X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

আইনি কাঠামোতে ভাষার অস্তিত্ব

আশফাক সফল
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:০৫আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:০৫

ভাষার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক জাতীয়তার। ভালোবাসা কিংবা প্রতিবাদ– দুয়েরই হাতিয়ার ভাষা। ভাষা যেমন হাতিয়ার; তেমনি ভাষার জন্য হাতে উঠেছে হাতিয়ার বহু দেশে বহুবার। ভাষার অধিকারের জন্য সংগ্রাম যেমন যুক্তিবহ, আবার আইনও প্রয়োজনীয়। তবে তর্ক ওঠে ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে আইন কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বেশ কয়েকটি দেশ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা এবং প্রশাসনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভাষার সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে নিজ দেশের জাতীয় ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো সামনে নিয়ে এসেছে এক সমুদ্র পরিমাণ প্রশ্ন। আলোচনায় এসেছে ভাষার আইন (বা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করার আইন)-এর মূল উদ্দেশ্য কী? কোনও ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা নাকি কোনও ভূখণ্ডে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাষার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা। একই সঙ্গে প্রশ্ন এসেছে, এই ধরনের আইনের পিছনে চালিকাশক্তিগুলো কি প্রান্তিক সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ? এরূপ আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে কি ব্যক্তির স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয়?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিজেদের ভূমিতে নিজেদের ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে তৈরি করেছে নানা রকমের আইন ও নীতিমালা। যেসব দেশে একাধিক ভাষার ব্যাপক পরিসরে প্রচলন আছে, তাদের মধ্যে কোন ভাষা ব্যবহার হবে সেটা নির্ধারণের জন্য আইন প্রণয়ন করতে দেখা গেছে। যেমন, ১৯৬৬ সালে শ্রীলংকা দাফতরিক ভাষা নির্ধারণের জন্য The Official Languages Act নামে একটি আইন তৈরি করে। এই আইনের মাধ্যমে সিংহলি এবং তামিল উভয় ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাকে দাফতরিক কাজে সম্পূরক ভাষা হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।

অনেকেই ইংরেজি ভাষার প্রতি এই স্বীকৃতিকে উত্তর-ঔপনিবেশিক আচরণ হিসেবে দেখতে পারেন। এদিকে থেকে আরেক প্রতিবেশী দেশ ভারত আরও এক কাঠি সরেস। সংবিধানের মাধ্যমে দেবনাগরী লিপিতে লিখিত হিন্দি এবং ইংরেজিকে (২৬ জানুয়ারি ১৯৬৫ পর্যন্ত) দাফতরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে দ্য অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট, ১৯৬৩ অনুসারে হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজিকে অনির্দিষ্টকালের দাফতরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যদিও ভারতে কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই, তবে রাজ্যগুলো নিজেদের মতো তাদের দাফতরিক ভাষা নির্ধারণ করতে পারে। অন্যদিকে ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে, সংসদে আলাপ-আলোচনায় হিন্দি ভাষার ব্যবহার দেখা গেলেও আইন প্রণয়নে ইংরেজি ভাষা অনুসরণ করা হয়।

তবে কিছুটা ভিন্নচিত্র দেখা যায় রাশিয়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পরেও রাশিয়ায় সংবিধান এবং আইনের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে রুশ ভাষাকে একমাত্র দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে আর ২৬টি ভাষাকে আঞ্চলিক পর্যায়ে দাফতরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহারের অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পরে, রুশ সংস্কৃতি নানাভাবে তার প্রভাব ও ঐতিহ্য হারাতে থাকে। এরূপ পরিস্থিতিতে পুনরুত্থান (অথবা আধিপত্য বিস্তারের) অভিলাষে রুশ ভাষাকে “রাষ্ট্র গঠনকারী জাতীয়তার ভাষা” আখ্যা দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয় ২০২০ সালে।

ভাষার সঙ্গে যেমন সংস্কৃতি জড়িত; তেমনি সংস্কৃতির আগ্রাসনের সঙ্গে জড়িত অর্থনীতি (কেউ যদি বলেন অর্থনীতির আগ্রাসনে কোণঠাসা সংস্কৃতি; সেটিও সত্য)। ফলে পারস্পরিক এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির আগ্রাসনকে মেনে নিতেই হচ্ছে সবাইকে। বিষয়টিকে বিবেচনায় এনে ফ্রান্স প্রণয়ন করে “টুবন ল” নামে একটি আইন। এই আইনের মাধ্যমে ফ্রান্সে সব ধরনের সরকারি প্রজ্ঞাপন, ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক চুক্তিসহ বাণিজ্যিক কার্যক্রমে ফরাসি ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়।

অন্যদিকে শিল্প-সংস্কৃতির তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত ফ্রান্সে শিল্প ও কলার মান এবং অনুশীলনকে নিশ্চিত করতে ব্যক্তিগত, অ-বাণিজ্যিক যোগাযোগ, বই, চলচ্চিত্র, ইত্যাদিকে (যেগুলোর ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য মুখ্য নয়) আইনের পরিধির বাইরে রাখা হয়। তবে গান ও চলচ্চিত্রে প্রচারের ক্ষেত্রে (টেলিভিশন, রেডিও ইত্যাদিতে) ৩৫ শতাংশ ফরাসি ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। উল্লেখ্য, এই আইনের কারণে ইউরোপীয় কমিশনে সমালোচিত হয় ফ্রান্স। কমিশনের মতে, এই আইনের কারণে ফ্রান্সে ইউনিয়নের অন্য দেশগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে।

বিদেশের গল্প শেষে এবার চোখ দেওয়া যাক নিজেদের ঘরের দিকে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনি কাঠামো বেশ দৃঢ়। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জাতি এগিয়েছিল স্বাধিকার আর মুক্তিযুদ্ধের দিকে; তাদের আইনে ভাষার নিজের অধিকারের বর্ণনা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে (প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা)। এছাড়া রাষ্ট্রের ওপর ভাষা সংরক্ষণের দায়িত্বও অর্পণ করা হয় সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ২৩: রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।)। এছাড়াও ভাষার ক্ষমতায়নকে বিবেচনায় রেখে তিপ্পান্ন অনুচ্ছেদে বলা বলা আছে, সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। সর্বোপরি জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ভাষা এবং প্রচলিত সংস্কৃতিকে বিবেচনা করা হয় (ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।)

সংবিধানে ভাষার স্বীকৃতি, সংরক্ষণ ও প্রসারের বিষয়ে আলোকপাত করার মধ্য দিয়ে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের ওপর এক ধরনের নৈতিক বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ সালে “বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭” প্রণয়ন করা হয়। এই আইন অনুযায়ী সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ আদেশ, প্রজ্ঞাপন, চিঠি ও নথিসহ সবকিছুই বাংলা ভাষায় লিখবে। তবে, বিদেশে বা বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ছাড় দেওয়া হয়।

এছাড়া ২০১১ সালে মহামান্য হাইকোর্ট আরেকটি নির্দেশনা দেন, যেখানে বলা হয় দেশের সব সাইনবোর্ড, গাড়ির নম্বর প্লেট, বিলবোর্ড, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন ইত্যাদি বাংলায় লিখতে হবে। তবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও দূতাবাসের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়। তবে এসব আইনি কাঠামো পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়ার আগেই ১৯৭২ সালে সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় রায় লেখার আহ্বান জানান।

১৯৭৩ সালে সরকারি দাফতরিক কাজে বাংলা ব্যবহারের জন্য তদানীন্তন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সর্বক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার প্রচলন এবং বেতার ও দূরদর্শনে শুদ্ধ ব্যবহারের বিষয়ে ২০১২ সালে হাইকোর্টের রুলসহ নির্দেশনা রয়েছে। দুটি নির্দেশনাই এসেছে ফেব্রুয়ারিতে। একটি ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, অন্যটি চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি।

যেমনটা প্রতি বছর ভাষার মাসে মহামান্য হাইকোর্ট বাংলায় রায় দিয়ে থাকেন একাধিক মামলার। চলতি বছর ২০২৪ সালেও মহামান্য আদালত ভাষার মাসের প্রথম দিনেই একাধিক রায় দেন বাংলা ভাষায়। সেই সঙ্গে উল্লেখ না করলেই নয়, পৃষ্ঠার হিসাবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় রায় ছিল পিলখানা হত্যা মামলা, যার পৃষ্ঠা সংখ্যা সাড়ে ষোল হাজার। বিশাল কলেবরের এই রায় লেখা হয়েছিল বাংলায়। তারপরও মানতে হয়, উচ্চ আদালতে ইংরেজির ব্যবহার এখনও অনেক বেশি।

শেষ কথায় বলতেই হয়, সুস্পষ্ট এবং দৃঢ় আইনি কাঠামো আছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন করার; বিশেষ করে দাফতরিক ও আইনি কার্যকলাপে। বাংলার সহস্রাব্দ পুরনো ইতিহাসে আগে কখনও বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য এমন আইনি কাঠামো গঠিত হয়েছিল বলে জানা যায় না। কিন্তু হাজার বছর আগেও পাল এবং সেন সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান ভাষা ছিল বাংলা; এমনকি সুলতানি আমলে বাংলাকে সম্মান দেওয়া হয়েছিল অন্যতম রাজ্যভাষার। সেই সময়ের বাংলা ভাষায় মুদ্রিত রৌপ্যমুদ্রা পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। কিন্তু আধুনিক সমাজে এসে বাংলা ভাষার এবং তার প্রচলনের প্রতি অনাগ্রহ নিতান্তই দুঃখজনক।

লেখক: ব্লগার ও তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিরোপার সুবাস পেতে শুরু করেছে বায়ার্ন
শিরোপার সুবাস পেতে শুরু করেছে বায়ার্ন
প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার
প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার
বিশ্বায়নের পথে কোমর বেঁধে নেমেছে চীন
বিশ্বায়নের পথে কোমর বেঁধে নেমেছে চীন
চবির অপহৃত ৫ শিক্ষার্থীকে ফেরত পেতে রাস্তায় নামার হুঁশিয়ারি
চবির অপহৃত ৫ শিক্ষার্থীকে ফেরত পেতে রাস্তায় নামার হুঁশিয়ারি
সর্বশেষসর্বাধিক