আজ থেকে দেড় যুগ আগে, শহরের শিশুদের ভিডিও গেমস খেলার হার বেশি ছিল। নিরাপত্তা এবং খেলাধুলার সুযোগ না থাকায় অভিভাবকরা শিশুকে ঘরের বাইরে যেতে দিতেন না। শিশুরা বাধ্য হয়েই ঘরের ভেতরে কম্পিউটারে ভিডিও গেমস খেলতো। তাও সব শিশুর পক্ষে ভিডিও গেমস খেলা সম্ভব ছিল না। কারণ, কম্পিউটার কেনা অনেক পরিবারের সাধ্যের বাইরে ছিল। আর গ্রামে হাতে গোনা কিছু সচ্ছল পরিবারের শিশুর পক্ষেই খেলা সম্ভব ছিল। এছাড়াও ভিডিও গেমের সন্ধান পাওয়া খুব সহজ ছিল না। বহু কসরত করে বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতজন থেকে জোগাড় করে খেলতে হতো।
এখন বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে ভিডিও গেমস এখন হাতের নাগালে। শহর কিংবা গ্রাম- কোনও তফাৎ নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রামের পরিস্থিতি বেশি ভয়াবহ। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখার আগেই প্রযুক্তি এখন হাতে মুঠোয়। এর ফলে কী ক্ষতি হচ্ছে, সেটা আর ভেঙে বলার দরকার নেই। খোলা মাঠ, পুকুরঘাট, শ্রেণিকক্ষ, চা-দোকান, বসার জায়গা– যেখানেই তাকান না কেন, দেখবেন এক বা একাধিক শিশু দলবেঁধে ভিডিও গেমস খেলছে। অথবা সোশাল মিডিয়া ও আজেবাজে সাইটে বুঁদ হয়ে আছে।
স্মার্টফোনের ডিসপ্লে এখন অনেক উন্নত, পাশাপাশি ভিডিও গেমসগুলোর দৃশ্যও অনেক বেশি প্রাণবন্ত। যার ফলে গেমস থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়া শিশুদের পক্ষে খুব কঠিন। কোমলমতি শিশুরা বেশিরভাগ সময়ই বাস্তব ঘটনা ও এসব দৃশ্যের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। এসব দৃশ্যকেই তারা স্বাভাবিক মনে করে। মনের গহিনে গড়ে ওঠে আরেকটি জগৎ, যা থেকে তারা আর বের হতে পারে না। যার ফলে শিশু বারবার ভিডিও গেমস খেলতে চায়। শিশুকে বুঁদ করে রাখে গেমের নেশা। সহজভাবে বললে এটাই ভিডিও গেমস আসক্তি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেস বা আইসিডি ভিডিও গেমের নেশাকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আইসিডি এমন একটি গাইড যেখানে বিভিন্ন রোগের লক্ষণ, উপসর্গ ও কোড লিপিবদ্ধ থাকে। আইসিডি ভিডিও গেমের এই নেশাকে ‘গেমিং ডিজঅর্ডার’ নামে অভিহিত করেছেন। এই আসক্তি ফলে শিশু নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, স্বাভাবিক কাজকর্ম বাদ দিয়ে ভিডিও গেমস খেলাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়।
এবার জেনে নেওয়া যাক এই আসক্তি শিশুদের কীভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, ভিডিও গেমসের দৃশ্যগুলো খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়, যা শিশুর বিকাশমান মস্তিষ্কে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বাস্তবে খালি চোখে দৃশ্যমান কোনও ঘটনার গতির তুলনায় ভিডিও গেমসের গতি অনেক বেশি। যার প্রভাব পড়ে মস্তিষ্কের নিউরো ট্রান্সমিটারের ওপরে। এ ধরনের হাইস্পিড ট্রান্সমিশন শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কর্মকাঠামো পাল্টে দেয়। ভিডিও গেমসের মতো হাইস্পিড ট্রান্সমিশনে বেশিক্ষণ সময় কাটানোর ফলে শিশুরা এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠে। ডিজিটাল গতির সঙ্গে শিশু এতটাই অভ্যস্ত হয় যে বাস্তবের স্বাভাবিক গতিতে সে আর তাল মেলাতে পারে না। এর ফলে শিশু এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না, অস্থির ও চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে ওঠে।
যার প্রভাব পড়ে শিশুর পড়াশোনায়। বইয়ের অক্ষরগুলো স্থির। ডিজিটাল গতিতে অভ্যস্ত শিশু, পড়ার সময় কয়েকটি অক্ষর বা শব্দ মনের অজান্তেই ডিঙিয়ে চলে যায়। হাত ও চোখের মণির সমন্বয় পাল্টে যাওয়ার কারণে ঠিকভাবে লিখতে পারে না। বাস্তব জীবনেও সে খুব অস্থির, সবকিছু তৎক্ষণাৎ পেতে চায়। কারণ, মস্তিষ্কের কর্মকাঠামো এমনভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, কিছু সময়ের জন্যও সে অপেক্ষা করতে পারছে না। যার চূড়ান্ত প্রভাব পড়ছে শিশুর শিক্ষাজীবন ও ভবিষ্যৎ পেশা জীবনের ওপরে।
পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু কিশোরদের গেম আসক্তির সঙ্গে অটিজম, মনোযোগ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, ঘুমের ব্যাঘাত, হতাশা ও তীব্র বিষণ্নতাসহ নানা ধরনের মনোদৈহিক জটিলতার সম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ক্রমাগত কাছের জিনিস দেখার কারণে একসময় দূরের জিনিস ঠিকমতো দেখতে পায় না। শরীরকে খুব বেশি নড়াচড়া করতে হয় না বলে শিশুদের মধ্যে স্থূলতা সমস্যা দেখা দিচ্ছে, হাড় ও পেশির গঠন মজবুত হচ্ছে না। অর্থাৎ শিশুদের স্বাভাবিক মনোদৈহিক বিকাশ বিঘ্নিত হচ্ছে।
এছাড়াও প্রতিনিয়ত একাকী সময় কাটানোর ফলে, গেম আসক্ত শিশুরা সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠছে। সামাজিক বিকাশ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে কারও সঙ্গে ঠিকমতো মিশতে পারছে না, মানুষের চেহারায় ফুটে ওঠা আবেগ অনুভূতি ধরতে পারছে না, এমনকি কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছে না। যোগাযোগ দক্ষতায় ঘাটতির কারণে এই শিশুরা অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে খুব দুর্বল হয়।
বেশিরভাগ ভিডিও গেমসের কন্টেন্টের মূল বিষয় হচ্ছে সহিংসতা। কীভাবে মানুষ মেরে একটি অঞ্চলকে দখল করতে হবে? কীভাবে প্রতিপক্ষকে গুলি করে বা বোমা মেরে নিঃশেষ করতে হবে? কীভাবে শত্রুপক্ষের ওপর নৃশংসতা চালাতে হবে, ইত্যাদি। ক্রমাগত সহিংসতা বা মারামারির দৃশ্য দেখতে দেখতে শিশুরা এটাকেই স্বাভাবিক মনে করতে শুরু করে। ভার্চুয়াল জগতে মানুষ হত্যা করতে করতে তাদের মানবিক গুণটি আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যায়। তার সঙ্গে যদি হতাশা, মানসিক সমস্যাসহ অন্য কোনও সমস্যা যুক্ত হয়, তা ভয়াবহ বিপর্যয় ঢেকে আনতে পারে।
খোদ আমেরিকাতেই কিছু দিন পর পর বিকৃত মস্তিষ্কের বন্দুকধারীদের আক্রমণের খবর শুনতে পাওয়া যায়। ঘটনা মোটামুটি একই রকম- একজন ছাত্র বা ব্যক্তি অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে স্কুলে ঢুকে বহু ছাত্রকে হত্যা করেছে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আমেরিকাতে এত বেশি ঘটছে যে আমেরিকার জনগণের কাছে বিষয়গুলো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য অনেকেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সহজলভ্যতা এবং সহিংস ভিডিও গেমসের দিকে আঙুল তুলেছেন। যদিও এগুলোই একমাত্র কারণ নয়।
আপনি বলতে পারেন– পরিবারে মা-বাবার মধ্যে দাম্পত্য কলহ, মাদকের সহজলভ্যতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, নৈতিক শিক্ষার অভাব, হতাশা, বিষণ্নতা ইত্যাদি বিষয়ও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এসব হত্যাকাণ্ডের কারণ। আপনার যুক্তির সঙ্গে আমিও একমত। তবে এটাও ঠিক এসব সমস্যার সঙ্গে যদি সহিংস ভিডিও গেমসের বিষয়টি যোগ হয়, তখন শিশুর মনে হত্যাকাণ্ডের ভাবনা আরও বেশি জাগ্রত হবে।
এছাড়াও বেশিরভাগ ভিডিও গেমস এমন সব কন্টেন্ট থাকে, যা শিশুকে আস্তে আস্তে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়। ভিডিও গেমসে বিদ্যমান কন্টেন্টের বেশিরভাগই হচ্ছে সহিংসতা, রক্তাক্ত হামলা, ধ্বংসলীলা, হত্যা, চুরি, যৌনতা, প্রতারণা ও অমানবিকতা। এসব জিনিস দেখতে দেখতে শিশুরা নীরবে অন্যায় ও অপরাধ কর্মে উৎসাহিত হচ্ছে। আরেকজনকে আঘাত করা যে অন্যায়, অন্যের জিনিস ছিনিয়ে নেওয়া যে অপরাধ- এই মানবিক মূল্যবোধগুলো শিশু বুঝতে শিখে না। যার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়।
ব্লু-হোয়েল গেমের কথা আমরা সবাই জনাই। এই গেমসটিকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে কম বয়সী শিশুদের পক্ষে এটা ছেড়ে দেওয়া খুব কঠিন। এটি এমন এক মরণব্যাধি গেমস, যা আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে নিয়ে। এই গেম খেলতে খেলতে শিশু-কিশোরের আত্মহননের নজির ভূরি ভূরি। পাবজি গেমের কন্টেন্ট-এ সহিংসতা, অস্থিরতা ও যৌনতার বিষয়গুলো মাত্রাতিরিক্ত। এই গেমটি এতটাই ক্ষতিকর যে পৃথিবীর অনেক দেশে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তারপর কেন সেই নিষেধাজ্ঞা আবার শিথিল হলো, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। এরকম আরও অসংখ্য গেমস রয়েছে, যা শিশুদের আসক্তির পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের অভিভাবক ও সরকার এই বিষয়গুলোতে এখনও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেনি।
যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশ ভিডিও গেম আসক্তিকে অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আমাদের দেশে যেমন মাদকাসক্তি নিরাময়ের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে গেম আসক্তি নিরাময়ের জন্য প্রাইভেট এডিকশ ক্লিনিক বা পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। আমাদের শিশুরা যে হারে এই আসক্তিতে আক্রান্ত হচ্ছে, কিছু দিনের মধ্যে আমাদের দেশেও এ ধরনের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রয়োজন হবে।
এছাড়াও প্রচলিত সহিংস গেমসগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। সিনেমার মতো এখানেও সেন্সরশিপ দেওয়া প্রয়োজন। তিন ঘণ্টার সিনেমার জন্য যদি সেন্সরশিপ দেওয়ার বিধান থাকে, তাহলে যে গেমসগুলো আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে সেখানে সেন্সরশিপ নয় কেন? এটাও সত্য শুধু সেন্সরশিপ দিয়ে এই আসক্তি দূর করা যাবে না। বিকল্প জিনিসও ভাবতে হবে। আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভালো গেমস তৈরিতে সরকারের পক্ষ থেকেও আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে।
সবচেয়ে আগে যে কাজটি প্রয়োজন, তা হলো শিশু কিশোরসহ সাধারণ মানুষের কাছে ভিডিও গেমসের নেতিবাচক ক্ষতিকর দিকগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। অর্থাৎ বিপুল জনগোষ্ঠীকে যদি এর কুফল সম্পর্কে সচেতন করা যায়, তাহলে এই সমস্যাকে লাগাম দেওয়া সম্ভব হবে।
আমাদের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং নীতিনির্ধারকরা যদি পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য আশু পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কী বিপর্যয় অপেক্ষা করছে তা সহজেই অনুমেয়।
লেখক: প্যারেন্টিং গবেষক
ইমেইল- [email protected]
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।