স্কুলে সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন থেকে কমিয়ে ১ দিন করায় শিক্ষকদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তারা প্রতিবাদ হিসেবে কর্মবিরতির কর্মসূচিও ঘোষণা করেছেন। তারা প্রথম অবস্থায় প্রতি শনিবার ১ ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করবেন। পরবর্তীকালে প্রতি শনিবার পুরো দিন কর্মবিরতি পালনের আগাম ঘোষণাও করেছেন। শিক্ষকদের এই অংশটি বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী শিক্ষকদেরই একটি অংশ সাপ্তাহিক ছুটি শুধু শুক্রবারের পক্ষেও মত দিয়েছেন। যেকোনও বিষয়ে যেমন নীরব ভূমিকা পালনকারী একটি পক্ষ থাকে, এখানেও তাই আছে। সম্ভবত তাদের সংখ্যাই হবে বেশি।
ছুটির এই বিতর্ক নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ১২ মে এক অনুষ্ঠান বলেছেন, যেহেতু আমরা তাপপ্রবাহের কারণে প্রায় ৯টি কর্মদিবস পাইনি, সেহেতু আমরা চেষ্টা করছি শনিবার আপাতত একটি ব্যবস্থা করে কর্মদিবসগুলো যেন পাই। তবে এটি স্থায়ী কোনও সিদ্ধান্ত নয়।
যাহোক, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে বিশেষ পরিস্থিতিতে স্কুলগুলোতে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা হয়েছিল। মনে থাকার কথা, করোনার সময় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার পর যখন প্রথম ক্লাস শুরু হয় তখনই সাপ্তাহিক ছুটি একদিনের পরিবর্তে দুই দিন করা হয়েছিল। সেই সময়ের প্রয়োজনে এই সিদ্ধান্ত ছিল যথার্থ। গত ৪/৫ বছর ধরে বিভিন্ন কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার দীর্ঘ সময় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম অকল্পনীয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা ছিল অলঙ্ঘনীয়। বাধ্য হয়ে এটা করতে হয়েছিল। যদিও একপর্যায়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল কিছুই না করার চেয়ে কিছু একটা করার মতো।
সম্প্রতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আবার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয় শিক্ষণ সুবিধা থেকে। ইতোমধ্যে শিক্ষা পদ্ধতিতে নতুন ধারা চালু হয়েছে। শিক্ষার্থীই শুধু নয়, শিক্ষকদেরও অনেকের কাছে সম্পূর্ণ নতুন এই পদ্ধতি। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা পহেলা জানুয়ারি থেকে বই পাওয়ার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণে এবার বই পেতে কিছু সময় লেগেছে। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে তাপদাহের দুর্ভোগ। করোনাকালে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে লেখাপড়া কিছুটা চালাতে পারলেও এই গরমে বাসাতেও লেখাপড়া করতে পারেনি। ফলে বছরের ৫ মাস চলে গেলেও শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা প্রকৃতপক্ষে ২ মাসেরও হয়নি। এই যে বিশাল শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ করার দায়িত্ব শিক্ষক, অভিভাবক, সরকারের ওপর বর্তায়। এখানে মূল ভূমিকা পালন করতে হয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে। এর প্রধান মাধ্যম হচ্ছে শিক্ষালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিত থেকে শিক্ষাসুবিধা গ্রহণ। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী যদি স্কুলে আসার সুযোগ না পায় তাহলে তার শিক্ষায় যে ঘাটতি হয়েছে তা পূরণ করার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
এমন অবস্থায় সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন বহাল রাখার পক্ষে যারা আন্দোলনের কথা বলছেন, তাদের যুক্তিগুলো দেখা যেতে পারে। তাদের কথা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের সৃষ্টি নয়। তাই ছুটি কমিয়ে আনার যুক্তি নেই। তারা আরও উল্লেখ করেছেন, ‘অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চিকিৎসা নেওয়া, আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানো, আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্রামসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। এক দিনের ছুটিতে যাবতীয় কাজ ও সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এতে সামাজিক, শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হবে।’ (বাংলা ট্রিবিউন,৭ মে ২০২৪।
শিক্ষকদের দাবিগুলো অযৌক্তিক কিংবা অপ্রয়োজনীয় এমন বলা যাবে না। কিন্তু অধিকাংশের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রয়োজনীয়তা যাচাই করতে গেলে তাদের যুক্তিগুলো অসার বলে মনে হতেই পারে। বেড়ানো, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, বিশ্রামের কারণে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষণ ক্ষতিপূরণ না করাটা কি স্বাভাবিক মনে হতে পারে? তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য প্রকৃতিকে দায়ী করে শিক্ষার্থীদের ক্ষতির বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে যখন স্কুলে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল তখন ঠিকই ছুটির পক্ষে কথা বলেছেন।
এসব তর্কে আর না গিয়ে বলা যায়, আমাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষকসহ সবাইকে যার যার ক্ষেত্র থেকে কিছুটা ত্যাগের মানসিকতা নিয়েই এগিয়ে আসতে হবে। মাথায় রাখতে হবে, এই শিশু-কিশোররাই আমাদের ভবিষ্যৎ। এরা আমাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম। এমতাবস্থায় সপ্তাহে ১ দিন নাকি ২ দিন ছুটি থাকবে সেই বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়াটাই উচিত বলে মনে করি। তাদের কেউ কেউ সরকারি অফিস আদালতের সাপ্তাহিক ছুটির প্রসঙ্গও এনেছেন। তারা হয়তো খেয়াল করেননি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনেই সর্বাধিক ছুটি থাকে। যা সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনও প্রতিষ্ঠানই ভোগ করতে পারে না। তারপরও সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা নিজ এলাকা থেকে বহু দূরে থাকেন। পারিবারিকভাবে অনেকেই বিচ্ছিন্নও থাকেন। সামাজিক ও পারিবারিক প্রসঙ্গ এলে তাদের ছুটি কি সপ্তাহে ২ দিনের চেয়ে বেশি করে দিতে হবে? অন্যদিকে সরকারি কর্মীর সংখ্যা ২৫ লাখেরও কম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীর সংখ্যা কয়েক কোটি। এই কয়েক কোটি কর্মী সপ্তাহে ১ দিন ছুটি ভোগ করার সুযোগ পান। কোনও কোনও কর্মীকে আবার ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ ভিত্তিতেও কাজ করতে হয়। সুতরাং শিক্ষকদের অধিক ছুটি দেওয়ার যুক্তিটা কী? ৫ মাস পর অনেক বইয়ের সংশোধনী গিয়েছে স্কুলগুলোতে। এটাও বিবেচনায় আনতে হবে। সংশোধিত অংশগুলো শিক্ষার্থীদের আবারও বোঝাতে হবে।
শিক্ষকদের মানসিক প্রশান্তিরও প্রয়োজন আছে। এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য শিক্ষকরা আমাদের ভবিষ্যৎকেও তৈরি করবেন। এই ভবিষ্যৎ তাদেরও। বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে অন্য দশ জন কর্মীর মতো তারা নিজেরা কিছুটা ছাড় দিতেই পারেন, এমন প্রত্যাশা করা খুব বেশি বলে মনে করি না।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।