সত্য। তাই শুরুতে এমন উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি। কারণ আমরা এখন জানতে পারলাম যে মেটা নিজেরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু পরক্ষণেই বলছি, তাদের পর্যবেক্ষণ প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ মাত্র তিন মাস আগের আলোচিত গবেষণা প্রতিবেদনটি তাদের চোখেই পড়েনি। অথচ গবেষণা করে সেখানে কারা গুজবের শিকার হচ্ছে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

লেখার এ পর্যন্ত পরস্পরবিরোধী দুটি গল্প বললাম। কারণ আর কিছু নয়। আসলে পরিষ্কার  করে বলতে চাইলাম, আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বর্তমান চলার যে ধরন, তাতে কোনোভাবেই একে নিরপেক্ষ বলার কোনও সুযোগ নেই। এদের কোনও কিছু সুষম নয়। তাদের সত্য তাদের মতো। সেই সত্য ভিউ, লাইক আর শেয়ারনির্ভর। আর যদি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে বলতে চাই তাহলে আরেক ধাপ এগিয়ে বলতে হবে, বাংলাদেশে ইন্টারনেটভিত্তিক যত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আছে, এর সবই প্রগতিবিরোধী। এখানে কুসংস্কার এবং মিথ্যা দ্রুত ছড়ায়। যে বা যারা দ্রুত ছড়ায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গোটা কাঠামো তার দিকে থাকে। মানুষের শুভ হয় এমন বিষয় যে ছড়ায় না, তা বলা যাবে না। কিন্তু এর গতি যদি কচ্ছপের হয় তাহলে খারাপ ছড়ানোর গতি খরগোশের মতো।

২০ বছর ধরে একটু একটু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের সমাজ জীবনে জেঁকে বসেছে। এখন শহর থেকে দূর গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছে ইন্টারনেট। সমাজ জীবনের সার্বিক যোগাযোগে ইতিবাচক বদল এসেছে সন্দেহ নেই। জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়েছে। অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাবও পড়েছে। কিন্তু যোগাযোগের পথ খোলা থাকায় নেতিবাচক পথও খুলেছে বহু। রাষ্ট্র বা সরকার ইন্টারনেটের ইতিবাচক পথে মানুষকে হাঁটতে সহায়তা দিয়েছে। পাশাপাশি কোনও সহায়তা ছাড়াই খারাপ মানুষ তার উদ্দেশ্য পূরণের কৌশল বের করে ফেলেছে সহজেই।

আজ এক ক্লিকেই মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া যায়। কোনও কাজ না করেও মুহূর্তেই আকাশছোঁয়া সুনাম যোগ করা যায় নিজের নামের পাশে। আর সারা জীবন ভালো কাজ করেও অনেকে সাফল্যের তলানিতে থাকেন। ভালো-মন্দের পার্থক্য আজ অনেকটা ভিউ আর লাইকনির্ভর। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতির বিষয়টি হচ্ছে অপপ্রচার। একেবারে দুর্যোগের মতো এক লাইনের অপপ্রচারে মুহূর্তে একজন সৎ মানুষ নেতিবাচক মানুষে পরিণত হতে পারেন। নানা চেষ্টায় তিনি হয়তো তার কথা বলতে পারেন, কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যায়। অপপ্রচারে ধসে যাওয়ার পর আর দাঁড়াতে পারেননি, এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের চারপাশে বহু।

এই অপপ্রচারের কাজটি হয় ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই নেতিবাচক বিষয়টি আমাদের সরকারযন্ত্র বুঝেছে বছর দশেক হলো। আমি বলবো এটি আরও আগে হওয়া উচিত ছিল। যাহোক, অবশেষে এ ব্যাপারে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রযন্ত্র।

সম্প্রতি খোদ প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, নিরাপদ সাইবার স্পেস, সাইবার অপরাধ দমন ও অপপ্রচার ঠেকাতে একটি আলাদা ‘সাইবার পুলিশ ইউনিট’ গঠনের পরিকল্পনা করছে সরকার। এখানে তিনি উল্লেখ করেছেন কীভাবে, কারা, কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার করছে। ২০২৩-এর জানুয়ারি মাসে পুলিশের কাজ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে কিছু দাবি তুলে ধরেছিলেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। সেখানেও প্রথম দাবিটাই ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ইন্টারনেটকেন্দ্রিক যেকোনও অপরাধ দমনে ‘পুলিশ সাইবার ব্যুরো’ গঠন করা।

কাগজপত্রে দেখা যায়, পুলিশ কিন্তু সাইবার অপরাধ দমনে কাজ শুরু করেছে আরও আগে। এছাড়া যেকোনও অপরাধের তদন্তে পুলিশ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে সেই শুরু থেকেই। এরইমধ্যে জেলায় জেলায় পুলিশের মধ্যেই ছোট ছোট ইউনিটও গঠন হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে সাইবার অপরাধ ক্রমশ বাড়ছে। জঙ্গিবাদ, আর্থিক অপরাধ, প্রতারণা, নারীদের সম্মানহানি, সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়িয়ে দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ক্ষেত্রেও সাইবার স্পেস ব্যবহার হচ্ছে। তাই অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেটের ব্যবহারে বর্ধিত সাইবার অপরাধ দমনে একেবারে পুলিশের আলাদা বিভাগ গঠনের বিকল্প দেখছে না খোদ পুলিশ বাহিনীও।

অবস্থাদৃষ্টে আমি নিজেও দেখছি না। কিন্তু পাশাপাশি এও বলতে চাই যে শুধু পুলিশিং করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যাচার প্রতারণা এবং অপপ্রচার ঠেকানো যাবে না। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যত অপরাধ হয় এর বেশিরভাগই ফেক আইডি বা ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। এর জন্যে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ লাগবে। সেখানে পরিষ্কার নিয়ম থাকা দরকার যে বাংলাদেশের কাউকে তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে দিতে হলে তারা পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। এই নিয়ম তৈরিতে আইন দরকার। যেটা পুলিশের কাজ নয়। 

এরপর দরকার সচেতনতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেক আইডি খোলা যে অপরাধ এবং এর জন্যে যে শান্তি হতে পারে সেই বার্তাটি থাকা দরকার একজন নতুন ব্যবহারকারীর কাছে। পাশাপাশি তার জানা দরকার কোন সংবাদ, ছবি, ভিডিও, অডিও প্রকাশ হলে কী ক্ষতি পারে তার রাষ্ট্র, সমাজ এবং ব্যক্তিজীবনে। একই সঙ্গে সবার জানা দরকার কোন বিষয়ে তিনি শেয়ার কিংবা লাইক দিচ্ছেন, তাতে তার বা তার চারপাশের কী উন্নতি। গণমাধ্যম সাক্ষরতা বলে একটা বিষয় এখন সারা বিশ্বে দরকারি হয়ে উঠেছে। সেই বিষয়ে অবশ্য সেসব দেশের গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা সরকারকে সহায়তা করছেন। আমাদের দেশে এখনও ওই অর্থে গণমাধ্যম সাক্ষরতা শুরুই হয়নি। কিন্তু এখনই শুরু করা দরকার। আমরা আসলে সাইবার জীবনের বাইরে যেতে পারবো না। এর ইতিবাচক ফল যেমন সবাই মিলেই ভোগ করছি, নেতিবাচক দিকটি ঠেকাতে হলে সবাই মিলেই প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের কেউ হাতে ধরে সাইবার নিরাপত্তা দেবে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জর্জিয়াকে উড়িয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেন
জর্জিয়াকে উড়িয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেন
দেশে ‘জ্বালানি সুবিচারের’ দাবিতে ক্যাবের নাগরিক সংলাপ
দেশে ‘জ্বালানি সুবিচারের’ দাবিতে ক্যাবের নাগরিক সংলাপ
আপত্তিকর ছবি তুলে টাকা আদায়, বাধ্যতামূলক অবসরে এএসপি
আপত্তিকর ছবি তুলে টাকা আদায়, বাধ্যতামূলক অবসরে এএসপি
হারতে বসা ম্যাচ জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড
হারতে বসা ম্যাচ জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড
সর্বশেষসর্বাধিক