X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

হুকার হুংকার এবং সাধারণ মানুষের চাওয়া

আনিস আলমগীর
১৯ অক্টোবর ২০২২, ০০:০২আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২২, ০০:০৮

যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর  ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর। তার চার মাসের মাথায় বিএনপি তার ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের (হুকা) চৌধুরীকে ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ তাদের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করে। হুকা তার বাবার রায়ের আগেই মিডিয়ায় পরিচিত হয়ে ওঠেন, বিচারকের কম্পিউটার অপারেটরকে হাত করে রায়ের খসড়া বের করে জনগণকে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ধোকা দিতে গিয়ে।

তারপর অনেকদিন নিরুদ্দেশ ছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা ছিল যে তাকে গুম করা হয়েছে, মুচলেকা দিয়ে বিদেশে চলে গেছেন- এসব। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে হুকা গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে উদিত হয়েছেন বিএনপির বিভাগীয় জনসভায়।

হুকাকে যখন বিএনপি তাদের ‘টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া’ পর্যন্ত দীর্ঘ কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য করলো, টিভি টকশোতে বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতাকে প্রশ্ন করেছিলাম- বিএনপি একদিকে ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে বলছে অন্যদিকে সাকা এবং আরেক যুদ্ধাপরাধী বিএনপির নেতা আবদুল আলীমের ছেলেকে কেন্দ্রীয় নেতা বানিয়ে জাতিকে কী বার্তা দিতে চায়? তিনি অপ্রস্তুত হয়ে কিছু আগডুম বাগডুম বকে সঞ্চালক হিসেবে আমার নিরপেক্ষতার অভিযোগ করেন।

সেই ভিডিওর খণ্ডিত অংশ এডিট করে কিছু লোক তা ভাইরাল করে। যারা করে তারা ছিল যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক নতুন প্রজন্ম। এরাই এখন চট্টগ্রামে বিএনপির জনসভায় হুকা চৌধুরীর দেওয়া সাম্প্রতিক ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগান নিয়ে মিডিয়া প্রশ্ন তুললে তার পক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছে। এদের মুখের ভাষাও হুকার দাদা-বাবার মতোই। ভাবখানা যেন, বাংলাদেশে আল্লাহর নামে তাকবির দেওয়ার মানুষের অভাব পড়েছিল, হুকা এসে ইসলাম উদ্ধার করেছে। অথচ প্রতিদিনই লক্ষ কোটি নামাজীর মুখে মুখে, মসজিদে, ওয়াজ মাহফিলে, ধর্মীয় সব সমাবেশে ‘আল্লাহু আকবর’ তাকবির ধ্বনিত হচ্ছে।

হুকা তার দাদা ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরী এবং তার বাবা সাকা চৌধুরীর মতো ধর্মীয় কার্ড খেলে মানুষকে বোকা বানাতে চেয়েছেন। সেজন্যেই তিনি বক্তৃতার শুরু এবং শেষে নারায়ে তাকবির ধ্বনী দিয়ে ক্ষান্ত হননি শুধু, এটিকে তার বাবার স্লোগান দাবি করেন। তার হয়তো জানা নেই নারায়ে তাকবির এই অঞ্চলের মুসলমানরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ব্যবহার করেছে নিজস্ব স্লোগান হিসেবে। ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের সম্প্রদায়গত আইডেন্টিটি ছিল এই স্লোগান।

১৯৪৭ এর দেশভাগের সময়ও এটি মুসলিম সাম্প্রদায়ের স্লোগান হিসেবে জনপ্রিয় ছিল। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলেও এটি ব্যবহৃত হয়েছে তবে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো এই স্লোগানের ব্যবহার তখন কমিয়ে দেয়। ক্রমশ এটি ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর এবং বিভিন্ন ইসলামি মাহফিলের স্লোগানে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে এর অপব্যবহার এটিকে সম্পূর্ণ ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের স্লোগানে পরিণত করে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো এটিকে ত্যাগ করে। এমনকি আজকের দিনের জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামি ভাবধারার দল বিএনপিও বলছে, এটা দলীয় তাকবির নয়, যে দিয়েছে তার নিজস্ব ব্যাপার।

ওই বক্তৃতায় সাকাপুত্র তার বাবাকে ‘শহীদ’ বলেছে। সাকা যুদ্ধাপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত ঘৃণিত কুলাঙ্গার। ৭১ সালের হিংস্র খুনি থেকে অশ্লীল রাজনীতিবিদ, যে আমার চাচা মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীকেও ১৩ আগস্ট ১৯৭১ সালে ধরে নিয়ে ফকা চৌধুরীর হাতে তুলে দিয়েছিল হত্যার জন্য। ফকা-সাকা ও মিলিশিয়ারের ‘কনসেনট্রেইশন ক্যাম্প’ ছিল তাদের বাড়ি এই গুডস হিল। তাকে শহীদ বলা মানে শহীদদের অপমান করা। শহীদ শব্দের অপব্যবহার।

অশ্লীল বক্তব্য ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করে ঘরে-বাইরে আলোচিত সাকার মতো যদি তারপুত্র হুকাও রাজনীতি করতে চান, তাহলে তার কপালে শনি আছে। হুকা তরুণ রাজনীতিবিদ। তার রাজনীতি করার অধিকার রাষ্ট্র নিষিদ্ধ করেনি। আমি তাকে তার বাপ দাদার অপকর্মের দায়ে নিন্দা করতেও চাই না। কিন্তু তার মনে রাখা উচিত যে বাপ-দাদার দেখানো পথে তার সফলতা নেই। তার বাপ-দাদার অপকর্মের জন্য পুরো চট্টগ্রামে তারা একটি ঘৃণিত পরিবার। দেশ স্বাধীন হলে তার দাদা ফকা ট্রলারে করে বার্মা পালানোর সময় ধরা পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে পেটানোর সময় ভারতীয় বাহিনী তাকে উদ্ধার করে। ফকার মতো দাম্ভিক, খুনি, কুলাঙ্গারের বিচার বাংলার মাটিতে হয়েছে। জেলখানায় তার মৃত্যু হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বয়ান দিয়েছে, মুত্যুর পর ফকার অভিশপ্ত মুখটা বিভৎস রূপ ধারণ করেছিল।

সাকা বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতার আগে আগে। ১৯৭৫ সালের পর দেশে ফিরে আসে। সাকার মতো খুনি, কুলাঙ্গার, জালেমও জেলখানায় থেকে, দীর্ঘ আইনি লড়াই করে মৃত্যুদণ্ড বরণ করতে হয়েছে। তার ছোট ভাই সাইফুদ্দিন এবং গিয়াসউদ্দিন তার সঙ্গে অপকর্মে জড়িত ছিল। সাইফুদ্দিন দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে মারা গেছে। গিয়াসউদ্দিনেরও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার হওয়া উচিত। আল্লাহ হাকেমুল হাকেমিন। তিনি ফকা-সাকার অপকর্মের পরিণতি এই জাতিকে দেখিয়েছেন।

হুকা চট্টগ্রামের সমাবেশে তার বাবাকে ‘শহীদ’ বলে শেষ করেননি, ক্ষমতা হারালে আওয়ামী লীগকে এর পরিণিতি ভোগেরও হুমকি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত তথাকথিত শহীদদের বাড়িকে ক্ষমা চাইতে যেতে হবে বলেছেন। তার মানে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে রাজাকার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আরেকটা সংঘাত অপরিহার্য এই ধারণা দিতে চাচ্ছেন হুকা। দেশে একটা কাটাকাটি মারামারির নৈরাজ্য হবে!

বাংলাদেশের তরুণ নেতৃত্ব খুবই হতাশার। এরা অতীত আশ্রিত রাজনীতির চোরাগলিতে হাঁটছে। ক্ষেত্র বিশেষ ধর্মকেও হাতিয়ার করতে চাচ্ছে। ভিপি নুরুল ইসলাম নুরকে অনেকে সম্ভাবনাময় মনে করতেন। কিন্তু তারও নিজস্বতা নেই, নীতি আদর্শের স্থিতিশীলতা নেই। সাকাপুত্রের নারায়ে তাকবির তারও পছন্দ হয়েছে। অথচ জাতি এদের কাছে শুনতে চায় দেশ কীভাবে আগাবে, আগামীতে সরকারে গেলে তারা কীভাবে চলমান গ্লোবাল ক্রাইসিস সামলাবেন।

আজ সরকারের অবদান থাকুক আর না থাকুক, কোটি প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ে সারা দেশে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। গ্রামে গঞ্জে গেলে দেখবেন পাকা ঘর তৈরি হচ্ছে। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। এটা অস্বীকার করি না যে গার্মেন্টসখাতেও বিদেশি মুদ্রা আসছে। কিন্তু এইখাতে শ্রম দেওয়া কয়জন শ্রমিক তার গ্রামে একটি পাকা ঘর তৈরি করতে পেরেছে?

যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের বিচার করে বাংলাদেশ তার একটি নৈতিক দায়িত্ব শেষ করেছে। কিন্তু এই বিচারের প্রতিশোধের কথা তুলে দেশে যদি নৈরাজ্যের স্বপ্ন দেখে কেউ, প্রতিহিংসার রাজনীতিতে সামনে আনতে চায়, তারা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। আওয়ামী সরকার বিরোধীরাও এই ধরনের প্রতিহিংসা চায় না। আওয়ামী লীগ থেকে মুক্তি চাইলেও সাধারণ মানুষ দেশে হানাহানী চায় না। হানাহানির গন্ধ পেলে সাধারণ মানুষ বিরোধী দলের আন্দোলনে শরিক হবে না।

অতীতের দিতে তাকালেও সেই প্রমাণ মিলবে। এই সরকারের বিরুদ্ধে ২০১৩, ২০১৪ সালের আগুন, পেট্রোল বোমার আন্দোলনে সাধারণ মানুষ সাড়া দেয়নি। সাধারণ মানুষ নিজেরা আন্দোলনের শিকার হোক তারা আর সেটা চায় না। সাধারণ মানুষের অনেকে রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তনও চায় কিন্তু তারেক রহমান ক্ষমতায় আসলে উন্নয়নের ধারা, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার কী হবে– এটাও তাদের অনেকের ভীতি। বৈশ্বিক রাজনীতির এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে এখন সবার আগে দরকার সুশাসন এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা। ক্ষমতা প্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলোকে সেই রাজনীতি নিয়ে মাঠে আসতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৫)
খামারে আগুন, পুড়ে মারা গেছে ৫০ হাজার মুরগি
খামারে আগুন, পুড়ে মারা গেছে ৫০ হাজার মুরগি
সুন্দরবনের দস্যু করিম শরিফ বাহিনীর দুই সহযোগী অস্ত্রসহ আটক
সুন্দরবনের দস্যু করিম শরিফ বাহিনীর দুই সহযোগী অস্ত্রসহ আটক
কুষ্টিয়া সীমান্তে ফেনসিডিলসহ ৩ ভারতীয় মাদক কারবারি আটক
কুষ্টিয়া সীমান্তে ফেনসিডিলসহ ৩ ভারতীয় মাদক কারবারি আটক
সর্বশেষসর্বাধিক