X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিভিল সার্জন অফিসে ঘুষ না দিলে মেলে না লাইসেন্স!

আতাউর রহমান জুয়েল, ময়মনসিংহ
২৭ নভেম্বর ২০২০, ১০:০০আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২০, ১০:০০

ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন অফিস

ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন অফিসে ঘুষ ছাড়া মিলছে না বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স। অফিসের টেবিলে টেবিলে ঘুষ না দিলে কোনও কাজই হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা। সম্প্রতি সরকার অবৈধ বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তালিকা করে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এগুলো বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই লাইসেন্স করতে মরিয়া হয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ছুটছেন সিভিল সার্জন অফিসে। আর এই ঘোষণাকে কাজে লাগিয়ে এই অফিসের সুযোগ সন্ধানী কর্মচারীরা নেমেছেন ঘুষ বাণিজ্যে, লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার নামে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। বিশেষ করে এই অফিসের অফিস সহকারী জাকির হোসেনের নাম এখানে সবার মুখে মুখে। নতুন লাইসেন্স বা নবায়নের জন্য গেলে অফিস খরচ, সিভিল সার্জনের পরিদর্শন এমনকি ঢাকা স্বাস্থ্য অধিদফতরের খরচ ধরে তিনি দাবি করছেন মোটা অঙ্ক। আবার ঘুষ দিয়েও সময়মতো লাইসেন্স না পেয়ে অনেকেই সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন বাদানুবাদে।  

গত সোমবার (২৩ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের লাইসেন্স শাখায় গিয়ে দেখা যায়, মহানগরীর চরপাড়ার নিউ মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক আব্দুর রাজ্জাক এসে অফিস সহকারী মো. জাকির হোসেনের কাছে জানতে চাইছেন, ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার পরও তার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স কেন হচ্ছে না? এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে আব্দুর রাজ্জাক জানান, তার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স করিয়ে দেওয়ার জন্য অফিস, সিভিল সার্জনের পরিদর্শন, ঢাকা স্বাস্থ্য অধিদফতরের খরচ ইত্যাদির নামে অফিস সহকারী জাকির হোসেন তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। কিন্তু, এক বছর পার হয়ে গেলেও এখনও কাজ করে না দিয়ে শুধু তালবাহানা করে যাচ্ছেন জাকির। এই কারণে অফিসে এসে তার কাছে জানতে চাইছি কবে নাগাদ লাইসেন্স পাওয়া যাবে?

সিভিল সার্জন অফিসে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে অফিস সহকারী জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে।

মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক আরও জানান, শুধু তিনি নন, নতুন লাইসেন্স ও নবায়নের জন্য অধিকাংশ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকের কাছ থেকে জাকির হোসেন ঘুষ নিয়েছেন।

১৬৮, চরপাড়া প্রাইমারি স্কুল রোডের ম্যাক্স মেডিক্যাল সেন্টারের মালিক আব্দুল বারী জানান, এক বছর ধরে তিনি তার প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। লাইসেন্সের জন্য অফিস সহকারী মো. জাকির হোসেনকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন। গত এক বছর আগে সিভিল সার্জনকে দিয়ে পরিদর্শন কাজ শেষ করেছেন কিন্তু এখনও লাইসেন্স পাননি তারা।

তিনি আরও জানান, সরকার অবৈধ ক্লিনিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ঘোষণা দেওয়ায় আমাদের মাঝে আতঙ্ক কাজ করছে। টাকা দিয়েও সময়মতো লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ তার।

ব্রাহ্মপল্লী রোডের বসুন্ধরা হাসপাতালের পরিচালক পরিষদের সদস্য আব্দুল ওয়াহেদ জানান, নতুন লাইসেন্স কিংবা নবায়নের জন্য সিভিল সার্জন অফিসে খরচ বাবদ ঘুষ দিতে বাধ্য হতে হয়। সরাসরি সিভিল সার্জনের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ নেই। তবে সিভিল সার্জন নিজ হাতে কারও কাছ থেকে টাকা না নিলেও অফিস সহকারী জাকির হোসেনের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে। এখানে টাকা না দিয়ে সহজে কেউ কোনও লাইসেন্স পায় না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। আর এসব জেনেও সিভিল সার্জন কোনও ব্যববস্থা নেন না।

চরপাড়ার মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টার

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে অফিস সহকারী মো. জাকির হোসেন জানান,  নতুন লাইসেন্স আর নবায়নের জন্য কারও কাছ থেকে কোনও টাকা নেওয়া হয় না। ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা নিজেরা কম্পিউটার দোকান থেকে অনলাইনে আবেদন করলে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পরিদর্শনের জন্য সিভিল সার্জনকে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর সিভিল সার্জন পরিদর্শন করে রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। অনেকে অভিযোগ করলেও নিজে কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা সরাসরি অস্বীকার করেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ময়মনসিংহ জেলায় বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। কিন্তু, হাল নাগাদ লাইসেন্সধারী হচ্ছে ১৭৯টি। ফলে সরকার ঘোষিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের ভয়ে লাইসেন্স গ্রহণের আবেদন করছে বেশিরভাগ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই সরকারি নিয়মনীতি পুরোপুরি অনুসরণ না করায় অনুমোদন পাওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান। তাই বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাওয়ার সর্টকাট উপায় খুঁজছে। এ সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে সিভিল সার্জন অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

সিভিল সার্জনের নাম এই লেনদেনে জড়িত না থাকলেও তার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই দুর্নীতিতে জড়িত থাকার পরেও তিনি কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না সে বিষয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

সিভিল সার্জন অফিসে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকপক্ষের ফরম পূরণের কাজ চলছে অফিস সহকারী জাকির হোসেনের টেবিলে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন ডা. এবিএম মসিউল আলম জানান, লাইসেন্স পেতে পরিদর্শনের জন্য অফিসের কেউ টাকা নিচ্ছে কিনা এটা তার জানা নাই। তবে তার কাছে অভিযোগ করলে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।

বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন  ময়মনসিংহ শাখার সভাপতি ডা. হরি শংকর দাশ জানান, সহজে লাইসেন্স পেতে সিভিল সার্জন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের নিয়ে দুই দফায় সভা করেছেন। তবে লাইসেন্স পেতে টাকা লাগে এ ধরনের কথা শোনা যায়। কিন্তু, এ বিষয়ে কোনও ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক কখনও অভিযোগ করে না। তাই যাচাই করা সম্ভব হয় না।

এদিকে স্বাস্থ্য বিভাগের ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিচালক ডা. শাহ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, টাকা নেওয়ার বিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি