X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

এরপর নারী অধিকার আন্দোলনের ভার কার কাঁধে

উদিসা ইসলাম
০৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:০০আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:০০
image

একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা লাভের পর দেশে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন তাদের অনেকেই মারা গেছেন। এছাড়া দেশে নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার ও সংবেদনশীল সমাজ গড়ে তুলতে রাজপথে যারা ছিলেন, তাদের অনেকে বয়সজনিত কারণে অবসরে গেছেন। অ্যাকাডেমিশিয়ান, সাংবাদিক ও সক্রিয় নারী অধিকার কর্মীরা প্রশ্ন তুলছেন, নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সত্তর দশকের পরবর্তী প্রজন্ম কতটা প্রস্তুত? যখন পথনির্দেশকরা একে একে চলে যাচ্ছেন, তখন আত্মসমালোচনার সময় এসেছে উল্লেখ করে তারা বলছেন, আমরা সবাই একা একা বিপ্লব করতে চাইছি। আমাদের আন্তঃযোগাযোগতো বটেই, আমাদের সংগে তৃণমূল নারীর যোগাযোগ কমে গেছে। তারা কী চায়, সেটা জানা না গেলে তাদের জন্য কাজ করাটাই মূল্যহীন হয়ে যায়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানমের মৃত্যুতে নতুন করে আলাপ উঠেছে অ্যাক্টিভিস্ট মহলে। দৈনিক আমাদের অর্থনীতির সম্পাদক মাসুদা ভাট্টি মনে করেন, বিশ্বময় নারী অধিকার আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অধিকার শব্দটি কেমন যেন ব্রাত্য হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘অধিকার শব্দটির জায়গা নিয়েছে ক্ষমতায়ন। এটি এতটাই ক্যাপিটালিস্ট ধারণা যে, এখানে গ্রামের নারীর হাতে মোবাইল দেওয়াকেই মনে হচ্ছে ক্ষমতা দেওয়া। কিন্তু তার অধিকার নিয়ে কোনও মোবাইল তুলে দেনেওয়ালার মাথাব্যথা নেই। ফলে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়লেও নারীর সমতাভিত্তিক আন্দোলন নিয়ে কাজ কম হচ্ছে। আর যারা চলে গেছেন বা যাচ্ছেন, তারা এই মোক্ষম জায়গাটিতে হাতুড়ি পেটাতেন। এখন সেটা না হওয়ায় নারীর সংকট আরও ঘণীভূত হয়েছে। নারী এখন উপার্জন করেও তার প্রাপ্য সম্মান বা অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। পুরো পরিবারকে খাওয়ানো পরানোর পরও কেন দুধ উতলে পড়ে গেলো, সে জন্য চুলের মুঠি ধরে নারীকে মেরে রক্তাক্ত করলেও সমাজ নিশ্চুপ থাকে। কিংবা রাষ্ট্র এই আক্রমণকে তেমন আমলে নিতে চায় না। ধর্ষণ বিষয়ক যে রায় নিয়ে আমরা আপ্লুত হলাম, সেটা নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।’ বরং ধর্ষণ বন্ধে সামাজিক জাগরণ নিয়ে তৃণমূলে কাজ করলে একইসঙ্গে সম্ভাব্য ভিকটিম ও ক্রাইম দু’টোই কমিয়ে আনা সম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘এখন এই আন্দোলনের জায়গাটি এবং যারা সাধারণত এটা করতেন, তাদের অনুপস্থিতিই কেবল দৃশ্যমান তা নয়, তাদের জায়গা অনলাইন কিংবা অফলাইনে চলে যাচ্ছে কিছু ‘অ্যাক্টিভিস্ট নামধারীদের’ হাতে। যারা ক্ষমতায়নের সঙ্গে হয়তো পরিচিত, কিন্তু অধিকার শব্দটির সঙ্গে হয় পরিচিত নন, কিংবা সেটার কখনও কখনও ভুল ব্যাখ্যাও করেন।’’
সুশীল অ্যাক্টিভিজম ও নারীর পক্ষের রাজনীতির পার্থক্য আছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি ড. কাবেরী গায়েন বলেন, ‘আয়শা খানমসহ সত্তরের নারী অধিকারকর্মীদের যে আন্দোলন তার সুস্পষ্ট রাজনীতি ছিল। তথাকথিত অ্যাক্টিভিজম বা সেলিব্রেটি অ্যাপ্রোচ ছিল না। তারা রাজনীতিই করেছেন। সেই রাজনীতিটা করতে গিয়ে দেশের রাজনীতি ও নারীর রাজনীতিকে এক করে দেখেছেন। ভুলে গেলে চলবে না, স্বাধীনতার পরে তাদের কাজ করা অত সহজ ছিল না। সবকিছুই তাদের তৈরি করতে হয়েছে। যে তৈরি করা পথ ধরে আমরা এগিয়েছি। কিন্তু আমাদের পরের প্রজন্মর জন্য কি আমরা সেই দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি?’
সাম্প্রতিক সময়ে নারীবাদ চর্চার প্রবণতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এখন দেখা যায়, ‘আমি’ সর্বস্বতার নারীবাদী, ‘আমি’ লড়াই করছি, ‘আমি করছি’, ‘নারীর সঙ্গে ও নারীর বিষয়ে আমি কথা বলবো’। কিন্তু উনাদের (সত্তর দশকের নারী অ্যাক্টিভিস্টরা) রাজনীতি ‘আমি আয়শা খানম’ বলার না। উনারা একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছিলেন। এখন কোনও ধারাবাহিকতা নেই। কিন্তু সামনে এসে এক ধরনের শো-অফ আছে। যদিও অধিকারের এই সংগ্রাম একটা রিলে রেস। সেটার সঙ্গে কানেক্ট করতে পারার অভাব বোধ দেখি।’’
কিনি বলেন, ‘আমরা ভীষণ বিচ্ছিন্ন। আমাদের অগ্রজদের পরস্পরের মতপার্থক্য ছিল না তা নয়, তারা সহনশীল ও সংবেদনশীল ছিলেন। প্রশ্ন করার সময় এসেছে, এই প্রজন্ম চলে গেলে কী হবে? কারা দায়িত্বটা তুলে নেবেন,তারা কি প্রস্তুত?’
আন্দোলন নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নন ব্র্যাকের শিক্ষক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সক্রিয় সংগঠক সিউতি সবুর। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি চিন্তিত না। কেননা, নারীর অধিকার আদায়ের প্রশ্নে যখন প্রয়োজন হবে, কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে যাবেন এবং সেখান থেকে সংগঠন গড়ে উঠবে। সেটা হয়তো আরেকজন আয়শা খানম হবে না, বা আরও যারা পরিচিতরা মাঠে ছিলেন, তাদের মতো করে ভাববে না। কিন্তু হবে। প্রতিটা সময়ের লড়াইটা ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক।’ তিনি মনে করেন, নারী অধিকার আদায়ে আদর্শিক সংগঠনগুলো নেতৃত্ব বিষয়টি খুব দেরিতে অনুধাবন করেছে। রিলে রেসের বিষয়টি তাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে সহযোদ্ধাদের হারাতে শুরু করলে তারা এক ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার কারণে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পরবর্তী নেতৃত্ব তৈরি ও কাজের ধারাবাহিকতার মতো বিষয়গুলো গুছানোর কাজটি কিছুটা হলেও করতে পেরেছে। অন্যান্য অনেক সংগঠনের সেই প্রস্তুতিও হয়তো নেই।’

তবে এরপরে নারী আন্দোলনের ধ্বজা অনেকের হাতে যাবে বলে আশা প্রকাশ করে নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরিন হক বলেন, 'আমরা চট করে একজন আয়শা খানম পাব না সেটা খুব সত্য কিন্তু আমি শঙ্কিত নই।'

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন প্রজন্মের নারীরা মিলে প্রজন্মান্তরে নারী মৈত্রী নামে যে কাজটি আমরা করছি সেখানে বর্তমান প্রজন্মের নারীদের আমি দেখে খুবই আশাবাদী। তারা অনেক বেশি যৌক্তিক, অনেক স্পষ্ট। ইতিবাচক অর্থে তাদের ধৈর্য কম। পরিস্থিতি বদলে দিতে তারা যুগ যুগ অপেক্ষা করতে চায় না, দ্রুত বদল চায় এবং তার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করতে তারা আগ্রহী। তিনি বলেন, যদি অনেককে নিয়ে কাজ না করা হয় তাহলে সংগঠনের মধ্যে নেতৃত্ব তৈর হয় না, এক দুজন তারকা তৈরি হয়। আমাদের এখানে রাজনৈতিক বা নারী অধিকার সংগঠনে সেই সঙ্কট আছে। কিন্তু আমরা যদি পরবর্তী প্রজন্মকে জায়গা না দিই তারা নিজেদের প্রমাণ করবেইবা কীভাবে। ফলে প্রয়োজনের ওপর দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব তৈরি হয়ে যাবে। তার জন্য যে সহযোগিতা করা দরকার সেটি জারি রাখতে হবে।

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
সর্বাধিক পঠিত
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!