X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বোমার সঙ্গে বসবাস

শান্তনু চৌধুরী
০১ নভেম্বর ২০১৯, ১৬:০০আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:০৩

শান্তনু চৌধুরী সুমন চট্টপাধ্যায়ের গান ‘হাউজ দ্যট’-এর প্রথম দু’টি লাইন মনে পড়লো রাজধানীর মিরপুরের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের নিহত ছয় শিশুর অভিভাবকদের আহাজারি দেখে।  ‘বাহ-বাহ, সাবাস, বড়দের দল এই তো চাই/ ছোটরা খেলবে আসুন আমরা বোমা বানাই।’  সাধারণের মনে হতে পারে, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারা যাওয়া আর বোমায় মারা যাওয়া কি এক হতে পারে? বিতর্ক না করেই বলা যায়, দুটোই এক। কারণ, অবহেলাজনিত কারণে দেশের এক একটা সিলিন্ডার এখন এক একটা বোমায় পরিণত হয়েছে। সেটা বেলুন ফোলানো, গাড়ি বা রান্না করার সিলিন্ডারই হোক না কেন। সুমনের গানের ছোটদের মতো রূপনগরের শিয়ালবাড়ির মাতবর বস্তির নূপুর, জান্নাত, সিয়াম বা রিয়ামণিরও কোনও দোষ ছিল না। তারা ছুটে গিয়েছিল বেলুনওয়ালার কাছে। প্রতিদিন যেমন যায় আর কী! তারা ঘিরে ধরে ‘বেলুন মামা’কে। এরপর বেলুনওয়ালা খেলনাপণ্য বেলুন ফোলাতে গিয়েই ঘটে বিস্ফোরণ। একে একে ঝরে পড়ে বেলুনওয়ালাসহ সাতটি তাজা প্রাণ। যারা হাসপাতালে আছে তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এখনও পরিবারের অনেক সদস্য জানেন না তাদের প্রিয় শিশুটি মারা গেছে, জানেন হাসপাতালে ভর্তি। অনেকের বইপত্র খেলনার জিনিস এখনো আগোছালো, এখানে সেখানে পড়ে আছে। স্বজনদের মাতম থামছেই না। এই দায় কি প্রশাসন এড়াতে পারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কোন প্রশাসনকে দায় দেবো? ঘটনার দিনই সংবাদমাধ্যমগুলোতে দেখলাম ‘এ বলে ওর দায়, সে বলে তার।’

চলতি বছরের শুরুতে যদি চকবাজারের চুড়িহাট্টা ট্রাজেডির কথা বলি, সেখানে ৭৮ জন মানুষের প্রাণহানি কিন্তু কাঁদিয়েছিল পুরো দেশ তথা বিশ্বকে। ওই সময় আগুনের প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই বলেছেন, দুর্ঘটনার সময় প্রথমে একটি গাড়ির সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে। সেই সিলিন্ডার থেকে আরও কয়েকটি গাড়ির সিলিন্ডারে আগুন ধরে যায়। এরপর পাশের হোটেল এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারে আগুন লাগে। এরপরই বাড়ির ভেতরে থাকা কেমিক্যালে আগুন ধরে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বছরের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় রোগী বহনকারী একটি অ্যাম্বুলেন্সের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে একই পরিবারের তিনজন মানুষ মারা যান। তিনজন গুরুতর আহত হন। পরিসংখ্যান বলছে, গেলো পাঁচ বছরে কেমিক্যাল বা সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এমন ঘটনা ঘটেছে কম করে হলেও হাজারটি। এসব ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন আড়াই শ’র বেশি মানুষ। কিন্তু এসব মানবিক বিপর্যয়ে প্রশাসন সাময়িক সময়ের জন্য তৎপর হলেও পরে তা স্তিমিত হয়ে গেছে। এই যেমন এখন মিরপুরে যদি এত প্রাণহানির ঘটনা না হতো, তবে বিষয়টি আরও আড়ালে চলে যেতো। ওপরে যে পরিসংখ্যানটি দেওয়া হলো তা সংবাদপত্রের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই এসব কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর কাছে। সেই থেকেও বোঝা যায়, বিষয়টি গুরুত্বই পাচ্ছে না কর্তৃপক্ষের কাছে। ফায়ার সার্ভিসের ডিজি সংবাদমাধ্যম গুলোকে বলেছেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, আমরা বলেই যাচ্ছি, কিন্তু দেখার কেউ নেই।’ বাংলা ট্রিবিউনের এক রিপোর্টে বিশেষজ্ঞদের উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘‘নিরাপদ হিলিয়ামের পরিবর্তে ‘নিষিদ্ধ’ হাইড্রোজেন ব্যবহারের কারণে বছরের পর বছর ঘটছে গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। এতে বাড়ছে শিশুদের প্রাণহানিও। ২০০ বছর আগে বিশ্বের অন্যান্য দেশে হাইড্রোজেন দিয়ে বেলুন ফোলানোর ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে।’’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে এসব বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেই। বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘যে উপায়ে গ্যাস সিলিন্ডারে হাইড্রোজেন তৈরি করা হয় তা অন্যায়। সংশ্লিষ্টদের ধরার জন্য পুলিশকে বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গ্যাস সিলিন্ডারের নির্দিষ্ট আয়ু থাকে।’ সরকারের বিস্ফোরক অধিদফতরের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডারের আয়ু ১০ থেকে ১৫ বছর। এই সময় পরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। তাই আয়ু শেষ হলে সেগুলো বাতিল করা উচিত। এই সহজ হিসাবটাই রাখেন না অনেক ব্যবহারকারী। মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারে যেকোনও মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। মেয়াদ পেরুনো সিএনজি সিলিন্ডার মানেই এখন জীবন্ত গ্যাস বোমা। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ গাড়ির সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা ছাড়াই বা মেয়াদ উত্তীর্ণভাবে চলছে। এসব সিলিন্ডারের প্রত্যেকটি এক-একটি ভয়ঙ্কর গ্যাস বোমা। তার মানে বলা যায়, রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি এক একটি বোমা নিয়ে ঘুরছে। এই বোমা বিস্ফোরণের কারণে গাড়ি বা সিলিন্ডারের সামনে থাকা মানুষজন তো মরবেই, আশেপাশে মানুষরাও বেঁচে থাকবে না। মিরপুরের মতো অনেকের হাত পা উড়ে যাবে, ছিঁড়ে যাবে। দীর্ঘদিনের পুরনো সিলিন্ডার ব্যবহার করায় গাড়িচালক ও ব্যবহারকারী নিজেই জানেন না তার গাড়িটি বিপজ্জনক বোমা হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে প্রচারেরও অভাব রয়েছে।

জানা গেছে, প্রতিটি গাড়ির সিএনজি সিলিন্ডার রি-টেস্টিং জন্য দু-তিনদিন সময় লাগে। এছাড়া রিটেস্টিং করাতে গেলে ২০ থেকে ৪০ লিটারের প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য দুই হাজার টাকা, ৪০ থেকে ৬০ লিটারের প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য আড়াই হাজার টাকা, ৬০ থেকে ৮০ লিটারের প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য তিন হাজার টাকা এবং ৮০ লিটারের বেশি প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। এ কারণে গাড়ির মালিকরা এ প্রক্রিয়াকে বাড়তি খরচ ও সময় নষ্ট বলে মনে করেন। ২০০৫ সালের সিএনজি বিধিমালা অনুযায়ী, পাঁচ বছর পরপর সিএনজিচালিত যানবাহনের সিলিন্ডার পরীক্ষা করা বাধ্যবাধকতামূলক। পরীক্ষায় ত্রুটি ধরা পড়লে নতুন সিলিন্ডার বসাতে হবে। কিন্তু যারা এই রি-টেস্টিং করেন তাদের বেশিরভাগেরই তথ্য হচ্ছে, যে পরিমাণ সিলিন্ডার আছে তার মাত্র ২০ শতাংশ রি-টেস্টিং করা হয়। অর্থাৎ প্রায় ৮০ শতাংশ গাড়ি রি-টেস্টিং ছাড়াই বছরের পর বছর চলছে। কিন্তু এই চলন্ত বোমা বা গাড়িবোমা বা সিলিন্ডার বোমা থেকে বাঁচতে হলে এদেশে প্রথম উপায় হচ্ছে পুনঃপরীক্ষা করা। এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে সরকারকে। এ ব্যাপারে একটি শক্ত আইনি কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। সরকার যখন রান্নার কাজে এলপিজি গ্যাসের ব্যবহার বাড়াতে চাইছে সেক্ষেত্রে এটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সিলিন্ডারের মেয়াদ পর্যবেক্ষণ, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বদল ও ত্রুটিযুক্ত সিলিন্ডার বাতিলের পদক্ষেপ নিতে দেরি করার কোনও সুযোগ নেই। একইসঙ্গে সারাদেশে জরুরিভাবে ত্রুটিপূর্ণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারগুলো চিহ্নিত করা দরকার। ঝুঁকি কমাতে নিম্নমানের সিলিন্ডার আমদানি বন্ধ ও অবৈধ কনভারশন সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে, বাজারে গুণগত সিলিন্ডার আসছে না। গাড়িগুলো সিলিন্ডার সঠিক সময় পরীক্ষা করছে না। মান ঠিকমত যাচাই হচ্ছে না। ফিটনেস দেখা হচ্ছে না। এসব নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। তারা অবৈধভাবে সুবিধা দিয়ে থাকেন। এতে এদিকে মানুষের জীবন যাচ্ছে, জীবন রক্ষার অধিকার হারাচ্ছে জনগণ। তবে এ জন্য ভোক্তাদেরও হতে হবে সচেতন। আবার সরকারিভাবে সিলিন্ডার টেস্ট ও বদলে নেওয়ার সেবা চালু করা যেতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ