X
বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪
২০ আষাঢ় ১৪৩১

সলিউশন জার্নালিজম: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

মো. সামসুল ইসলাম
০২ জুন ২০২৪, ১৬:১৪আপডেট : ০২ জুন ২০২৪, ১৬:১৪

কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে, বিশেষত যেকোনও ঈদের পরে, একটা রিপোর্ট প্রায় নিয়মিতই প্রচারিত হয়। সেটি হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়া, যেমন- ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির কারণে এই রিপোর্টের আবার লাখ লাখ শেয়ার হয়। রিপোর্টে একজন বা দুই জন বেশ বয়স্ক পুরুষ বা নারীকে দেখানো হয়, যারা দেশে বা বিদেশে সন্তান-সন্ততি থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধাশ্রমে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছেন। অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ভাষায় মা-বাবারা তাদের দুঃখ-কষ্টের বর্ণনা দেন, সন্তানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করেন।

সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত সবাই জানেন যে এটি একটি ক্লাসিক হিউম্যান ইন্টারেস্ট স্টোরি বা মানবিক আবেদনসম্পন্ন প্রতিবেদন। জনগণ এতে আবেগাপ্লুত হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্ট বক্স ভেসে যায় অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত সন্তানদের প্রতি গালিগালাজের বন্যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিউ বাড়ে আর মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার সুনাম অক্ষুণ্ণ থাকে।

ছেলেমেয়ে যদি তাদের সুযোগ ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তাদের মা-বাবাকে না দেখে সেটা যেকোনও বিচারে অবশ্যই অন্যায়। কিন্তু সব সন্তানই কি এই সুযোগ পাচ্ছেন? আমি ঢাকা শহরে নিজে চোখে দেখছি, অনেকে বিদেশে চাকরি বা উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছেন, আবার অনেককে ঢাকা বাইরে চাকরি করতে হচ্ছে। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি বা ডুয়াল ইনকাম ফ্যামিলি অর্থাৎ যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করছেন এরকম পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বয়স্কদের দেখভাল করা এখন অনেকের জন্যই কষ্টকর হয়ে পড়ছে।

শুধু তা-ই নয়। অনেক পরিবার তার নিজের সন্তানদের এখন ডে কেয়ার সেন্টারে দিচ্ছেন। দেশে-বিদেশে ক্যাডেট কলেজ টাইপের বিভিন্ন বোর্ডিং স্কুলে পাঠাচ্ছেন। ওল্ড অ্যাজ হোম বলুন আর ডে কেয়ার সেন্টারই বলুন, এগুলো মডার্ন ক্যাপিটালিস্ট সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এসবের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণ। পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন, অর্থনৈতিক চাপ, জনমিতির প্রবণতা, নারীর ভূমিকা ইত্যাদি।

এখন আমরা আমাদের মূল প্রসঙ্গে আসি। এই যে বারবার বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাপারে রিপোর্ট করে বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাপারে সমাজে একটি নেতিবাচক ধারণা তুলে ধরা হয়, এটা কি ভালো হচ্ছে? অনেকের সন্তান না থাকতে পারে, সন্তানদের বিদেশে থাকতে হতে পারে, সেসব বৃদ্ধ বা বৃদ্ধারা কোথায় থাকবেন? এই সামাজিক সমস্যার সমাধান কি হতে পারে?

মিডিয়ায় মাঝে মাঝেই এ ধরনের সংবাদ দেখি যে বাসায় বৃদ্ধা নারী খুন হয়েছেন বা দরজা ভেঙে বৃদ্ধের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এটা অবশ্যই কাম্য নয়। সে ক্ষেত্রে কি বৃদ্ধাশ্রম ভালো নয়?

এখানে আসে সলিউশন জার্নালিজম প্রসঙ্গ। যাকে বাংলায় বলা যেতে পারে সমাধান সাংবাদিকতা। সলিউশন জার্নালিজমের ধারণাটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে এ সাংবাদিকতায়  প্রতিবেদনে শুধু সমস্যাই তুলে ধরা হয় না; বরং এটি বিভিন্ন উপায়ে সমাধানের পথও বাতলে দেয়। সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে সলিউশন জার্নালিজমের প্রয়োগ অনেক দেশেই দেখা যায়। আমাদের দেশেও এর প্রয়োগ যে হয় না তা আমি বলছি না। আমাদের দেশেও সলিউশন জার্নালিজম নিয়ে আলোচনা আছে। এটি অবশ্যই অস্বীকার করা যায় না যে অনেক রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে সলিউশন জার্নালিজম পাঠক বা দর্শক-শ্রোতাদের বিষয়টির গভীরে যেতে সাহায্য করে।

এ ধরনের রিপোর্টিংয়ে সাংবাদিক সামাজিক সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত, নাগরিকদের সাক্ষাৎকার ইত্যাদির ভিত্তিতে সমস্যাটির সমাধানের উপায় বা সমাধানের অগ্রগতি তুলে ধরেন। আমি সলিউশন জার্নালিজমের তত্ত্বীয় দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি না। আমি যে পশ্চিমা সাংবাদিকতার সব ধারণাই বিনা দ্বিধায় মেনে নিই সেটিও নয়। কিন্তু আমরা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সলিউশন জার্নালিজমকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। এর উপযোগিতা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। বিশেষত বৃদ্ধাশ্রম বা এ ধরনের বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে।

আমি যেভাবে বুঝি তা হলো সলিউশন জার্নালিজম অনুসারে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের ইন্টারভিউ, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা, সফলতার গল্প, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে বৃদ্ধাশ্রমগুলোকে আরও মানবিক করে তোলা যায়—এসব ব্যাপার আনা যেতে পারে।

আগেই বলেছি যে পরিবর্তিত পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক এবং সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী কাঠামোয় শিশুদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার বা বৃদ্ধদের জন্য ওল্ড হোম অপরিহার্য। আপনি এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেন না। যেটা করা যায় এই ব্যাপারে সমাজে একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে সহায়তা করা। কীভাবে পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এরকম সিনিয়র সিটিজেনরা তাদের প্রয়োজনের সময়ে একটি পারিবারিক ও মানবিক পরিবেশে থাকতে পারেন, এরকম রিপোর্টিং দরকার বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।

সলিউশন জার্নালিজমের প্রয়োজন এ ধরনের আরও দু-একটি অমীমাংসিত ইস্যু আমি সংক্ষেপে আলোচনা করতে পারি।

সেদিন অফিস থেকে এসে দেখছি বাসার সবার মন বেশ খারাপ। কারণ তারা বাসার জানালা দিয়ে এলাকার কিছু ছেলেকে দুটি বেওয়ারিশ কুকুরকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে দেখছে। সম্ভবত বারবার কুকুরের কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকাবাসী এ কাজটি করেছে। ঘটনাটি আমাকেও গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। সেইসঙ্গে আমি বুঝতে পারছি রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরকে নিয়ে আমাদের যে সমস্যা এর সমাধান এখনও হয়নি। রাস্তায় হাঁটতে বের হলে এখনও তারা মাঝে মাঝে তাড়া করে।

সবার মনে আছে নিশ্চয়ই, কয়েক বছর আগে কর্তৃপক্ষের বেওয়ারিশ কুকুর নিধন নিয়ে দেশে লংকাকাণ্ড হয়েছিল। মিডিয়া, পশুপ্রেমী এবং অনেক সাধারণ মানুষ এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু সে সময়ের অনেক রিপোর্টিংয়ে আমি বেওয়ারিশ কুকুর সমস্যার বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের কোনও পন্থা আলোচিত হতে দেখিনি। থাকলেও আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই সমস্যার এখনও পরিপূর্ণ সমাধান হয়নি। সেই ঘটনার পরে দরকার ছিল প্রচুর ফলোআপ রিপোর্ট এবং গবেষণাভিত্তিক সলিউশন জার্নালিজমের প্রয়োগ। তাহলে অন্তত রাস্তঘাটে কুকুর পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটতো না।

অন্য আরেকটি প্রসঙ্গ। আর কিছু দিন পরেই আসছে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। এ সময় বাসায়, উঠোনে, রাস্তাঘাটে কোরবানির ফলে পুরো শহরে এক অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানির অনুরোধ জানালেও বা তাড়াতাড়ি বর্জ্য পরিষ্কারের ঘোষণা দিলেও ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলো হয়ে পড়ে পশুর রক্ত, বর্জ্যে দুর্গন্ধযুক্ত ও অপরিচ্ছন্ন। এক্ষেত্রে আমি মনে করি সলিউশন জার্নালিজমের ভূমিকা আছে। সাংবাদিকরা নিত্যনতুন আইডিয়ার মাধ্যমে প্রতিবছর নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন, সেইসঙ্গে জনগণকে সচেতন করতে পারেন বা নতুন কোনও সমাধানের পদ্ধতি আলোচনা করেতে পারেন।

আমাদের দেশে অনেক ভালো সাংবাদিক আছেন। আছেন অনেক পেশাদার ও দুর্দান্ত রিপোর্টার। সলিউশন জার্নালিজম নিয়ে তারা নিশ্চয়ই অবগত। সাংবাদিকতার শিক্ষক হিসেবে নয়, বরং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি আমাদের এ ধরনের সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে সাংবাদিকরা যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে পলিসি ইনপুট দেন, তাহলে সাধারণ জনগণ উপকৃত হবেন।  

লেখক: কলামিস্ট, বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৬ এমপি ও প্রথম মন্ত্রিত্বের অপেক্ষায় বি‌লে‌তের বাংলাদেশি‌রা
৬ এমপি ও প্রথম মন্ত্রিত্বের অপেক্ষায় বি‌লে‌তের বাংলাদেশি‌রা
নরসিংদীতে নৌকা ডুবে ভাইবোন নিখোঁজ
নরসিংদীতে নৌকা ডুবে ভাইবোন নিখোঁজ
বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
পাবনায় প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা, নিহত ৫
পাবনায় প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা, নিহত ৫
সর্বশেষসর্বাধিক