X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২

আমাদের শিশুরা কি পৃথিবীর উপযোগী হয়ে বেড়ে উঠছে?

শ্যামল আতিক
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:৪২আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:৪২

সামান্য ব্যর্থতায় ভেঙে পড়া বা হতাশ হয়ে যাওয়া, কিছু না পেলে নিজেকে দুঃখী মনে করা, খুব অল্পতেই মেজাজ হারানো– এই কথাগুলো ইদানীং খুব বেশি শুনতে পাই। পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখতে পাই– কত তুচ্ছ কারণে আমাদের সন্তানরা আত্মহত্যা করছে। শিক্ষক বা অভিভাবক বকা দিয়েছে, পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে, বাবা স্মার্ট ফোন কিনে দেয়নি, প্রেমে ব্যর্থতা- ইত্যাদি আরও কত কারণ।

শারীরিক ফিটনেসেও নাজুক অবস্থা। রোদে বের হলে অসুস্থ হয়ে পড়ে, সামান্য বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর ওঠে, ধুলাবালির সংস্পর্শে এলে এলার্জির সমস্যা বেড়ে যায়, নির্দিষ্ট মেন্যুর বাইরের খাবার খেলে হজমে সমস্যা অথবা ডায়রিয়া হয়, যানবাহন ছাড়া সামান্য দূরত্ব হেঁটে যেতে পারে না, লিফট ছাড়া সিঁড়িতে উঠতে পারে না, এসি ছাড়া রাতে ঘুমাতে পারেন না, সামান্য গরম পড়লে অসুস্থ হয়ে যায়– এই বিষয়গুলো প্রতিনিয়ত অভিভাবকদের মুখে শুনছি। অথচ বস্তি অথবা রাস্তায় যে শিশুরা বেড়ে উঠছে তাদের মধ্যে এই সমস্যাগুলো নেই।

কেন আমাদের শিশুরা এত নাজুক হয়ে বেড়ে উঠছে? এর জন্য আমরা অভিভাবকরাই দায়ী। শিশুকে অতিমাত্রায় যত্ন অথবা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়েই এই সমস্যাগুলো আমরা তৈরি করছি। অর্থাৎ শিশুকে আমরা বাহ্যিক সবকিছু দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু পৃথিবীর উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারছি না।  

একটা সময় ছিল যখন “স্মার্ট কিড, হ্যাপি কিড, ট্যালেন্ট কিড– এই শব্দগুলো খুব বেশি উচ্চারিত হতো। বর্তমানে বাস্তবতা ভিন্ন। এখন বলা হচ্ছে– রেসিলিয়েন্ট কিডস অর্থাৎ প্রতিকূলতা সহনশীল শিশু। যে শিশুরা প্রতিকূলতায় টিকে থাকতে পারে এবং বিপর্যয় কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে তারাই Resilient Children.

এই দক্ষতা শিশুর মধ্যে এমনি এমনি আসে না। যে শিশু নানা রকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়, সমস্যা সমাধান করার সুযোগ পায় এবং চারপাশের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে পারে– তারাই এই দক্ষতাটি অর্জন করতে পারে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা রাতারাতি অর্জন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বয়স কোনও বিষয় নয়। তবে শৈশবে যদি শিশুকে এভাবে তৈরি করা যায়, তাহলে শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি সেভাবেই তৈরি হয়।

শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের প্রথম ধাপ হলো প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে দেওয়া। শিশু যত বেশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসবে, তার অভিযোজন ক্ষমতা তত সমৃদ্ধ হবে। শিশুকে মাটিতে খালি পায়ে হাঁটতে দেওয়া, সবুজ ঘাসের ওপর খেলাধুলা করা, মাঝে মধ্যে কাদায় নামার সুযোগ করে দেওয়া, বালি নিয়ে খেলাধুলা করা ইত্যাদি এখন স্বীকৃত বিষয়। আসলে কাদা, বালি, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাংগাসের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেই শিশুর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়।

স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলে (বিশেষ করে নেদারল্যান্ডে) বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যেও শিশুরা বাইরে খেলাধুলা করে। ঠান্ডা, গরম, বৃষ্টি যাহোক না কেন, শারীরিক সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য অভিভাবকরা এই সুযোগটি করে দেন। জাপানের অনেক স্কুলে শিশুদের শীতকালে জামা খুলে রোদের মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়। সহ্য ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যই এই কাজটি করা হয়। প্রথম দিকে নাকে-মুখে পানি এবং ঠান্ডা জ্বরে নাস্তানাবুদ হলেও আস্তে আস্তে সবাই অভ্যস্ত হয়ে যায়।

আমাদের শিশুদের জন্যও অনেক কিছু করতে পারি। শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে খোলা মাঠে ছেড়ে দিতে হবে। দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি, ধস্তাধস্তি– যাই করুক না কেন তাকে স্বাধীনভাবে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলতে দিন। সে নিজেকে সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখবে। ছোট ছোট ঝুঁকি নেওয়ার মাধ্যমে নিজেকে বড় চ্যালেঞ্জের জন্যে প্রস্তুত করবে। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, শুধু এমন ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করবেন, নতুবা নয়।

হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে, উদ্ধারের জন্যে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। খুব বেশি ব্যথা না পেলে, তাকে নিজে নিজে উঠতে দিন। জীবনযুদ্ধে বিপর্যয় এলে কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে নতুন করে পথচলা শুরু করতে হয়– এই আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে জাগ্রত হবে। ভবিষ্যতে উঠে দাঁড়ানোর সময় সে কারও জন্যে অপেক্ষা করবে না।

প্রশিক্ষণ হিসেবে আরও কিছু কাজ করা যেতে পারে। সবসময় প্রাচুর্যের মধ্যে না রেখে মাঝে মাঝে অভাব মোকাবিলা করার সুযোগ করে দিন। পাঁচ বছর বয়সের পর শিশুকে মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য উপবাস করতে উদ্বুদ্ধ করবেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে এই কাজটি করতে পারলে খুব ভালো। এর মধ্য দিয়ে শিশু ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে শিখবে। তবে শিশু যদি নিজ থেকে এই চর্চা না করতে চায় তাহলে তা কোনোভাবেই জোর করা যাবে না। বুঝিয়ে করাতে পারলে ভালো, তা না হলে দরকার নেই।

ছোটখাটো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুকে ধৈর্যশীল করে গড়ে তোলা সম্ভব। এক বছরের বড় শিশু যদি খাওয়ার জন্যে কান্নাকাটি করে, তাকে তৎক্ষণাৎ খাবার না দিয়ে কিছুক্ষণ পরে দিন। এই সময়টায় শিশুকে গান শুনিয়ে, জানালা দিয়ে বাইরের কোনও কিছু দেখিয়ে, আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে, অথবা সামান্য দোলনীর মাধ্যমে আদর করে– মনোযোগ সরানো যেতে পারে।

আবার শিশুকে নিয়ে কোথাও হাঁটতে বেরিয়েছেন। মাঝপথে সে আপনার কোলে ওঠার বায়না ধরলো। তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলুন, কিছুক্ষণ পর কোলে তুলুন। এভাবে শিশুর প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান না করেও ধৈর্যশীলতার প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়।

শিশু বায়না ধরলে সঙ্গে সঙ্গে তার চাহিদা পূরণ করতে যাবেন না। প্রথমেই বোঝার চেষ্টা করুন- এটা কী তার প্রয়োজন, নাকি স্রেফ চাওয়া? চাহিদা যুক্তিসঙ্গত হলে, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে তা পূরণ করতে পারেন। তবে চাহিদা যদি স্রেফ চাওয়া হয়, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা পূরণ করবেন না। যেমন ধরুন, আপনার শিশু দুপুরের খাওয়ার জন্যে কান্না করছে, তার এই চাহিদার প্রতি অবশ্যই আপনাকে সম্মান জানাতে হবে। কিন্তু দুপুর বেলায় সে যদি আইসক্রিম খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে, এক্ষেত্রে সবসময় তার চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকে না বলবেন।

শিশুকে মাঝে মাঝে পরাজয়ের অভিজ্ঞতাও দিতে হবে। এক্ষেত্রে অনেক অভিভাবকই ভুল করেন। শিশুর সঙ্গে খেলা করার সময় তাকে সবসময়ই জিতিয়ে দেন। এই শিশুরা বড় হয়ে ছোটখাটো ব্যর্থতাকেও মেনে নিতে পারেন না, সামান্য পরাজয়ে ভেঙে পড়েন। কারণ, জয়-পরাজয় যে জীবনের অংশ– এই শিক্ষা শিশুকে দেওয়া হয়নি।

অনেক অভিভাবক আছেন যারা শিশুকে সমস্যা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন অথবা তারা নিজেরা সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আমরাই শিশুদের শেখাই কিছু সমস্যা সমাধান করা কঠিন। এর ফলে শিশুরা এভাবেই ভাবতে শিখে। আসলে সমস্যাহীন পৃথিবী নিশ্চিত করা অভিভাবকদের কাজ নয়। অভিভাবকদের কাজ হলো– শিশু যেন যেকোনও সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে সেভাবে গড়ে তোলা। তাই সমস্যাকে এড়িয়ে যেতে শেখাবেন না এবং সব সমস্যার সমাধান আপনি করতে যাবেন না। বয়স অনুযায়ী কিছু সমস্যা শিশুকে মোকাবিলা করতে দিন।

বর্তমানে আমরা এমন একটি সময়ে বসবাস করছি যেখানে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ-বিগ্রহ-সহিংসতা, অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পারিবারিক টানাপোড়েন, রোগ-ব্যাধি-মহামারি ইত্যাদি এ সময়ের বাস্তবতা। রাতারাতি এসব সমস্যার সমাধান হবে– এই আশা করাও বোকামি। এগুলোকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। তাই শিশুকে এমনভাবে লালন (দক্ষ) করতে হবে যেন সে যেকোনও ব্যর্থতা বা বিপর্যয়কে সামাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এটাই হোক আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি।  

লেখক: প্যারেন্টিং গবেষক

ইমেইল- [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নেপাল ও বাংলাদেশ কাবাডি টেস্ট সিরিজের ট্রফি উন্মোচন
নেপাল ও বাংলাদেশ কাবাডি টেস্ট সিরিজের ট্রফি উন্মোচন
হাতিরঝিলে যুবদলের কর্মীকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার
হাতিরঝিলে যুবদলের কর্মীকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার
‘ইস্টার যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণার পরও রুশ হামলা চলছে: জেলেনস্কি
‘ইস্টার যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণার পরও রুশ হামলা চলছে: জেলেনস্কি
চাঁদপুরে ভিমরুলের কামড়ে একজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩
চাঁদপুরে ভিমরুলের কামড়ে একজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩
সর্বশেষসর্বাধিক