X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যিশুলগ্নে শিশুসাহিত্য, আমাদের চিত্র কী?

দাউদ হায়দার
২২ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:৩৭আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:৩৯

দাউদ হায়দার শুনেছি বাড়ির বয়স্কদের মুখে, দেশ ভাগের আগে তাঁরা, পুজোর সময় কলকাতায় যেতেন দু’টি কারণে। বৌ-মেয়েদের জন্য কাপড় কিনতে, নিজেদের জন্যে ‘শান্তিপুরী’ ধুতি কিনতে (১৯৪৭ সালের পরে মুসলিমরা ধুতির বদলে লুঙ্গিকেই নিজস্ব পোশাক মনে করেছেন।) এবং ছোটদের জন্যে পুজো সংখ্যা।
বাড়িতে দেখেছি পুরোনো দিনের পুজো সংখ্যা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী (পাকিস্তানি মিলিটারি) আমাদের পাবনার বাড়ি আক্রমণ করে, পুড়িয়ে দেয়। ছোট চাচার ঘরে আগুন দেয়নি। ওই ঘরে ছিল রবীন্দ্রনাথের ছবি, ফ্রেমে বাঁধা। আপদ ঢাকা জোব্বা পরা আলখেল্লা। মাথায় টুপি। মুখভর্তি দাঁড়ি। পাক হানাদার বাহিনী ছবি দেখে নিশ্চয় ভেবেছিল কোনও পরহেজগার হুজুর বা হাজি বা দরবেশ। সাচ্চা মুসলমান। অন্য ঘরে ছিল কোরআন, আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে। পুড়ে যায় রবীন্দ্র রচনাবলি। বহু বাংলা বই। মৌচাক, শুকতারা (ছোটদের পত্রিকা। বাঁধানো পুজো সংখ্যা।)। আমাদের ব্যথিতচিত্ত, অকহত্য। ‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে’ (অমিয় চক্রবর্তী)।
বয়স্কদের আফসোস শুনেছি, ‘তোরা হতভাগা। ছোটদের জন্য কী সব দারুণ পুজো সংখ্যা ছিলো রে!’ বেশি বলতেন চাচা।

—‘‘আজ নেই। এখন শিশুসাহিত্যের নামে আবোলতাবোল, সুস্বাদু, শিশুকিশোরপাঠ্য পুজো সংখ্যাও নেই। শিশুকিশোর মনের ‘বয়স্ক’ লেখকরাও নেই। শিশুকিশোরদের জন্যে যা লেখা হয়, শিশুকিশোর কেন, যুবক-যুবতী মায় আমরা বুড়োরাও বুঝি না।’’—এই আক্ষেপ সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

কে এই সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, অনেকেরই অজানা, অচেনা এখন। ছোটদের এবং বড়োদের জন্য বিস্তর গল্প, রম্যরচনা লিখেছেন। অবশ্যই সুপাঠ্য। সুপ্রিয় ছিলেন মার্কিন তথ্যসংস্কৃতি বিভাগের (ইউএসআইএস) পূর্বাঞ্চলের (পূর্ব ভারতীয়) শাখার অধিকর্তা। সদর দপ্তর ৭ নম্বর চৌরঙ্গি, জওহরলাল নেহরু রোড, কলকাতা।

ইউএসআইএস-এর নাম এখন ভিন্ন। ঠিকানাও বদল।

সুপ্রিয়র ৭ নম্বর যতীন বাগচী রোডের বাড়িতে দেখেছি পুরোনো কালের শিশুকিশোর সাহিত্যের পুজো সংখ্যা। বাঁধাই। স্বর্ণখনি যেন।

“শিশুরা (বয়স ৩ থেকে ৫/৭) সাহিত্য পড়ে না, পড়ে শোনাতে হয়। ঘুম পাড়াতে হয়।” বলতেন সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়।

ইদানীং উল্টো কালচার। ৫/৮ বছরের শিশুরা বই পড়ার চেয়ে কম্পিউটার গেমে উস্তাদ। অনতি কিশোর-কিশোরী আরো ইঁচড়েপাকা। স্মার্টফোনে কত রকম প্রোগ্রাম, সব কারিকুরি জানে।

তিন বছর আগে বার্লিনের একটি টিভি চ্যানেলে দেখেছিলুম, চার গন্ডা শিশুদের নিয়ে অনুষ্ঠান, বয়স যাদের ছয় থেকে আট, বলা হয় এক পৃষ্ঠা লিখতে (হাতের লেখা)। পরিচালক বই থেকে পাঠ করেন। মাত্র দুই জন লিখলে। ভুল, শুদ্ধ। বাকিদের মুখ কাঁচুমাচু। হাত কামড়ায়। কিন্তু যখন কমপিউটার দেওয়া হলো, পরিচালক পাঠ করলেন, কয়েক মিনিটের মধ্যেই লিখে ফেললো।

এই অনুষ্ঠান প্রচারের পরেই পিতৃমাতৃকুলে, নানা মহলে হাহাকার ধ্বনি। চূড়ান্ত সর্বনাশ। স্কুলে-স্কুলে বাধ্যতামূলক নিয়ম হলো, ১২ বছর পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীকে হাতে লিখে খাতা ভর্তি করতে হবে। কম্পিউটার ব্যবহার চলবে না। নিষেধাজ্ঞা কতটা মান্য, বলতে অপারগ।

তবে, একটি বিষয় নজর কাড়ছে অনেকের। গত কয়েক বছরে শিশুতোষ সাহিত্যের প্রকাশ বিস্তর।

শিশুতোষ সাহিত্য বলতে ছড়া-কবিতা-গল্প-উপন্যাস, কার্টুন-কমিকস নয় শুধু, চাঁদ-তারা-নভোমণ্ডল, খেলাধুলো, পশুপাখি, গাছপালা, সমুদ্র, তথা প্রকৃতিপরিবেশ নিয়ে বই। পাতায়-পাতায় অঙ্কন, ফটো। রঙিন। শিশুকে শিশুর জগতে ফিরিয়ে নেওয়া। শিশুরাও মশগুল। বাবা মায়ের সঙ্গে বইয়ের দোকানে যাচ্ছে, বাবা মাকে বই কেনাতে বাধ্য করছে।

বার্লিনে কয়েকটি বড়ো বইয়ের দোকান আছে। দোকানে শিশুদের জন্যে আলাদা জায়গা। ঘর। ঘরে শিশুদের জন্য নানা ধরনের বই। সাজানো। ছড়ানো-ছিটানো। শিশুরা নেড়েচেড়ে দেখছে। পছন্দমতো কিনছে।

আরো কান্ড। শিশুদের ঘরে দুই জন পাঠক (নারীপুরুষ) বই থেকে পাঠ করেন (অনেকটাই অভিনয় করে), শিশুরা পাঠে অভিনয়ে মুগ্ধ, ওই বই বা অন্য বই (পছন্দের) কিনে মহাখুশি।

আসলে এও এক ব্যবসা। হোক তা, শিশুকে বইপাঠে উদ্বুদ্ধ করাই মূল উদ্দেশ্য, এবং সফল।

আমাদের দেশে পুজোয় বা ঈদে দুই চারটে পত্রিকা প্রকাশিত হয় ‘ছোটদের’ জন্য। ছোট কারা, কতজন ‘ছোট’ পাঠক, এই প্রশ্ন ব্যতিরেকে জানতে ইচ্ছে করে কী ধরনের লেখালেখি। ছোটদের জগৎ কতটা প্রাপ্য। তারাপদ রায় (নাকি অন্য কেউ? সঠিক মনে পড়ছে না) লিখেছেন, ‘শিশুরা জন্মেই বড়ো হয়ে যায়, শিশুরা শিশুসাহিত্য পড়ে না, আমরা লিখি না, লিখতে পারি না।’—হুবহু উদ্ধৃতি নয় হয়তো, বয়ান প্রায় যথাযথ।

শিশুসাহিত্যের কী করুণ অবস্থা, আজকের শিশুসাহিত্য পড়লেই স্পষ্ট। অথচ বইমেলায় বহু প্রকাশক শিশুদের জন্যে বই প্রকাশিত করেন। ‘কত রঙ্গ-ভরা এই বঙ্গ।’

আরও রঙ্গ ঢাকায়, বাংলাদেশে। ‘শিশু একাডেমি’ নামে সরকারি প্রতিষ্ঠান। শিশু একাডেমি থেকে শিশুদের জন্য বই প্রকাশিত। অতীব অপাঠ্য। না শিশুদের, না ‘পোলাপানদের’। শিশু একাডেমি আবার শিশুসাহিত্যের জন্যে পুরস্কারও দেয়। ঢাকাইয়া কুট্টিরা বলেন ‘অ্যালায় বোজো’ (এখন বোঝো)।

ইউরোপে, যিশুলগ্নে (খ্রিস্টপর্বে), নভেম্বরের গোড়াতেই শিশুপাঠ্য বই বাজারে সুলভ। বিক্রি যথেষ্ট। ক্রেতা শিশুর পিতামাতা এবং স্কুল (কিন্ডার গার্টেন)।

সুইস লেখক মাক্স ফ্রিশ লিখেছেন, ‘আমার সন্তানাদি যখন ছোট, যিশুলগ্ন এলেই (নভেম্বরের গোড়ায়) নতুন বইয়ের জন্যে ঘ্যান ঘ্যান করতো। ওদের নিয়ে ওদের পাঠযোগ্য বই কিনতে নানা বুক স্টলে ঘুরে ঘুরে নিজেও শিশু হয়ে যেতাম।’

মাক্সেরই অন্য একটি লেখায় পড়েছি, ‘সব ধর্মীয় কালচারই মূলত এথনিক কালচার। এই কালচারে যে আনন্দ উৎসব, ছোটদের কাছেই বেশি উপভোগ্য, বেশি আনন্দের। ছোটদের কাছে আনন্দই পয়লা, ধর্ম নয়। আমার শৈশবও ছিল ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে। শৈশবে কোনো ধর্মবোধ হয় না। ধর্মহীন বিশ্বই মানবিক।’

মাক্স ফ্রিশের নাম ছয় বার নোবেল পুরস্কারের শর্ট লিস্টে, পাননি। কেন তিনি বঞ্চিত, বহু সমালোচনা। ওঁর সঙ্গে দুই বার দেখা, ১৯৮৭ সালে, যখন জুরিখে ছিলুম, সুইস একাডেমির আতিথ্যে।

“ইউরোপে শিশুসাহিত্যের জন্যে ‘যিশুলগ্ন’ আছে, আমাদের সাহিত্যে শিশুদের জন্যে পর্ব, মাস নেই।” অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন একবার।

যিশুলগ্ন কেন ‘বড়োদিন’ বলা হয় আমাদের দেশে, অজানা। দিনটি খুবই ছোট। এদেশে। এক ঘণ্টা সময় কম। বার্লিন তথা জার্মানি, ইউরোপে, যিশুলগ্নই ছোটদের কাছে বড়োদিন। নিত্যদিন আনন্দে দিশেহারা। ধর্মের বালাই নেই। নানা দেশ, জাতিধর্ম, নানা ‘কালার’ সত্ত্বেও।

 

/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ