সুরের সাম্পানে সবাই চড়তে পারেন না। যারা চড়তে পারেন তাদের অনেকেই সেই সাম্পান নিয়ে গন্তব্যে যেতে পারেন না। শ্রদ্ধেয় আলম খান, আপনি কি সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য খুঁজে পেয়েছেন? যে প্রশ্ন রেখেছিলেন শাহ আব্দুল করিম সেই একই প্রশ্ন আপনার উদ্দেশেও রাখা যায়– কোথা হতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়? ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নাও…।
সুরের নাও কিংবা সাম্পান সম্ভবত এমনই। সৃষ্টিটা হয়তো নিদারুণ যন্ত্রণার। হৃদয়ের সব অনুভূতি দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে হয়তো ভর করে কোনও সুর। তারপর পাখা মেলে উড়ে যায়, খানিকটা রয়ে যায় সংগীত আয়োজনে, অনেকটা থেকে যায় শিল্পীর কণ্ঠে আর সৃষ্টির সবটা বাসা বাঁধতে শুরু করে মানুষের হৃদয়ে! চলে যাওয়ার পরে পাখি, প্রিয় ফুল কিংবা মানুষ কোথায় যায়? মানুষ চলে গেলে গল্প আর সুর উড়তে থাকে বেঁচে থাকা মানুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে!
শ্রদ্ধেয় আলম খান আপনি সৌভাগ্যবান। আপনি জেনে গেছেন আপনার স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে মানুষের হৃদয়ে। সুরেলা ময়ূরপঙ্খী নাও নিয়ে যাত্রা করেছিলেন সেই কবে। সুর সবার জন্য নয়। সুরের পাখি সবার কাছে ধরা দেয় না। অভিমানী সেই পাখিকে বশ করতে পেরেছিলেন আপনি। যে নৌকা বা সাম্পানে চড়ে আপনি চলে গেলেন অজানা গন্তব্যে সেই সাম্পানের গলুইয়ে কি সুরের পাখিটা আছে, নাকি ডানা ঝাপটে চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও?
যেখানে চলে গেলেন সেখানে কি আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছেন সহোদর ‘পপগুরু’ মুক্তিযোদ্ধা আজম খান কিংবা আপনার স্নেহধন্য গায়ক এন্ড্রু কিশোর?
সংগীত ছিল আপনার রক্তে। উত্তরাধিকার সূত্রেই হয়তো পেয়েছেন। একদা আপনার পূর্ব পুরুষরা নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বে গানের সুরলহরি তুলতেন। আপনার পিতা আপনাকে সংগীতের সাথে জড়াতে মানা করেছিলেন পড়ালেখায় ক্ষতি হবে বলে। অনেকেই জানে না যে আপনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন যতদিন বাঁচবেন গানের সাথেই বাঁচতে চান। আপনি অন্য কোনও পেশার হলে ‘খুরশীদ আলম খান’কে হয়তো মানুষ মনে রাখতো কিংবা রাখতো না। বিধাতার ইচ্ছায় মানুষ যাকে হৃদয়ে অমর করে রেখেছে তার নাম সুরের কিংবদন্তি ‘আলম খান’।
সিরাজগঞ্জের বানিয়াগাতিতে জন্মেছিলেন আপনি। শৈশব কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৪৭-এর পর ঢাকাতেই কেটেছে বাকিটা জীবন। পাখির ডাক, নদীর স্রোতে বা জলের ধারা, রাস্তার কোলাহল কিংবা বাতাসের গতির মতো হারমোনিয়ামের উচ্ছ্বাস, এস্রাজের গভীরতা, সেতারের ধুন, গিটারের চঞ্চলতা কিংবা ঢোলের মাদকতা আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতো। আপনি সেই হাতছানি নিয়েই জীবন সাজালেন, সরকারি চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে হাঁটলেন না। সব মাদকতা, চঞ্চলতা, উচ্ছ্বাস বা গভীরতাকে নিজেই যেন বাজাতে থাকলেন নিত্য নতুন সুরের ধুনে।
এরপর একদিন (১৯৬১-৬২) রবীন ঘোষের ‘তালাশ’ ছবির সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে আপনার জীবন শুরু। ‘কাঁচ কাটা হীরে’ আপনার প্রথম ছবি, যেখানে আপনি প্রথম পরিপূর্ণ সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকের সংগীত পরিচালনার সঙ্গেও জড়িয়েছিলেন স্বাধীনতার আগেই। বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংশপ্তক (আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায়) নাটকের আবহসংগীত করার অভিজ্ঞতাই আপনাকে এনে দিয়েছিল অন্যরকম এক ছবিতে কাজ করার সুযোগ।
৬৮-৬৯ সালে যে গানের প্রাথমিক সুর করেছিলেন সেই গানটা পরিপূর্ণ করলেন দশ বছর পরে। গানটা ব্যবহৃত হয়েছিল আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বৌ’ ছবিতে। ‘ওরে নীল দরিয়া’র সুর মিশে আছে যেন বাংলার সব নদীতে, বাংলার মানুষের হৃদয়ে।
‘ওরে নীল দরিয়া’র সঙ্গে মিশে আছে জলের মাতলামির সুর। মিশে আছে এক নাবিকের বাড়িতে ফিরতে না পারার বিষণ্নতা। মিশে আছে জাহাজ কিংবা সাম্পানের জলভাঙার শব্দ। মিশে আছে প্রিয়তমার জন্য বিরহগাথার এক মনভাঙা কালজয়ী সুর। এই গান এখনও অনেকেই গায় মঞ্চ কিংবা টেলিভিশনে, এই সুর তোলে বিয়েবাড়ির ভাড়া করা কোনও ব্যান্ডপার্টি কিংবা কুচকাওয়াজ করার সময় কোনও সামরিক ট্রাম্পেট। বাংলার জল ও মাটির ঘ্রাণে তৈরি ‘ওরে নীল দরিয়া’র আবেদন কখনও ফুরাবে না। এই গানের জন্য যেমন বিখ্যাত হয়ে আছেন সংগীতশিল্পী আবদুল জব্বার, তেমনি এই গান স্থান পেয়েছিল বিবিসির জরিপের সেরা বিশ বাংলা গানের একটি হিসেবে।
ফুরাবে না আপনার সুরের বহুমাত্রিকতা। আপনার কোনও সুরই একমাত্রিক বা পুরনো কোনও সুরের ধারাবাহিকতা নয়, ভিন্নতা লক্ষণীয়, সাধারণ শ্রবণেই সেটা অনুমিত হয়। জলের মাতলামি আর বিষণ্নতার সুর যদি হয় ‘ওরে নীল দরিয়া...’ তবে ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে সে কী জানো না...’ দারুণভাবে ‘রক অ্যান্ড রোল’ প্রভাবিত গান।
যদিও গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল ‘নাগ পূর্ণিমা’ ছবিতে, তবু বিটলস, অ্যাবা কিংবা বনিএমের মতো ব্যান্ডগুলো যখন সারা বিশ্বে ঝড় তুলেছে তখন বাংলাদেশের এক ফ্যান্টাসি ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে পশ্চিমা ধাঁচের এক সুর, যা তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে!
আবার যখন দর্শকদের বোকা বানিয়ে হিন্দি কোনও ছবির সরাসরি নকল বা কার্বনকপি ছবি তৈরি হয়েছে এ দেশে, তখনও আপনার গান আলাদাভাবে নিয়েছে মানুষ। ছবির সেই দিন এখন নেই কিন্তু গান থেকে গেছে মানুষের হৃদয়ে, যা প্রজন্মজয়ী বা কালজয়ী রূপ নিয়েছে। ‘আজকে না হয় ভালোবাসো আর কোনোদিন নয়’ (ছবি মিন্টু আমার নাম, সে সময়ের জনপ্রিয় হিন্দি ছবি ছিল জনি মেরে নাম) গানটা আজও সমান জনপ্রিয়। প্রেমে পড়ার আহ্বানে মোড়ানো এক প্রেমমাখা সুর ভর করেছিল এই গানে। গানটির শিল্পী ছিলেন খুরশিদ আলম। সে সময়ে হিন্দি ‘শোলে’ ছবির অনুকরণে নির্মিত ‘দোস্ত দুশমন’ ছবির ‘চুমকি চলেছে একা পথে’ গানটিও স্মরণীয়, যা এখনকার প্রজন্মের গায়ক-গায়িকারাও গেয়ে থাকেন। গানের সুরের আবেদনটাই আসল, যা যুগ বা কালকে ম্লান করে দেয়। আজ থেকে আরও একশত বছর পরেও প্রেমে পড়া কোনও যুবক হয়তো তার প্রেমিকাকে উদ্দেশ করে গেয়ে উঠবে খানিকটা চটুল কিন্তু আনন্দ ভরা গান-‘চুমকি চলেছে একা পথে/সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে’!
প্রেমের মতো কিছু কিছু সুর টিকে আছে মানুষের হৃদয়ে, যা কখনও হারায় না। মানুষের হৃদয় থেকে না হারানো এই গানের শিল্পী ছিলেন খুরশীদ আলম।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সাথে আপনার একটা যুগলসন্ধি আগে থেকেই ছিল। ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা’ গানটি লিখেছিলেন সৈয়দ হক এবং সুর করেছিলেন আপনি। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন রুনা লায়লা ও এন্ড্রু কিশোর। পরে ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবির জন্য আরেকটি গান লিখেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, আপনি সুর করার পর সেই গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’।
সিগারেটের প্যাকেট উল্টিয়ে লেখা এই গান এখন ইতিহাস। ‘ওরে নীল দরিয়া’র মতো আলম খানের সুরের এক ধামাকা এই গান, যা সর্বকালের সবার প্রিয় গানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এমন আরেকটি কালজয়ী গান– ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ যার কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। এন্ড্রু কিশোর চলচ্চিত্রে প্রথম যে গান গেয়েছিলেন সেটিও আলম খান আপনার সুর করা (এক চোর যায় চলে/ মন চুরি করে-ছবি প্রতিজ্ঞা)। আবদুল জব্বার, খুরশিদ আলম, সুবীর নন্দী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, এন্ড্রু কিশোর, রোমানা মোর্শেদ কনকচাঁপাসহ আরও অনেক শিল্পীর জনপ্রিয় গানের সুরকার ছিলেন আপনি। সুরের জগতের এমন রাজা আমরা ক’জন পেয়েছি? আমাদের সৌভাগ্য আমরা জন্মেছিলাম আপনার সুরের সময়ে।
চাঁদের সাথে যার তুলনা দেওয়া মানা সেই আপনি ‘রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলাতে’ চেয়েছিলেন, মানুষের কিছু চিরচেনা সুর ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন ভালোবেসে। বিরহের মনভাঙা সুর ছিল আপনার গানে, আর তাই আপনি সুর করে বাঁধতে পারতেন এমন গান– ‘ভালোবেসে গেলাম শুধুই ভালোবাসা পেলাম না’ কিংবা ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’ অথবা ‘ও সাথীরে যেও না কখনও দূরে’। হৃদয়ভাঙা বিরহের সুরটাকে আপনি বারবার বেঁধেছেন সুখ পাখির ডানায়। পাখি উড়ে যাওয়ার পরেও সেই সুরের পালক ছড়িয়ে পড়েছে মেঘ হয়ে, নেমে এসেছে বিষণ্নতার এক বৃষ্টি। আপনি যেমন দয়ালের ডাককে সুরে বেঁধে বলতে পেরেছিলেন থাকবো না আর বেশি দিন, তেমনি বলতে পেরেছিলেন ‘তেল গেলে ফুরাইয়া বাত্তি যায় নিভিয়া’। চিরন্তন এই সত্যের বিপরীতে গিয়েও আনন্দের সুর তুলতে চেয়েছেন কখনও সখনও-‘দুনিয়াটা মস্ত বড় খাও দাও ফুর্তি করো’!
খাও দাও ফুর্তি করার জীবন আপনার ছিল না। প্রিয়তম স্ত্রী গুলবানুকে হারিয়েছিলেন আগেই। গুলবানু একদা লিখেছিলেন– ‘তুমি তো এখন আমারই কথা ভাবছো’ যার সুর করেছিলেন আপনি নিজেই। তীব্র অভিমান থেকে কিনা জানি না, আপনি সংগীতের জন্য মরে যেতে চেয়েছিলেন। জীবনের প্রয়োজনে আপনার সন্তানেরা হয়তো এখন গানের সাথে থেকেও নেই। মৃত্যুর পরে সন্তানরা জানিয়ে দিয়েছেন, আপনার কালজয়ী গানগুলোর ওপর তাদের আর কোনও দাবি নেই। সন্তানরা জানিয়ে দিয়েছেন, আপনার গানগুলো যেন বেঁচে থাকে অন্যদের কণ্ঠে, মানুষের হৃদয়ে। যারা আপনার গান গাইবে তারা যেন সুরটা শুধু ঠিক রেখে গায়। সাতবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন আপনি। তবু আপনার সন্তানদের মতো আমরা মনে করি, একুশে কিংবা স্বাধীনতা পদক দেওয়া হোক আপনাকে। আপনার সুরের সাম্পানের গলুইয়ে বসা সুরের পাখিটা যেন এই বাংলাতেই ডানা ঝাপটায়। পাখি যেন আপনাকে গিয়ে শুধু বলে, আপনার একটা ধারণা ঠিক নয়। ‘যাইবার কালে’ অসংখ্য মানুষের কান্নাময় দেখতে আসাটা শুধু আপনি দেখলেন না!
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ২০১১ সালে আপনার ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়েছিল। আপনি তখন বিদেশে ছিলেন চিকিৎসাধীন। সে সময়ে আপনার প্রিয় সহোদর পপ সম্রাট খ্যাত মুক্তিযোদ্ধা গায়ক আজম খান মৃত্যুবরণ করেন। আজম খানের মৃত্যুর সংবাদটা আপনাকে দেওয়া হয়নি। দেশে ফিরে আপনি যখন জানলেন, কেউ আপনার সামনে সেদিন দাঁড়াতে পারেনি। আমরা অনেকেই জানি না যে স্বাধীনতার পর আজম খানের গানগুলো আপনি শুনে সেগুলো রেকর্ড করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। আজম খানের সেই অমর গান– ‘ও চাঁদ সুন্দর রূপ তোমার’, ‘বাধা দিও না’,‘অভিমানী তুমি কোথায় হারিয়ে গেছ’,‘পাপড়ি কেন বোঝে না তাই ঘুম আসে না’, ‘আলাল ও দুলাল তাদের বাবা হাজী চান’, ‘হারিয়ে গেছে ফিরে পাবো না’ এবং ‘এই বিদায় বেলায় কেউ কেঁদো না’ গানগুলোর সংগীত আয়োজন করেছিলেন আপনি। আজম খানের প্রথম গানগুলোর রেকর্ডের সময় আপনি তার মাথায় রেখেছিলেন আশীর্বাদ ও প্রশ্রয়ের হাত।
খুব কম মানুষই জানে বাংলা ছবির অমর গানগুলোর মতো এ দেশের ব্যান্ডসংগীত জনপ্রিয় করার পেছনেও ছিল আপনার সুরেলা ও স্নেহমাখা আশীর্বাদের হাত।
লেখক: রম্যলেখক