X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২

একটি স্কুলব্যাগ, রাজনীতি ও দীর্ঘশ্বাস

রাজন ভট্টাচার্য
০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:১১আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:১১

কয়েক দিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগুনে পোড়া ট্রেনের কামরায় পড়ে থাকা একটি স্কুলব্যাগের ছবি রীতিমতো ভাইরাল। পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অক্ষত জামা-কাপড়। ছবিটি দেখলে যেকোনও মানুষের হৃৎপিণ্ড মোচড় দিয়ে ওঠার কথা। কারণ, স্বাভাবিকভাবে ট্রেনটি পোড়েনি। ঘটনা একেবারেই পরিকল্পিত। প্রথমে যাত্রীবাহী একটি ট্রেনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছারখার সবকিছু। সেই ঘটনার ধারাবাহিকতার অংশ এই স্কুলব্যাগ।

গত ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে ঢাকাগামী আন্তনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে এই নাশকতার ঘটনা ঘটে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি ভোরে কমলাপুরের ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছার কথা। রাত ১১টায় এই ট্রেন ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। পৌঁছানো পর্যন্ত বেশিরভাগ যাত্রী ঘুমে থাকেন। অর্থাৎ ঘুমন্ত যাত্রীদের ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এতে ট্রেনটির তিনটি কোচ পুড়ে যায়। এ ঘটনায় ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। মারা যাওয়াদের মধ্যে একটি শিশু, একজন নারী ও দুই জন পুরুষ। তিন বছরের সেই শিশুর নাম ইয়াসিন। মৃত অবস্থায়ও মা আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন আদরের সন্তানকে। এই ঘটনার কদিন আগেই লাইন কেটে রাখায় গাজীপুরে একই ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হয়। কোনও ঘটনার দায় রেল কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না।

সবচেয়ে নিরাপদ বাহন হিসেবে পরিচিত ট্রেনকে নাশকতার জন্য রাজনৈতিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়েছে। কেটে ও খুলে ফেলা হয়েছে  লাইন। সাম্প্রতিক সময়ে রেলপথ ঘিরে ৩০টির বেশি এমন ঘটনা ঘটেছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে পাঁচজোড়া ট্রেন ইতোমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।

মায়ের কোল হলো শিশুদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। সেখানেই তো ছিল ইয়াসিন। মা-তো তাকে রক্ষা করতে পারেননি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে হয়তো সন্তানের সঙ্গে নিজের জীবন দিয়ে মা প্রমাণ করে গেছেন, ভালোবাসার বন্ধন এমনই হয়। হয়তো অন্য যাত্রীদের মতোই মা নাদিরা আক্তার পপি বাঁচার চেষ্টা করতে পারতেন। তিনি তা করেননি। ইয়াসিনকে বাঁচানো সম্ভব নয় বলেই হয়তো তিনি সন্তানকে বুকে জড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। মা পপি সারা পৃথিবীকে জানিয়ে গেছেন, সমাজে বিচ্ছিন্ন কিছু অঘটন ঘটলেও মা আর সন্তানের সম্পর্ক এখন আগের মতোই।

পুড়ে কয়লা হওয়া ট্রেনে পাওয়া ছোট্ট এই স্কুলব্যাগটি কার? তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও ছবিটি গোটা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। হয়তো শিশু ইয়াসিনের বেগ এটি। আসছে জানুয়ারি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হবে। এরই প্রস্তুতি হিসেবে হয়তো স্কুলব্যাগ কেনা হয়েছিল। যে ব্যাগটি কোনোদিন আর স্কুলের শ্রেণিকক্ষে ঢুকবে না। অভিভাবকরা ব্যাগটি পেলে আজীবন সংরক্ষণ করে রাখবেন। এই স্মৃতি আমৃত্যু কাঁদাবে সবাইকে।

এমন তো কথা ছিল না। শিশুদের জন্য গোটা পৃথিবীজুড়ে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য জাতিসংঘসহ মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে সবার কণ্ঠ সোচ্চার, ঠিক তখন বাংলাদেশে এমন একটি বর্বরতার ঘটনায় বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হওয়ার মতো। অথচ শিশুটির তো কোনও অপরাধ নেই।

কেউ কি বলতে পারবেন তিন বছরের শিশু ইয়াসিনের কী দোষ? নিষ্পাপ শিশুটি কারও কোনও ক্ষতি করেছে? তার কি কোনও শত্রু ছিল? তাহলে কেন তাকে এভাবে প্রাণ দিতে হলো? এর উত্তর কে দেবে? তেমনি স্কুলব্যাগটি কেন এরকম ধ্বংসযজ্ঞে পড়েছিল?

কেন এই ঘটনা ঘটলো। কারাই বা এজন্য দায়ী? সবকিছু তো ঠিকঠাক চলছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গেলো ২৮ অক্টোবর থেকে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনীতি। শুরু হয় ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই। সাত জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো একদফা দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে আসছে। এখন আন্দোলনের নতুন গতিপথ হলো নির্বাচন ঠেকানো। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ার পর থেকেই এ ধরনের সহিংসতা শুরু। তার মানে তো এই নয় যাত্রীবাহী যানে আগুন দিতে হবে। লাইন তুলে নিয়ে যাত্রীদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া জরুরি। ধর্মেও তো এ ধরনের অপকর্ম নিষেধ। তাহলে এ কেমন রাজনীতি? পৃথিবীর কোন সভ্য সমাজে এ ধরনের নিকৃষ্ট বর্বরতার নজির না থাকারই কথা।

গেলো ৫২ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এরকম নিষ্ঠুর রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদাহরণ খুব একটা নেই। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে মানুষ হত্যার করে বিজয় অর্জন করতে হবে, এটা কেউ সমর্থন করে না। ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের গায়ে ধর্মের কালিমা লেপে দিয়ে দেশে ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান শুরু। এরই ধারাবাহিকতায় মৌলবাদ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা থেকে শুরু করে আইনের শাসনের অভাবে সামাজিক অপরাধের প্রবণতা বাড়তে থাকে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর এসব কিছুই নতুন মাত্রা পায়। তখন থেকেই গণপরিবহনে আগুন ও মানুষ হত্যা করে রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের পর্ব শুরু।  

রাজনীতি তো মানুষের কল্যাণের জন্য। মানুষ হত্যা করে, সবকিছু অচল করে দিয়ে দেশের কতটুকু কল্যাণ নিশ্চিত হবে সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে মানুষ হত্যা ঘটনা একটি দেশ ও জাতির জন্য কত বড় কলঙ্কের বোঝা তা বলে বোঝানো যাবে না। নির্বাচন ঠেকানো বা ক্ষমতায় যেতে এমন ভয়ংকর খবর দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না। গণমাধ্যমের কল্যাণে তা মুহূর্তের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়। তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশ ও রাজনীতির ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় এ ভাবনা কি কারও আছে? যেখানে মানুষ ও মানবতা বিপন্ন, নাশকতায় প্রাণ বিপন্ন হয়, সেখানে আর যাই হোক শান্তি নেই, সুশাসনও প্রশ্নবিদ্ধ। এমন দেশ ও রাজনীতিকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া ছাড়া বিশ্ব সম্প্রদায়ের থেকে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে। এমন দেশের মানুষ তো পৃথিবীর উন্নত ও শান্তির কোনও দেশে জায়গা পাওয়ার কথা নয়। এরকম চলতে থাকলে একদিন বাংলাদেশকে শান্তির দেশ খ্যাত আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, পর্তুগালসহ অনেক রাষ্ট্র ঘৃণার চোখে দেখবে।

এটা না হয় বাদই দিলাম। মানুষের মনুষ্যত্ব, বিবেক বলে কিছু নেই? নাকি রাজনীতির কাছে সবই তুচ্ছ। তাই বলে কি জীবনও? আগুন দেওয়ার আগে কারও হাত কাঁপেনি। ভূত এসে তো ট্রেন লাইন কাটেনি। ঘুমন্ত যাত্রীদের জ্বালিয়ে দেয়নি। অপকর্মটি মানুষের। সবচেয়ে নিকৃষ্টতম এমন ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার ইচ্ছাকে ধিক্কার জানানো ছাড়া আর কোনও উপায় আছে? দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সবাইকে সমস্বরে বলার সময় এসেছে, এমন রাজনীতি চাই না, চাই না, চাই না। স্বস্তি চাই। যে রাজনীতির কারণে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে মাকেও জীবন দিতে হয়।

একটা নতুন শিশুর যদি নিরাপদে বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তা দিতে না পারি তবে কেন এ দেশে শিশু জন্ম নেবে? এটা প্যালেস্টাইন না বা যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনও দেশ নয়, যেখানে প্রতিনিয়ত শিশুরা মারা পড়বে। এটা তো মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো এমন ছিল না। তাহলে কোন চেতনার রাজনীতি চলছে?

এবারেই এমন ঘটনা ঘটেছে তা নয়। ২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও দেশজুড়ে পেট্রোলবোমার ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। হয়তো আগামী নির্বাচনগুলোতেও সহিংসতার ভয়াবহতা আরও বেশি হবে। নতুন নতুন কৌশলে নাশকতার মধ্য দিয়ে কেড়ে নেওয়া হবে মানুষের প্রাণ। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য এর সঠিক সমাধান রাজনৈতিক নেতাদেরই বের করতে হবে। তা না হলে রাজনীতিকে দেশের মানুষ যেমন ঘৃণা করবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এতে আকৃষ্ট হবে না। সবাই মুখ ফিরিয়ে নেবে। ফলে নষ্টদের দখলে যাবে সবকিছু। তেমনি বিশ্বপরিমণ্ডলে দেশের রাজনীতি ও মানুষকে ঘৃণার চোখে দেখা হবে। তাই জীবন নিয়ে খেলা নয়, রাজনীতির জয়-পরাজয় হোক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

 
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ইস্টার যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণার পরও রুশ হামলা চলছে: জেলেনস্কি
‘ইস্টার যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণার পরও রুশ হামলা চলছে: জেলেনস্কি
চাঁদপুরে ভিমরুলের কামড়ে একজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩
চাঁদপুরে ভিমরুলের কামড়ে একজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩
সারা দেশে বৃষ্টির আভাস
সারা দেশে বৃষ্টির আভাস
সারা দেশে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের মহাসমাবেশ আজ
সারা দেশে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের মহাসমাবেশ আজ
সর্বশেষসর্বাধিক