X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

করোনায় জীবন বনাম জীবিকা সংকট

ফারাবী বিন জহির
১৬ মে ২০২১, ১৭:৪৯আপডেট : ১৬ মে ২০২১, ১৭:৪৯

ফারাবী বিন জহির সম্প্রতি সময়ে আমাদের দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। এই দ্বিতীয় ঢেউ করোনার প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে আরও ভয়ংকররূপে আমাদের দেশে আবির্ভূত হয়েছে। মানুষের মৃত্যুর হার ৩ ডিজিটে উন্নীত হয়েছিল এবং সংক্রমণের হারও বেড়েছিল আশঙ্কাজনকভাবে। এই সংক্রমণকে সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ভঙ্গুর চিত্র করুণভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। যদিও করোনা মোকাবিলার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এই প্রথম না। বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ঘোষণা আসে। সেই সময় করোনার রিপোর্টকে ঘিরে দুর্নীতির এক বীভৎস রূপ আমরা দেখেছি। যে সময় সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর কথা ছিল সেই সময় কিছু মানুষকে আমরা দেখেছি মানুষের প্রতি সর্বোচ্চ বীভৎসতা দেখাতে। সেই বীভৎসতাকে মোকাবিলা করে করোনার প্রথম ধাক্কা পার হলেও দ্বিতীয় ধাক্কা আরও ভয়াবহভাবে আবির্ভূত হয়েছে।

কিছু দিন আগে আমাদের দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য আতঙ্কের। এই ভ্যারিয়েন্ট ভারতকে বেসামাল করে দিয়েছে। ভারতের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ এবং করুণ করে তুলেছে। সেই ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান আমাদের দেশে পাওয়াটা আমাদের জন্য সত্যি আতঙ্কের। এই ভ্যারিয়েন্ট যদি আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সেই অবস্থা সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে!

এছাড়াও আইসিডিডিআর,বি ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, আইসিডিডিআর,বি সর্বপ্রথম গত ৬ জানুয়ারি ইউকে ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান পায়। যদিও আন্তর্জাতিক সংস্থা জিসএইডের তথ্য বলছে, ইউকে ভ্যারিয়েন্ট দেশে ডিসেম্বর মাসেই প্রবেশ করে। এই ভ্যারিয়েন্ট উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায় মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। যা শতকরা ৫২ শতাংশ পজিটিভ নমুনার মধ্যে পাওয়া গেছে।

আইসিসিডিডিআর,বি র তথ্য বলছে, সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট দেশে প্রবেশের পর উল্লেখযোগ্যভাবে একটি পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যার ফলে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টকে ছাড়িয়ে সর্বাধিক আধিপত্য বিস্তারের নজির পায় প্রতিষ্ঠানটি। এই আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট বিস্তারের পর এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে থাকে দেশ। হু হু করে বাড়তে থাকতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সেই রোগী সামাল দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা না থাকায় বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যা। পরিস্থিতি হয়ে উঠে উদ্বেগজনক। সেই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকারে লকডাউন দিতে হয়। যদি প্রথম দফার লকডাউন শিথিলতার কারণে সেই লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী দ্বিতীয় দফা আরও কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেয় সরকার।

তবে এই লকডাউনকে ঘিরে যে সংকটটি ঘনীভূত হচ্ছে তা হলো জীবন বনাম জীবিকার সংকট। এ যেন জলে কুমির ডাঙায় বাঘের মতো অবস্থা। একটি শিথিল করলে অপরটি অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। জীবন বাঁচাতে গেলে মানুষ জীবিকা সংকটে ভুগছে আবার জীবিকার প্রতি নজর দিলে মানুষের জীবন হুমকির মুখে চলে যাচ্ছে।

এমন অসহনীয় সংকটে কেন পড়তে হলো আমাদের? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। এই সংকট তৈরির পেছনে রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ব্যক্তি কেউ তার দায় এড়াতে পারে না। সবাই যার যার অবস্থান থেকে যথেষ্ট পরিমাণ খামখেয়ালিপনায় লিপ্ত ছিল। সেই সামগ্রিক খামখেয়ালিপনার ফলই ভোগ করছি আমরা এই ভয়াবহ সময়ের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তিপর্যায়ে যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে দেখবো গত বছর করোনার সংক্রমণ কমার পর আমরা যেন উচ্ছৃঙ্খল  জাতিতে পরিণত হই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে চরম উদাসীনতার পরিচয় দেই। ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনও চিন্তা আমাদের মধ্যে ছিল না। আজ  যারা মার্কেট,শপিং মলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেওয়ার ব্যাপারে দাবি জানাচ্ছেন, সেই মানুষগুলোর স্বাস্থ্য সচেতনতার চিন্তা যদি আরও আগে থেকে উদয় হতো আজকে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতে পারতো না। আজকে যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব খুলে দিতে বলছেন তারা এতদিন কতটুকু স্বাস্থ্যবিধি মেনেছেন এবং পরিস্থিতির উন্নতি হলে কতটুকুই বা মানবেন সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

আবার যাদের তদারকি করার কথা এবং স্বাস্থ্যবিধির নিয়ম-কানুন মানতে বাধ্য করার কথা সেই প্রশাসনই কতটুকু দায়িত্ব পালন করেছে তাও নিয়ে প্রশ্ন আছে। যখন কোনও নিয়মনীতি স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটেছে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে তখন আমাদের কর্তাব্যক্তিরা তাদের কাজ শুধু বিবৃতিদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। দেশের শপিং মল, সিনেমা হল, গণপরিবহন, দূরপাল্লার পরিবহন, অফিস-আদালত, বাজার-হাট কোনকিছুতে বিন্দুমাত্র তদারকি ছিল না যে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে নাকি। রাজনৈতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ধর্মীয় মাহফিল সব জায়গায় হাজার মানুষের সমাগম ঘটছে। যে দেশে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে পুলিশের সঙ্গে মারামারি থেকে ধর্মীয় মাহফিলের নামে সাম্প্রদায়িক হামলা পর্যন্ত হচ্ছে, সেই দেশে আসলে প্রতিদিন জনগণের উদ্দেশে বাণী দিয়ে করোনার সংক্রমণ কীভাবে রোধ করা সম্ভব? একদিকে জনসমাগম হতে পারে এমন সব অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, আরেক দিকে বলা হয়েছে জনসমাগম পরিহার করুন– শুধু  সাবধানতার বাণী দিয়ে কি করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব ছিল? বিশ্বে যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছিল তখনও আমাদের কর্তাব্যক্তিদের হুঁশ হয়নি যে দেশে যদি দ্বিতীয় ঢেউ আসে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনা দিয়ে তা কতখানি মোকাবিলা সম্ভব। করোনার ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে তথ্য প্রকাশে কোনও গাফিলতি হয়েছে কিনা, এই প্রশ্ন ও থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা হচ্ছে এই দেশে বেশি দিন লকডাউন দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশে যেখানে জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এই শ্রেণির মানুষের পক্ষে বেশি দিন বসে বসে সঞ্চয় ভাঙ্গিয়ে খাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশও দেশ হিসেবে সেই অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করেনি যেখানে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মতো চাইলেই দেশের মানুষকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো সম্ভব। অস্তিত্বের স্বার্থেই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হবে। তা না হলে করোনার কারণে না হোক জীবিকার কারণে মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। এটি যেমন একটি সত্য তেমনি অন্যদিক থেকে আরেকটি সত্য হচ্ছে করোনার ভয়াবহতা মোকাবিলা। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হয়। গত বছর পর্যন্ত এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে একদিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জন মারা গিয়েছিলেন ৩০ জুন। তবে এ বছরের এপ্রিলে এসে ২৪ ঘণ্টায় করোনার সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু পেরিয়ে যায় শতকের ঘর। একদিনে সর্বোচ্চ ১১২ জনের পর্যন্ত মৃত্যুও ঘটেছে। এদিকে, গত বছরের জুলাইয়ে সর্বোচ্চ এক হাজার ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল করোনার সংক্রমণ নিয়ে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ বছরের এপ্রিলের প্রথম ১৮ দিনেই করোনায় মৃত্যু ছাড়িয়ে গেছে গত বছরের জুলাইকে। এই ১৮ দিনে মারা গেছেন এক হাজার ৩৩৯ জন। এর আগে এত কম সময়ের মধ্যে করোনার সংক্রমণ নিয়ে এক হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটনা দেশে ঘটেনি। কেবল করোনা সংক্রমণে মৃত্যুই নয়, করোনার সংক্রমণও মাত্রা ছাড়িয়েছে এ বছর। গত বছর যেখানে একদিনে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ১৯ জনের মধ্যে এই সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল, সেখানে এ বছর একদিনে সংক্রমণ সাত হাজারের ঘর ছাড়িয়েছে ছয় দিন। গত বছরের জুনে এক মাসে সর্বোচ্চ ৯৮ হাজার ৩৩০টি সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল দেশে। সেখানে এপ্রিলের প্রথম ১৬ দিনে সংক্রমণ শনাক্তের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে লাখের ঘর। এই কথাও অস্বীকারের জো নেই জীবিকা বিষয়ক অতি আবেগী সিদ্ধান্ত জীবনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। একটি পরিবার হয়তো একটু কষ্ট করে জীবন নির্বাহ করতে পারে কিন্তু সেই পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তি যদি কোনও কারণে মারা যায় তাহলে সেই পরিবারটিকে অকুল পাথারে পড়তে হয়।

তাই আমাদের সিদ্ধান্তের জায়গাটি হতে হবে আবেগ বর্জিত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব সিদ্ধান্ত  নিতে হবে। মনে রাখতে হবে একজন করোনা আক্রান্ত রোগী শুধু তার নিজের জন্য না, বরং তার পরিবার এবং প্রতিবেশীদের জন্য সমভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। পরিবারের একটি ব্যক্তির অসচেতনতার কারণে পুরো পরিবার মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এই সহজ বোধটি যতক্ষণ পর্যন্ত যে দেশের জনগণের মধ্যে বোধোদয় না হবে সে দেশে ততক্ষণ পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণ প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে যাবে।

সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজন কঠোর নজরদারি এবং শাস্তির ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে শুধু জনগণকে সচেতন করলেই হবে না, পাশাপাশি কঠোর নজরদারির মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি পালনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যেকোনও অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়ার আগে অবশ্যই করোনার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। টিকার কার্যক্রম বাড়াতে হবে। যত বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনা যায় তত করোনা মোকাবিলা সহজ হবে। মানুষের জন্য অর্থনীতি, অর্থনীতির জন্য মানুষ নয়। তাই যেকোনও  সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে মানুষের জীবনকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে।  

সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, জীবন বনাম জীবিকার কঠিন বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। জীবন এবং জীবিকা দুটিই  আমাদের কাছে সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটোই আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কোনও একটির ক্ষেত্রেই বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। তাই স্বাস্থ্যবিধি মনে চলার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় নিঃসন্দেহে আমাদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলবে।  

লেখক: গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শ্রীপুরে নির্মাণাধীন বাড়ির সানসেট ভেঙে নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু
শ্রীপুরে নির্মাণাধীন বাড়ির সানসেট ভেঙে নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু
পুঁটি মাছ কাটা নিয়ে ঝগড়া, স্ত্রীকে ‘হত্যা করে’ থানায় স্বামী
পুঁটি মাছ কাটা নিয়ে ঝগড়া, স্ত্রীকে ‘হত্যা করে’ থানায় স্বামী
প্রধানমন্ত্রী নয়, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার চায় এনসিপি: নাহিদ ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী নয়, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার চায় এনসিপি: নাহিদ ইসলাম
মাদারীপুরের শিবচর থেকে ককটেল-গুলি ও ইয়াবা উদ্ধার
মাদারীপুরের শিবচর থেকে ককটেল-গুলি ও ইয়াবা উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক