X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২

সংকটে গণমাধ্যম: চ্যালেঞ্জ জিততে লড়তে হবে

প্রভাষ আমিন
১৪ মে ২০২৪, ০০:০২আপডেট : ১৪ মে ২০২৪, ০০:৩৫

কয়েক বছর আগে আমি অফিসে আসছিলাম। পথে এক ফেসবুক বন্ধু ফোন করলেন। তাকে বললাম আমি গাড়ি চালাচ্ছি, পরে অফিসে পৌঁছে ফোন দেবো। গাড়ি চালাচ্ছি শুনে তার বিস্ময়ের শেষ নেই। একজন সাংবাদিক গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন, এটা তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তিনি ধরেই নিলেন আমি মহাদুর্নীতিবাজ। দুর্নীতি করেই আমি গাড়ি কিনেছি। অথচ যে গাড়িটি আমি চালাচ্ছিলাম, সেটি অফিসের দেওয়া। শুধু সেটি নয়, গত ২০ বছর ধরেই আমি ঢাকা শহরে গাড়ি ব্যবহার করি। এখন যেটি ব্যবহার করি, সেটি আমার পঞ্চম গাড়ি। সবগুলোই বিভিন্ন অফিসের দেওয়া।

আসলে সাংবাদিকদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা হলো, সাংবাদিক হতে কোনও যোগ্যতা লাগে না, কোনও পাস লাগে না। আর কোনও উপায় না পেয়ে সবাই সাংবাদিকতা করছেন। সাংবাদিকরা নিয়মিত বেতন পাবেন না। ঝোলা ব্যাগ, ময়লা পাঞ্জাবি, ছেঁড়া স্যান্ডেল পরে তারা কাজ করবেন। চেয়ে-চিন্তে চলবেন। বছরের পর বছর এই ভুল ধারণা চলে আসছে। একসময় সাংবাদিকতা পুরোদস্তুর পেশা ছিল না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অনেকে রাজনীতির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন। দৈনিক সংবাদ একসময় ছিল বামপন্থি রাজনীতিবিদদের আশ্রয়স্থল।

দিন বদলে গেছে অনেক আগেই, তবে আমাদের ধারণা বদলায়নি। সাংবাদিকতা এখন আর নিছক শখ নয়, সাংবাদিকতা এখন সার্বক্ষণিক পেশা। এটা ঠিক— উকিল, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারদের মতো সাংবাদিক হতে গেলে শিক্ষাগত যোগ্যতার নির্দিষ্ট কোনও মানদণ্ড নেই। কিন্তু সাংবাদিক হতে গেলে তাকে যোগ্য এবং দক্ষ হতে হয়। সবসময় সেটা ক্লাসরুমেই শিখে আসতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। কিন্তু আর কিছু করতে না পেরে নিরুপায় হয়ে সাংবাদিকতা করার দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই। সাংবাদিকতা এখন অনেক চ্যালেঞ্জিং এবং আকর্ষণীয় সার্বক্ষণিক পেশা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রি পেলেই হবে না, একজন সাংবাদিককে সার্বক্ষণিক আপডেট থাকতে হয়, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে আরও দক্ষ ও যোগ্য করে তুলতে হয়।

আমি চুনোপুঁটি ধরনের সাংবাদিক। আমার চেয়ে দক্ষ, যোগ্য, ভালো সাংবাদিক অনেকেই আছেন। তাদের অনেকেই অফিসের দেওয়া সার্বক্ষণিক পরিবহন সুবিধা পান, কেউ গাড়ি পান, কেউ মোটরসাইকেল। একসময় আমরা বাসে ঝুলে অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে যেতাম। এখন সব টিভি স্টেশনেই অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করার জন্য অফিসের পরিবহন সুবিধা আছে। বাংলাদেশের অনেক গণমাধ্যম ওয়েজবোর্ড মেনে নিয়মিত বেতন-বোনাস দেয়। কোনও কোনও অফিস সরকার নির্ধারিত সুবিধার চেয়েও বেশি সুবিধা দেয়। দেশের বাইরের বিভিন্ন বড় ইভেন্ট, সেটা খেলা হোক বা বাণিজ্যিক সম্মেলন হোক বা নির্বাচন হোক, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে কাভার করতে যান।

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখন আর মান্ধাতা আমলের ধারণায় আটকে নেই। বাংলাদেশ এখন সাংবাদিকতায়ও বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এটা মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠও আছে। আলোর নিচে যেমন অন্ধকার, সম্ভাবনার পাশে শুয়ে আছে অনেক সমস্যাও। অনেক গণমাধ্যম ওয়েজবোর্ড মেনে বেতন দেয় এটা যেমন সত্যি, আবার বেশিরভাগ গণমাধ্যমে তার বালাই নেই, সেটা আরও বেশি সত্য। বেশিরভাগ গণমাধ্যমই নামকাওয়াস্তে বেতন দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে বেতন হয় অনিয়মিত। বাধ্য হয়ে সাংবাদিকদের অনেক অনিয়মের সঙ্গে জড়াতে হয়। শুরুতে যে ফেসবুক বন্ধুর কথা বলেছিলাম, তার ধারণা কিন্তু পুরোপুরি মিথ্যা নয়। ঢাকায়, ঢাকার বাইরে অনেক সাংবাদিকই নানান অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।

যত যা-ই বলি, মালিকের কাছে গণমাধ্যমও একটি ব্যবসাই। এখানেও লাভ-ক্ষতির ব্যাপার আছে। কোনও মালিকই নিজেদের পকেট থেকে সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা দেবেন না। আয় থেকেই খরচ মেটানোর কথা ভাববেন। সেটা না হলেই সংকট ঘনীভূত হয়। বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের গণমাধ্যমও মূলত বিজ্ঞাপননির্ভর। সরকারের নীতিনির্ধারকরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে এর আধিক্যকে যুক্তি মানেন। কিন্তু আধিক্যই গণমাধ্যমের সংকটের মূল কারণ। বাংলাদেশের মতো ছোট্ট বাজারে যতটি গণমাধ্যম টিকে থাকা সম্ভব ছিল, আছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে বিজ্ঞাপন বাজার সংকুচিত হয়ে যায়, ভাগাভাগি হয়ে যায়। এতে সবার ভাগেই টান পড়ে। পত্রিকা না হয় মানুষ কিনে পড়ে, কিন্তু টিভি বা অনলাইন গণমাধ্যম দেখতে বা পড়তে কোনও টাকা দিতে হয় না। পত্রিকাও বিক্রির টাকায় চলতে পারে না। কারণ, একটি পত্রিকা পাঠকের হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ হয় ১৫ টাকা। আপনি হয়তো কিনছেন ১০ টাকা দিয়ে। কিন্তু হকার কমিশন, ফেরত, অপচয়, সৌজন্য কপি ইত্যাদি মিলে মালিকের হাতে যায় হয়তো ৫ টাকা। তার মানে প্রতি কপি পত্রিকা বিক্রি হলে মালিকের ক্ষতি ১০ টাকা। যত বেশি বিক্রি, তত বেশি ক্ষতি। এই ক্ষতি পত্রিকার মালিক পোষান বিজ্ঞাপন থেকে। পত্রিকা বেশি চললে বিজ্ঞাপন বেশি পাওয়া যাবে। কিন্তু কম পেলেই ক্ষতির বোঝা বাড়বেই শুধু। ঢাকার অনেক পত্রিকা আছে, যারা ক্ষতি কমানোর জন্য চাহিদা থাকলেও কম ছাপেন।

পত্রিকা বিক্রি করে না হয় কিছু টাকা আসে। কিন্তু টিভি বা অনলাইনকে তো পুরোটাই বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই যে আপনারা বাংলা ট্রিবিউন পড়ছেন বছরের পর বছর, কখনও তো আপনাকে একটি টাকাও দিতে হয়নি। তাহলে বাংলা ট্রিবিউনের কর্মীরা বেতন পাবেন কোত্থেকে, তাদের সংসার চলবে কীভাবে? অনলাইন গণমাধ্যমের বিপুল বিস্তারে একসময় ধারণা করা হচ্ছিল ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ সংকটে পড়বে।

এখনও ছাপা পত্রিকা দাপটের সঙ্গেই টিকে আছে। অনলাইন গণমাধ্যম সেখানে অনেকটাই ভাগ বসিয়েছে। তবে এখন ফেসবুক, ইউটিউবের প্রবল ঢেউ ভাসিয়ে নিতে চাইছে মূলধারার গণমাধ্যমকেই। এমনিতেই বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের বাজার ছোট, এর ওপর তার অনেকটাই দখল করে নিয়েছে ফেসবুক ও ইউটিউব। ফলে মূলধারার গণমাধ্যম, সেটা অনলাইন-অফলাইন, টিভি, পত্রিকা, রেডিও, যাই হোক অস্তিত্বের সংকটে আছে সবাই।

অনেক উদ্যোক্তাই অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন নিয়ে গণমাধ্যমে আসেন। প্রথম কিছু দিন সাবসিডি দিয়ে চালান। আস্তে আস্তে তার সামর্থ্য কমতে থাকে, ক্ষতি বাড়তে থাকে। একসময় তার স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসে। এই সংকটে টিকে থাকার একটাই উপায়, আরও ভালো সাংবাদিকতা করা। জনগণের আরও কাছে পৌঁছানো, তাদের আস্থা অর্জন করা। আপনি যত বেশি পাঠক বা দর্শকের কাছে যেতে পারবেন, বিজ্ঞাপনদাতারা ততই আপনার কাছে আসবেন। ফেসবুক, ইউটিউবে সাংবাদিকতার নামে অপতথ্য, ভুল তথ্যের জোয়ার চলছে। আমি নিশ্চিত এই জোয়ার থাকবে না। সাংবাদিকদের সবসময়ই স্রোতের বিপরীতে লড়াই করতে হয়। এখন এই লড়াই আরও কঠিন হয়েছে। সাংবাদিকদের একটাই অস্ত্র, ভালো সাংবাদিকতা। এই অস্ত্র নিয়েই লড়াই চালাতে হবে।

বাংলা ট্রিবিউন শুরু থেকেই সাহসের সঙ্গে এই লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছে। খারাপ সময় আসবে, কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না, লড়াইয়ের ময়দান ছাড়া যাবে না।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ বিব্রতকর: পুলিশ সুপার
ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ বিব্রতকর: পুলিশ সুপার
চট্টগ্রামে খাল-নালায় ১৫ জনের মৃত্যু, তবু উদাসীন সিটি করপোরেশন ও সিডিএ
চট্টগ্রামে খাল-নালায় ১৫ জনের মৃত্যু, তবু উদাসীন সিটি করপোরেশন ও সিডিএ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৫)
মির্জা ফখরুলের কাছে অভিযোগ, ১৬ দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁও থানার ওসি বদলি
মির্জা ফখরুলের কাছে অভিযোগ, ১৬ দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁও থানার ওসি বদলি
সর্বশেষসর্বাধিক