X
মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪
১৮ আষাঢ় ১৪৩১

তিনজন কিংবা তিনবার!

আহসান কবির
০১ জুন ২০২৪, ১৮:৩২আপডেট : ০১ জুন ২০২৪, ১৮:৩২

সুমন, রাজন, মোহন/ বন্ধু আমরা তিনজন/ ভালোবাসার জিঞ্জিরে বাধা আমাদের জীবন!– ‘জিঞ্জির’ ছবির গান।

তিন বন্ধুর বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক গান এবং গল্প আছে। আছে বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজি ছবি। বাংলা ‘সুমন রাজন মোহনে’র মতো হিন্দি ‘জন জনি জনার্ধন তারা রম পম পম পম পম’ শিরোনামের গানও জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘জন জনি জনার্ধন’ ছবির রিমেক হয়েছিল ‘অমর আকবর অ্যান্থনি’ নামে। আছে আমির খানের বহুল আলোচিত ছবি ‘থ্রি ইডিয়টস’। বাংলাদেশ টেলিভিশনের পরে আরও কয়েকটি বেসরকারি চ্যানেলে প্রচারিত হওয়ার কারণে জনপ্রিয় হয়েছিল কমেডি সিরিয়াল ‘থ্রি স্টুজেস’। বাংলা ছবির নাম আছে–‘তিন টেক্কা’। হুমায়ূন আহমেদের লেখা সায়েন্স ফিকশান ‘তারা তিনজন’ও বহুল পঠিত। আলেকজান্ডার দ্যুমা রচিত ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ অনুবাদের কারণে এদেশে জনপ্রিয়। বহুদিন পরে তিনজন মানুষ একসাথে আলোচনায় এসেছেন। এটা কি কাকতালীয় নাকি অন্য কোনও কিছুর ইশারা? এই তিনজনের কথায় পরে আসা যাবে।

আমরা কোনও কিছুর ইশারা না খুঁজে তিন বা তিনজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি। হাউজি খেলার মজা নাকি এর নম্বর ঘোষণায়। সেখানে তিন এর ঘোষণা এমন– ‘একটা কিনলে আর একটা ফ্রি/ চাইয়া দেখেন নম্বর থ্রি!’ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় আছে–‘ছিপখান তিন দাঁড় তিনজন মাল্লা/ চৌপর দিন ভর দেয় দূর পাল্লা’। মানুষের জীবন নাকি তিন সত্যের ওপর দাঁড়ানো। বাংলা ছবির গানে আছে– ‘জন্ম, মৃত্যু আর বিয়া/ এই তিন সত্য দিয়া/ বানাইছে মানুষ আল্লাহ বানাইছে দুনিয়া!’ এমন আরেক ধ্বংসকারী সত্য হচ্ছে জুয়া যা তিন তাস দিয়ে খেলা হয়। ছোটকালে বইতে পড়েছি– ‘তাস খেলে কত ছেলে পড়া নষ্ট করে/ পরীক্ষা আসিলে তাই চোখে জল ঝরে!’ প্রেম বা বিবাহিত জীবনে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন নাকি ভালো না। এরা প্রেম বা সংসারে অনুপ্রবশকারী! একারণে ছবির নাম হয়– ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বর’। লালন সাঁইজীর গানে আছে– ‘তিন পাগলের হলো মেলা নদে এসে/ ও তোরা যাসনে ও পাগলের দেশে’! আছে কিছু বিখ্যাত ‘ত্রয়ী’ উপন্যাস যেমন সমরেশ মজুমদারের লেখা –কালবেলা, কালপুরুষ এবং উত্তারাধিকার। একবার এক অডিও বা গানের অ্যালবাম জনপ্রিয় হয়েছিল যার নাম ছিল– ‘ত্রিরত্নের ক্ষ্যাপা’! গায়ক পার্থ বড়ুয়া, আশরাফ বাবু এবং চারু ছিলেন এই তিন রত্ন। কিন্তু এই লেখার তিন পাগলের (এখন দুই পাগলের) দেশে না থেকে কি কোনও উপায় আছে? হয়তো নেই বলেই তাদের দেশে থাকা।

এই লেখায় যে তিনজনের কথা বলা হচ্ছে তারা পাগল বা পরস্পরের বন্ধুও হয়তো নন। তবে এরা মহা সম্মানিত মানুষ। তিনজনই ক্ষমতার কাছাকাছি ছিলেন, সরকারের গুড বুকেও ছিলেন। সরকারের গুড বুক থেকে কি এই তিনজন ব্যাডবুকে চলে এসেছেন? আমরা কোনও প্রশ্নে নেই, ইঙ্গিত বা ইশারায় নেই। ইশারায় শিস দিয়ে আমরা কাউকে ডাকছি না। আমরা আছি শুধু তিনে বা তিনজনে। ‘ঝড় হইলে বৃষ্টি ফ্রি/ বাজ হইলো নম্বর থ্রি!’

এই প্রথমজন এমএ আজিজ যার ডাক নাম ‘ফারুক’। প্রথমে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং পরে সেনাবাহিনী প্রধান হয়েছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ সাহেবকে যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে। সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় তাকে নিয়ে বিশাল এক ‘প্রতিবেদন’ করেছিল আল জাজিরা। এই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে জাতি জানতে পেরেছিল যে আজিজ সাহেব বিজিবি প্রধান থাকা অবস্থায় কীভাবে তার সহোদর মোহাম্মাদপুরের কথিত হারিস বাহিনী প্রধান খ্যাত হারিসকে কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন। সাবেক এই সেনাপ্রধানের আরেক সহোদর তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ ছিলেন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। বিশ বছর সাজা খাটার পর জোসেফ মুক্তি পান এবং তাকে মুক্তি পাওয়ার দিনই বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এই তিনজনের দ্বিতীয়জন বেনজীর আহমেদ। তিনি এদেশের র‌্যাব এবং পুলিশ প্রধান ছিলেন। তিনি তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য নজীর স্থাপন করার পর তার নাম দেওয়া হয় একালের শাহাজাহান। মোঘল সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ মহলের প্রতি এত কিছু করেননি যা করেছেন বেনজীর আহমেদ। স্ত্রীর প্রতি তার এই ভালোবাসা অমর হয়ে থাকবে। বেনজীর সাহেবের ৩৪৫ একর জমির মধ্যে ২৪৫ বিঘা তার স্ত্রী জীশান মির্জার নামে। স্ত্রী ও সন্তানদের নামে রয়েছে ৩৩ টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট  এবং শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে আছেন তার স্ত্রী এবং সন্তানরা। ঢাকার গুলশানে একদিনে চার চারটা ফ্লাট কিনেছিলেন বেনজীর ও তার পরিবার! ২০২১ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আমেরিকা র‌্যাব ও পুলিশের যে সাতজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় তার মধ্যে বেনজীর আহমেদও ছিলেন। তখন তিনি পুলিশ প্রধান। বেনজীর সাহেবের সব সম্পত্তি ক্রোক ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে।

তিনজনের শেষজন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। তিনি পশ্চিমবঙ্গে খুন হয়েছেন। তিন তিনবার আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ সদস্য হলেও এক হিসেবে তিনি ‘বহিরাগত’! তিনি বিএনপির মনোনয়নে ১৯৯২ সালে কালিগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর হয়েছিলেন। খুন হবার পর তাকে নিয়ে অগনিত রিপোর্ট এবং টেলিভিশনে টকশো হয়েছে। কোনও সংসদ সদস্য এই প্রথম দেশের বাইরে খুন হলেন। এত নির্মম কিংবা নৃশংস হত্যাকাণ্ড কমই ঘটেছে। ভিকটিম এবং খুনিরা সব বাংলাদেশি শুধু খুনটা করেছে তারা পশ্চিমবঙ্গে। এরপর থেকে ভ্রমণ, কর্ম, শিক্ষা কিংবা চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবার মতো কেউ কেউ কি খুনের পরিকল্পনা নিয়েও বিদেশ যাবেন?

প্রথমেই বলেছি আমরা কোনও ইশারা, ইঙ্গিত কিংবা যোগসাজশ খুঁজছি না। এটা স্রেফ ‘তিন’ এর সমাহার নিয়ে একটা লেখা। মিল শুধু এই যে আজিজ ও বেনজীর সাহেবকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় ফেলেছিল আমেরিকা আর আনার সাহেবের খুনের মাস্টারমাইন্ড খ্যাত আখতারুজ্জামান শাহিন জন্মসূত্রে বাংলাদেশি হলেও তিনি এখন আমেরিকান নাগরিক! তাই আমেরিকা নিয়ে ‘তিন সত্য’ তুলে ধরা যায়-

এক. যতই বলা হোক ‘আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর অভাব হয় না’– তবু আমেরিকার বন্ধুত্ব পেতে মরিয়া হয়ে থাকে একশ’রও বেশি দেশের সরকার ও বিরোধী দল।

দুই. দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর দেশে দেশে সামরিক শাসন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, দখলদারিত্বের মাধ্যমে অন্য দেশের তেল বা স্বর্ণ উত্তোলন, ফিলিস্তিনে মুসলিম নিধন অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের জন্য আমেরিকাকে যতই সমালোচনা করা হোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ সুযোগ পেলে আমেরিকাতেই যেতে চায় আগে।

তিন. মানবাধিকার ও গণতন্ত্র আমেরিকার নিজ দেশের জন্য যেমন অন্য দেশের বেলায় আদৌ তেমন নয়। সেখানে দখলদারিত্ব কিংবা পরোক্ষ প্রভাব বিস্তারই আসল। দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে পিস্তলবাজি করে যে ওয়েস্টার্ন কাউবয়রা সব ঘোড়া, গরু বা র‌্যাঞ্চ (বিশাল খামার) দখলে রাখতে চায় আমেরিকাও তেমন। প্রভাব বা দখলদারিত্বই তার রাজনৈতিক রোমাঞ্চ।

তাহলে কী দাঁড়ালো ‘তিন’ এর ভাগ্যে? আমরা বরং একটা প্রচলিত কৌতুক শুনি। এর মধ্যেও কোনও ইশারা বা ইঙ্গিত নেই। ওয়েস্টার্ন এক যুবক টগবগ টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে। পথে দেখলো থুড়থুড়ে এক বুড়ো পথ হাঁটছে। তার সামনে ফনা তুলে দাঁড়িয়েছে এক কাল কেউটে। ওয়েস্টার্ন যুবক পিস্তলের গুলি ছুঁড়ে সাপের মাথা উড়িয়ে দিল। সব দেখে মুগ্ধ বুড়ো। ওয়েস্টার্ন যুবককে বুড়ো বললো– বাবা তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। আমি কিন্তু সাধারণ কেউ নই। তুমি তিনটা জিনিস বর চাও। কাল সকালে ঘুম ভাঙ্গার আগেই পেয়ে যাবে। ওয়েস্টার্ন যুবক তেমন বিশ্বাস করতে পারলো না। তবু বললো-

এক. আমার চেহারা হবে নায়ক সিলভেস্টার স্ট্যালোনের মতো।

দুই. ফিগার হবে আরেক নায়ক আরনোল্ড সোয়ার্জিনেগারের মতো।

আর তিন. আমার যৌবন মানে নিচেরটা হবে এই ঘোড়াটার মতো!

পরদিন ওয়েস্টার্ন যুবক ঘুম ভাঙ্গার পর দেখলো তার পরনের কাপড় ছেঁড়া। সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দেখলো তার মুখাবয়ব সিলভেস্টার স্ট্যালোনের মতোই কিন্তু কেমন যেন। এরপর দেখলো ফিগারও আরনোল্ড সোয়ার্জিনেগারের মতো কিন্তু কেমন যেন। এরপর নিচের দিকে তাকিয়ে তার প্রবল কান্না পেলো। কান্নার মাঝেই তার মনে পড়লো গতকাল সে আস্তাবল থেকে বিশাল এক মাদী ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছিল!

যে কোনও কিছু করার আগে অন্তত তিনবার ভাবুন। না হলে ক্ষমতা কিংবা ক্ষমতার পোশাক যখন থাকবে না তখন পরপর তিনবারেও আপনার শাস্তি বা অনুশোচনা শেষ হবে না।

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিগগিরই ইউক্রেনে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করবে নেদারল্যান্ডস
শিগগিরই ইউক্রেনে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করবে নেদারল্যান্ডস
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৪)
ক্রিমিয়ার আকাশে ৫টি উড়ন্ত বস্তুকে ভূপাতিত করলো রাশিয়া
ক্রিমিয়ার আকাশে ৫টি উড়ন্ত বস্তুকে ভূপাতিত করলো রাশিয়া
টাইব্রেকারে স্লোভেনিয়াকে হারিয়ে শেষ আটে পর্তুগাল
টাইব্রেকারে স্লোভেনিয়াকে হারিয়ে শেষ আটে পর্তুগাল
সর্বশেষসর্বাধিক