X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফেসবুক নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান–কোন পথে রাজনীতি

মোস্তফা হোসেইন
২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:৫৩আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:৫৪

মোস্তফা হোসেইন বাংলাদেশের রাজনীতি কি করোনায় আক্রান্ত? এমন প্রশ্ন করাটা কতটা শোভন, তারপরও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক স্থবিরতা দেখে তেমনটাই মনে হতে পারে। স্থবিরতার জন্য দোষ দেওয়া হচ্ছে করোনাকে। বলা হচ্ছে, করোনার কারণে দলগুলো জনসংযোগ করতে পারছে না। গতানুগতিক জনসংযোগের কথা ভাবলে এর যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু ঘরের বাইরে যাওয়া যায় না বলে জনসংযোগ করা যাচ্ছে না, এটা কি মেনে নিতে হবে? বিকল্প পথগুলো কি গ্রহণ করছে রাজনীতিবিদগণ? আমার মতে করোনাকালীন গৃহবাস বরং জনসংযোগের সুযোগ বৃদ্ধি করে দিয়েছে। অন্তত ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে অনেক বেশি। আর এক্ষেত্রে জনসভা কিংবা মিছিলের চেয়েও অধিক সুবিধা তৈরি হয়েছে এই মুহূর্তে। জনসভা কিংবা মিছিলে শুধু নিজেদের নেতাকর্মী থাকেন। কথা হয় একতরফা। নেতা কথা বলেন, কর্মী তা শুনেন। নেতার বক্তব্যের জবাবে কর্মীর কথা শোনার কোনও সুযোগ নেই। অথচ, নেতা যা ভাবেন কিংবা যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন তা অনেক সময় কর্মীর ভালো নাও লাগতে পারে। জনসভায় সেটি কর্মীকে শুনতে হয় বিনাবাক্য ব্যয়ে। কর্মীর মনের কথা নেতাকে জানাতে পারেন না। যদিও সমাবেশে নেতাকর্মী সামনাসামনি বসেন, হাতছোঁয়া দূরত্বে হলেও তাদের মনোভাব জানানোর সুযোগ একবারেই থাকে না। 

অথচ প্রযুক্তি তার চেয়ে অধিক কার্যকর সুবিধা রাজনীতিবিদদের করে দিয়েছে। পৃথিবীজুড়ে এখন রাজনীতিতে এই ভূমিকা পালন করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে টুইটার ও ফেসবুক। এটা বলার সুযোগ নেই পিছিয়ে পড়া দেশ হিসেবে আমাদের সেই সুযোগ সীমিত। অন্তত ফেসবুক ব্যবহারকারীর পরিসংখ্যান তা বলে না। ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত বিবিসি সংবাদে দেখা যায় পৃথিবীতে ফেসবুক ব্যবহারকারী শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঢাকা ও আশেপাশের এলাকার ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। শহর হিসেবে ব্যাংককের পরই ঢাকার অবস্থান। সুতরাং রাজনীতিকে প্রযুক্তির দুয়ারে নিয়ে যেতে পারলেই হলো। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে এখানে টুইটারের ব্যবহার ততটা এগিয়ে যায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, একটা দেশের রাজধানী ও তার আশেপাশের এলাকাতেই যদি প্রায় সোয়া দুই কোটি লোক ফেসবুক ব্যবহার করে তাহলে জনসংযোগের জন্য এই মাধ্যমটি যে সর্বোত্তম উপায় হতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

রাজনীতিতে বিশেষ করে নির্বাচনে যে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কতটা ভূমিকা পালন করে, তার প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রায় সব জরিপেই দেখা গিয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান দুর্বল। কিন্তু ফলটা কী হয়েছে সে তো সবাই জানেন। এর পেছনে যে ‘দিস ইজ মাই ডিজিটাল লাইফ’ নামক ফেসবুক অ্যাপ বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল, তা সর্বজনবিদিত। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক আলেক্সান্ডার কোগানের তৈরি অ্যাপটি নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। 

যারা আরব বসন্তকে সামনে আনেন তাদের কথা নাই বা বললাম। আমাদের দেশেও কি এর প্রমাণ নেই? শাহবাগ আন্দোলনে যে জোয়ার তৈরি হয়েছিল, লাখ লাখ তরুণ সেদিনে কোনও নেতা ছাড়াই একত্রিত হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে। আসলে সেটা হয়েছিল একটা আবহ তৈরি হওয়ার কারণে। এবং সেটার মূল নিয়ামক শক্তি ছিল ফেসবুক। শাহবাগের সেই ঘটনা সামনে আনলে ধরে নিতে হবে এখানকার ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এই মাধ্যমকে শুধু সময়ক্ষেপণের জাদুবাক্স হিসেবেই গ্রহণ করে না, তাদের মতামত প্রকাশ ও তার প্রয়োগও করতে চায়। আর জনসংশ্লিষ্ট বিষয় ধরিয়ে দিতে পারলে মানুষ যে কারও ডাকেই সাড়া দিতে প্রস্তুত। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে তো সাংগঠনিক সুবিধা তার জন্য আরও সুবিধার।

এমন উদাহরণ অনেকই দেওয়া যায়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো-নেতারা সেই বড় মাধ্যমটিকে কীভাবে ব্যবহার করছেন? বড় দুটি দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আমার ফেসবুক সংযোগ আছে। একটি দলের স্থায়ী কমিটির দুইজন নেতাকে বড় আশা করে বছর কয়েক আগে বন্ধু তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। মনে করেছিলাম তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং চিন্তাভাবনাগুলো এর মাধ্যমে জানতে পারবো। ভাগ্য ভালো হলে হয়তো ব্যক্তিগতভাবেও যোগাযোগ করতে পারবো। একজন সদস্য বার্ধক্যজনিত কারণে খুবই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন এখন। কিন্তু তিনি যখন টেলিভিশনে জোরালো গলায় অভিযোগ করতেন, তাদের কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না, তখনও তাকে ফেসবুকে দেখা যায়নি। বলতে কি কয়েক বছর অলস পড়ে থাকা আইডিটি আমাকে একসময় ব্লক করে দিতে হয়েছে, সক্রিয় ব্যবহারকারীদের স্বাগত জানাতে গিয়ে। 

স্থায়ী কমিটির আরেকজন সদস্যকে ইনবক্স করেছিলাম, সক্রিয় হওয়ার জন্য। তারও কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। তার মানে ফেসবুক আইডি খুলেই ওই দরজা তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি কোনও পোস্ট দিয়েছেন এমনটাও আমার চোখে পড়েনি। 

সম্প্রতি ওই দলটির অঙ্গসংগঠনের প্রধানকে অ্যাড করেছি। মনে হচ্ছে তার সহযোগী কিছুটা সক্রিয়। মাঝে মাঝে হাই হ্যালো হচ্ছে। ব্যক্তিগত পরিচয় থাকার কারণে আশা করেছিলাম মাঝে মাঝেই হয়তো আলাপ-সালাপ হবে। কিন্তু এইটুকুই।

এদিক থেকে সরকারি দল এগিয়ে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাতনয় সজীব ওয়াজেদ জয়ের ফেসবুক ব্যবহারকে বিপ্লবী ঘটনা বললেও বোধ করি বাড়িয়ে বলা হবে না। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ ফেসবুক মাধ্যমে রীতিমতো পল্টন, রেসকোর্সের সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। দুজনেরই পোস্টের প্রতিক্রিয়া শুধু সংখ্যাগত দিক থেকেই নয়, সংবাদমূল্য হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। আমরা প্রায়ই তাদের পোস্টকে মূলধারায় সংবাদ হতেও দেখি। আলোচনা সমালোচনার ক্ষেত্রও তৈরি করে তাদের ফেসবুক বক্তব্যগুলো। জুনাইদ আহমেদ পলকেরও বড় একটি ফেসবুক বন্ধু সংখ্যা রয়েছে। তারা প্রতিক্রিয়াও জানায়। 

এক্ষেত্রে ডিজিটাল আইনের ভয়ের কথা কেউ কেউ বলতে পারেন। বাস্তবতা হচ্ছে—ব্যক্তিগত আক্রমণ পরিহার করে চললে এবং নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর মতামত প্রকাশে কোনও বাধা আছে বলে মনে করি না। এখন ফেসবুক মাধ্যমে যদি উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ আইনের আশ্রয় নিতেই পারে। 

বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের রাজনীতিবিদগণ সনাতন পদ্ধতির বাইরে আসতে চান না। এখনও তারা স্বপ্ন দেখেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শোডাউন করবেন, বক্তৃতা দিয়ে মাঠ কাঁপাবেন। বলতে দ্বিধা নেই, তাদের জন্য সামনেও সুখবর নেই। করোনা বিদায় হলেও জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কোনও সমাবেশ আর মানুষ পছন্দ করবে না। মিছিলকেও মানুষ সাদরে গ্রহণ করবে না। গতানুগতিক ধারার রাজনৈতিক আচরণ পরিহার করতে না পারলে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। মনে রাখতে হবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ ট্রাম্পকেও ‘দিস ইজ মাই ডিজিটাল লাইফ’ এর সহযোগিতা নিতে হয়। এটা যুগের পরিবর্তনে অপরিহার্য। 

যারা জনসভা মাধ্যমে বক্তৃতা করার অপেক্ষায় আছেন তাদের নতুন করে ভাবতে হবে। পুরনোকে আঁকড়ে থাকার পরিণতি শুভ হবে, এমন ভাবা ঠিক হবে বলে মনে করি না। 

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজধানীকে সুন্দর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: আইইবি
রাজধানীকে সুন্দর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: আইইবি
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ