X
সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫
৮ বৈশাখ ১৪৩২

‘বৃষ্টি তুই বড় অপরাধীরে...’

রেজানুর রহমান
০৩ মে ২০২৪, ২১:৩৩আপডেট : ০৩ মে ২০২৪, ২২:১৬

আমরা অনেকেই নিতে অভ্যস্ত, কিন্তু দিতে অভ্যস্ত না। ‘গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান’ মুখে বলি কিন্তু অনেকেই নিজে করে দেখাই না। প্রত্যেকের উচিত বাড়ির আঙিনায় খোলা জায়গায় প্রতিবছর একটি হলেও গাছ লাগানো। বনজ, ফলদ, ঔষধি– তিন ধরনের গাছ যেমন পরিবেশ বাঁচায়, তেমনই দৈনন্দিন জীবনে বন্ধুর ভূমিকাও পালন করে।

অনেকে হয়তো অবাক হচ্ছেন, গাছ আবার বন্ধু হয় নাকি? হ্যাঁ, গাছ ভালো বন্ধু। এই দাবদাহের ভয়ংকর সময়ে সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বৃষ্টির দেখা নেই। প্রচণ্ড গরম। মাথার তালু পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ঘর থেকে বের হলেই আমরা গাছ খুঁজি। একটু ছায়া খুঁজি। গাছের ছায়ায় অনেক মায়া। মাথার তালু ঠান্ডা হয়ে যায়। এই গরমে বুঝতে বাকি নেই গাছ না থাকলে আমরা একদিন সূর্যের তাপে পুড়ে মারা যাবো। গত এক মাসে হিটস্ট্রোকে অসংখ্য মানুষ মারা গেছে। হিটস্ট্রোক কেন হয়? গরম থেকে বাঁচার পথ খুঁজে না পেয়ে মানুষ দিশেহারা হয়। তখনই হিটস্ট্রোক হয়। এই সময় অসংখ্য ডাল ছড়ানো একটি গাছ যে কত প্রয়োজন সেটা এখন আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমরা এই চরম সংকটেও কতটা সচেতন? নাকি ভাবছি কোনও মতে গরমকালটা পার হোক। তারপরই তো স্বস্তি। যারা এমনটা ভাবছেন তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন।

বাংলাদেশকে বলা হয় ষড়ঋতুর দেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। একটা সময় ছয় ঋতুরই সরব উপস্থিতি টের পাওয়া যেত। এখন শরৎ, হেমন্ত আর বসন্ত কখন আসে কখন যায় টের পাওয়া যায় না। শীতের অবস্থাও একই রকম। মন চাইলে বেড়াতে আসে। এসেই যাই যাই করে। বাকি থাকলো গ্রীষ্ম আর বর্ষা। বাংলাদেশে মূলত এই দুই ঋতুরই প্রভাব এখন বেশি। গরম শরীর পোড়ায়। আর বর্ষা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর দেশে দেশে পরিবেশ বিপর্যয় শুরু হয়েছে। খাঁ খাঁ মরুভূমির দেশে অতি বৃষ্টি রীতিমতো ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করছে। আর বৃষ্টির দেশে বৃষ্টি নেই। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কৌতুক প্রকাশের রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। একজন লিখেছেন, মরুর দেশে অতি বৃষ্টি। সবুজে ভরে যাবে ওরা।

আমরা মরুর দেশে পরিণত হবো। আমরা তেল পাবো, সোনা পাবো। আহ কী শান্তি! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই দেখলাম এক ব্যক্তি প্রচণ্ড গরমের কারণে মাটির মধ্যে ডিম ভাজি করার ঘটনা প্রদর্শন করছেন। মাটির তাপে স্টিলের তাওয়ায় রাখা তেল টগবগ করে ফুটছে। তাওয়ায় ডিমের তরল অংশ ছেড়ে দিতেই ‘ডিম পোচ’ হয়ে গেলো। গরমের ভয়াবহতা বোঝাতে এই ভিডিও নির্মাণ করা হয়েছে। ভিডিওটির অনেক ভিউ। ধারণা করাই যায় ভিউ বাড়ানোর মানসিকতাই এই ভিডিওর মূল উদ্দেশ্য। অথচ এই মুহূর্তে দরকার বেশি বেশি গাছ লাগানোর ভিডিও। কিন্তু গাছ লাগানোর ভিডিওর ভিউ কি বাড়বে? এটাই কোটি টাকার প্রশ্ন।

প্রতিদিনই দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেলে একই শিরোনাম হচ্ছে। গরমে পুড়ছে ঢাকা। ঢাকার তো গরমে পোড়ারই কথা। কংক্রিটের শহর এমনিতেই গনগনে আগুন হয়ে থাকে। তার ওপর সূর্যের তাপ। ঢাকা শহর যে এখনও টিকে আছে সেটাই বড় বিস্ময়। পরিবেশ বাঁচাতে একটি শহরের আয়তনের তুলনায় সবুজ অর্থাৎ গাছপালা থাকতে হয় শতকরা ২৫ ভাগ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ঢাকায় গাছপালা রয়েছে মাত্র ২ ভাগ। কাজেই গরমে বিপর্যয় ঘটবে এটাই তো স্বাভাবিক। ঢাকায় সবচেয়ে উষ্ণ এলাকা– মিরপুর, যাত্রাবাড়ি, নাখালপাড়া, কামরাঙ্গীরচর, গাবতলী, গোড়ান, টঙ্গী, শহীদ নগর, সায়েদাবাদ, আজমপুর, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, পোস্তগোলা, বাবুবাজারসহ আরও অনেক এলাকা। কারণ এসব এলাকায় সবুজ নাই। অর্থাৎ গাছ নেই। কম উষ্ণ এলাকা হলো– শাহবাগ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খিলক্ষেত, ডেমরাসহ আরও কিছু এলাকা। এসব এলাকায় সবুজ আছে। অর্থাৎ প্রচুর গাছ-গাছালি আছে। গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকা শহরে রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকার তাপমাত্রা অন্যান্য এলাকার চেয়ে কম থাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আশপাশের এলাকার চেয়ে তাপমাত্রা কম থাকে। একটাই কারণ সুবজায়ন। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়িয়ে পড়ায় কার্বন নিঃসরণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। ফলে পৃথিবীতে উষ্ণতা বাড়ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ কমানোই জরুরি পদক্ষেপ হওয়া উচিত। পাশাপাশি পৃথিবীকে সবুজে ভরিয়ে দেওয়াও জরুরি পদক্ষেপ হওয়া দরকার। অর্থাৎ বেশি বেশি গাছ লাগানো উচিত।

আমরা কতজন গাছ লাগাই? না লাগালেও গাছ কাটতে উৎসাহী মানুষের অভাব হয় না। বাবা গাছ লাগিয়েছেন। ছেলে গাছটি বিক্রি করে দিলেন। নিষ্ঠুর মানুষেরা গাছ কেটে নিয়ে গেলো। কিন্তু ছেলের তো একটি গাছ লাগানোর কথা। তিনি কি আদৌ গাছ লাগান? আমাদের সবার মাঝে সাধারণত একটি প্রবণতা কাজ করে। আমি ভোগ করবো। আমার এটা চাই ওটা চাই। কিন্তু আমি কাউকে কিছু দিতে রাজি না। বর্ষা মৌসুমে ইচ্ছে করলেই বাড়ির খালি জায়গায় গাছ লাগাতে পারি। ফলদ, বনজ, ঔষধি যেকোনও একটি গাছ। আজ হয়তো এই গাছটি কোনও কাজে আসবে না। কিন্তু ১৫/২০ বছর পর এই গাছটিই আপনাকে ফল দেবে, ছায়া দেবে। ঝড়ঝাপটা থেকে আপনাকে রক্ষা করবে। বাড়ির আশপাশে একটি নিম গাছ থাকলে ওই বাড়ির মানুষজনকে রোগবালাই সহজে কাবু করতে পারে না। এই কথা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু গুরুত্ব দেই কতজন? আমরা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছি। দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতোমধ্যে বৃষ্টি হয়েছে। স্বস্তি ফিরে এসেছে। ঢাকা শহরের কোথাও কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির সঙ্গে নতুন উপসর্গ বজ্রপাত শুরু হয়েছে। বজ্রপাতে ১১ জন মানুষ মারা গেছে। কাজেই বৃষ্টি স্বস্তি দিলেও পরিবেশগত শঙ্কা বেড়েছে। অতি বৃষ্টির জন্য ঢাকা শহর মোটেই তৈরি নয়। আর তাই এখন যেমন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছি, তেমনই আর বৃষ্টি চাই না এই প্রার্থনাও বোধকরি করতে হবে। কারণ একটু বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় আমাদের প্রাণের শহর ঢাকা।

আবহাওয়া পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে, বর্ষা মৌসুমে দেশে এবার বেশি বৃষ্টি হতে পারে। তাহলে তো আরও বিপদ। গরমে গাছ খুঁজি। বর্ষায় দিঘি, নালা, খাল-বিল খুঁজি। ঢাকা শহরে গাছ নাই। দিঘি, নালা, খাল-বিলও নাই। অথচ এই শহরে গাছ ছিল, জঙ্গল ছিল। দিঘি, নালা, খাল, বিল সবই ছিল। ঢাকা শহরের বুকে নৌকা চলতো। ধোলাইখাল নামটা এখনও আছে। কিন্তু খালের অস্তিত্ব নেই। মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পিছনে নৌকা দিয়ে পারাপার করতে হতো। সোনারগাঁও হোটেলের সামনে দাঁড়ালে কলাবাগান পর্যন্ত যতদূর চোখ যায় বিরাট খাল ছিল। থই থই পানি ছিল এই খালে। এখন কি কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে এসব কথা?

আমরা বিপদে পড়লে অনেক কথা ভাবি। গরমে গাছের কথা ভাবি। বর্ষায় খাল, বিল, নদী, নালার কথা ভাবি। তখন মনে হয় এই বুঝি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বিপদ কেটে গেলেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। যাক বাবা এ যাত্রায় তো বাঁচা গেলো। পরেরটা পরে দেখা যাবে। এই মানসিকতাই একদিন হয়তো আমাদের চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। বৃষ্টির দেখা মিলবে না। তখন হয়তো বৃষ্টিকেই অপরাধী ভাববো। অথচ বৃষ্টি তো অপরাধী নয়। অপরাধী আমরা মানুষেরা। এটা ভেবে আসুন সতর্ক হই। শুভকামনা সবার জন্য।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো। 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজধানীতে এক পশলা বৃষ্টি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বজ্রবৃষ্টির শঙ্কা
রাজধানীতে এক পশলা বৃষ্টি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বজ্রবৃষ্টির শঙ্কা
অবশেষে শুরুর জুটি ভাঙলেন নাহিদ
অবশেষে শুরুর জুটি ভাঙলেন নাহিদ
রসুনের দাম কেজিতে বেড়েছে ৬০ টাকা
রসুনের দাম কেজিতে বেড়েছে ৬০ টাকা
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরে তীব্র শ্বাসকষ্ট ও ত্বকের সমস্যা
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরে তীব্র শ্বাসকষ্ট ও ত্বকের সমস্যা
সর্বশেষসর্বাধিক