X
বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫
১৬ বৈশাখ ১৪৩২

কোরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষা

ইমরানুল বারী সিরাজী
১৬ জুন ২০২৪, ১৮:৪৮আপডেট : ১৬ জুন ২০২৪, ২১:৫৪

আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে একজন নবী স্বপ্ন দেখলেন। আল্লাহ পাক তাঁকে হুকুম করলেন তাঁর প্রিয় সন্তানকে কোরবানি করার জন্য। নবীদের স্বপ্ন ওহি। তাই তিনি তাঁর ছেলেকে কোরবানি করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। ছেলেও কোরবানির জন্য প্রস্তুত হলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বৃদ্ধ বয়সে সন্তান পেয়েছিলেন এই নবী। এই বয়সে সন্তান পেলে তাঁর প্রতি ভালোবাসা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিতে কোরবানির সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল কঠিন। তিনি কোনও ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন ছাড়াই আল্লাহর হুকুম মাথা পেতে নিয়ে কোরবানির করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। ছেলেও বাবার আনুগত্য প্রকাশ করে মহান রবের সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছেন। এই ঘটনা ঘটেছিল হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এবং তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের সঙ্গে। ইসমাইল (আ.) পরবর্তীতে নবীও হয়েছিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-এর ঘটনাটি আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের সুরা সাফফাতে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।

পিতা-পুত্র আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ

বৃদ্ধ বয়সে সন্তান হলে তার প্রতি ভালোবাসা আসাটাই স্বাভাবিক। আল্লাহর প্রতি কতটুকু ভালোবাসা আছে, তার পরীক্ষা নিতেই সন্তানকে কোরবানির নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি সেই পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতি দুম্বা সন্তানের পরিবর্তে কোরবানি হয়েছে।

মনের পশুকে কোরবানি দিতে পারলে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে

আমরাও যদি মনের পশুকে কোরবানি দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করি এবং ইসলামের পথে চলি, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে এখনও আমরা পুরস্কৃত হবো। আল্লাহ পাক কোরআনুল কারিমের সুরা হজে বলেছেন, আমার কাছে তোমাদের কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছে না। আমার কাছে তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে। মূল্যায়ন মহান রব করেন।

কোরবানির মাধ্যমে অনেক নেকি অর্জন করা যায়

হাদিস শরিফে এসেছে, সাহাবিগণ প্রশ্ন করলেন—এই কোরবানির ইতিহাস কী? হজরত মুহাম্মদ (সা.) বললেন, এটা আমাদের জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ.) থেকে এসেছে। সাহাবায়ে কেরাম আবারও জিজ্ঞেস করলেন, এই কোরবানির দ্বারা কী উপকার হবে আমাদের? আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে আল্লাহ পাক নেকি দান করবেন।

কোরবানি করার দ্বারা গুনাহ মাফ হয়

এক হাদিসে এসেছে, প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) তাঁর আদরের কন্যা ফাতেমা (রা.)-কে বললেন– কোরবানি করার সময় পশুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে, কারণ পশু জবাই করার সময় যখন রক্ত ঝরবে, প্রতিটি রক্তের ফোঁটার বিনিময়ে তোমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে।

কোরবানি কারা করবে

কোরবানি একটি ওয়াজিব বিধান। শরিয়তের দৃষ্টিতে যারা ধনী বা সাহেবে নেসাব তাদের জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব। যার যেকোনও ধরনের সম্পদ সাড়ে ৫২ ভরি রুপার সমমূল্য হলে তিনি ইসলামের দৃষ্টিতে সাহেবে নেসাব বা ধনী গণ্য হবে। কোরবানির দিন হচ্ছে জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ। মোট ৩ দিন।

কোরবানির পশু

কোরবানি করা যায় উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। উট, গরু ও মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরিক হতে পারবেন। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা এই প্রাণীগুলো শুধু একজন দিতে পারবেন।

কোরবানির পশু দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কোনও উপকৃত হওয়া যাবে না। একমাত্র আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্য জবাই করতে হবে।

কোরবানির গোশত নিজেও খেতে পারবেন অথবা অন্য কাউকেও দিতে পারবেন। এমনকি অমুসলিমদেরও কোরবানির গোশত দেওয়া যাবে।

কোরবানির গোশত তিন ভাগ করা

কোরবানির গোশত তিন ভাগ করার কথা হাদিস শরিফে এসেছে। এক ভাগ নিজের জন্য রাখবে। আরেক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। আরেক ভাগ গরিব-অসহায়দের জন্য। এটি একটি মুস্তাহাব আমল। তবে এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করলে অনেক ভালো হবে।

গোশত বিতরণ হবে শরিয়তের পন্থায়

ইদানীং কিছু সোসাইটিতে দেখা গেছে, সোসাইটির পক্ষ থেকে কোরবানির গোশত এক-তৃতীয়াংশ বাধ্যতামূলক সংগ্রহ করে গরিবদের মাঝে বিতরণ করেন। বাহ্যিকভাবে এই কাজটি দেখতে অনেক সুন্দর হলেও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে তাতে কিছুটা সমস্যা আছে। ইবাদত ইবাদতের মতোই করতে হবে। যার কোরবানি তিনি তা বণ্টন করবেন। যাকে ইচ্ছা তিনি তার মতো দেবেন। সোসাইটির প্রভাবের কারণে তিনি তার মতো করে দিতে পারবেন না। ইবাদতকে ইবাদতের মতো রেখে কাজ করাটাই ভালো। শরিয়ত কারও থেকে জোরজবরদস্তি করে কোনও কিছু নিয়ে অন্যের উপকার করার অনুমোদন দেয়নি। এ বিষয়টি আমাদের খেয়াল করতে হবে।

কোরবানির গোশত খাওয়ার, নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য

অনেকেই সারা বছর গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানির গোশত ফ্রিজে রেখে দেন। এটাও খুব ভালো দিক নয়। আমরা কোরবানি করি গোশত খাওয়ার জন্য নয়। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য। সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে হলে আমার কোরবানি কোরআন ও হাদিসের বিধান অনুযায়ী করবো। কোরবানির ঈদের আগে ফ্রিজ কেনার হিড়িক দেখলে মনে হয় কোরবানি হচ্ছে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে। বরং কোরবানির মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। তাই হাদিসে বর্ণিত পন্থায় গোশত বণ্টন করলেই  কল্যাণকর হবে সবার জন্য।

কিছু মাসআলা

কোরবানির পশুর চামড়া কেউ চাইলে নিজেই ব্যবহার করতে পারবে। যদি কোনও কারণে বিক্রি করে দেয় তাহলে সেই টাকা গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে।

কোরবানি করতে হবে সম্পূর্ণ হালাল টাকা দিয়ে। হারাম টাকা দিয়ে করলে কোরবানি হবে না।

কোরবানির সঙ্গে আকিকা দেওয়া যাবে। তবে আকিকা আলাদাভাবে দেওয়াই উত্তম। ছেলের জন্য দুই শরিক ও মেয়ের জন্য এক শরিক।

এই কোরবানির একটি ওয়াজিব আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। সামর্থ্যবান হওয়ার পরও যারা কোরবানি দেয় না তাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তারা যেন ঈদের নামাজে না আসে।

নিজের কোরবানির পশু নিজেই জবাই করা উত্তম। অন্য কেউ জবাই করলেও চলবে, কোনও অসুবিধা নেই। ঈদুল আজহার দিন সম্ভব হলে প্রথমে নিজ কোরবানির গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত। অর্থাৎ সকাল থেকে কিছু না খেয়ে প্রথমে কোরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। সুন্নত শুধু ১০ দিন হজের জন্য, ১১ বা ১২ তারিখে গোশত দিয়ে খানা শুরু করার জন্য নয়।

কোরবানির পশুর কোনও কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েজ নয়। গোশত পারিশ্রমিক হিসেবে কাজের লোককে দেওয়া যাবে না। অবশ্যই ঘরের অন্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরও গোশত খাওয়ানো যাবে।

কোরবানির পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া নেওয়া জায়েজ। তবে কোরবানির পশুর কোনও অংশ পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না।

আল্লাহ পাক যেন আমাদের সবাইকে ‘ইব্রাহিমি’ চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পশু কোরবানির পাশাপাশি মনের পশুকেও কোরবানি দেওয়ার তৌফিক দান করেন।

লেখক: খতিব, পীর ইয়ামেনী জামে মসজিদ, গুলিস্তান, ঢাকা

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পরিবেশ দূষণের দায়ে জরিমানা, পলিথিন জব্দ
পরিবেশ দূষণের দায়ে জরিমানা, পলিথিন জব্দ
নোয়াখালীতে লক্ষ্মীপুরের যুবলীগ নেতাকে পুলিশে দিলো ছাত্র-জনতা
নোয়াখালীতে লক্ষ্মীপুরের যুবলীগ নেতাকে পুলিশে দিলো ছাত্র-জনতা
বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তার হবু স্ত্রীকে ধর্ষণ ছাত্রদল নেতার
বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তার হবু স্ত্রীকে ধর্ষণ ছাত্রদল নেতার
শ্যালক খুনের মামলায় দুলাভাইয়ের যাবজ্জীবন
শ্যালক খুনের মামলায় দুলাভাইয়ের যাবজ্জীবন
সর্বশেষসর্বাধিক