স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পূর্বপ্রস্তুতিতে বাংলাদেশের ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের দ্য স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ মুশতাক খান। তার মতে, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই উত্তরণ ঘটলে দেশি শিল্প খাত তীব্র প্রতিযোগিতায় পড়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ: প্রস্তুতি ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে মুশতাক খান এই আশঙ্কার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘উৎপাদন সক্ষমতা, শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক শক্তি ও নীতি সহায়তা— এসব ক্ষেত্রে প্রস্তুতির অভাব এখনও প্রকট।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো, বিশেষত ভারত চাইবে বাংলাদেশ দ্রুত এলডিসি তালিকা থেকে বেরিয়ে যাক, কারণ এতে তাদের লাভ। উত্তরণ পেছানোর বিষয়ে জাতিসংঘে আবেদন করলে— এসব প্রতিযোগী দেশ সেটি ঠেকানোর চেষ্টাও করতে পারে।’
উত্তরণের চ্যালেঞ্জ: বাণিজ্য, ঋণ ও মেধাস্বত্ব
মুশতাক খানের মতে, এলডিসি স্ট্যাটাস হারালে বাংলাদেশকে ইউরোপীয় বাজারে রফতানির ক্ষেত্রে শুল্ক দিতে হবে, বিদেশি ঋণের সুদের হার বাড়বে এবং ওষুধ শিল্প মেধাস্বত্ব ছাড় সুবিধা হারাবে।’ ইলেকট্রনিক্স, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও ওষুধ শিল্প এখনও প্রস্তুত নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমি কোনও প্রমাণ দেখছি না যে বাংলাদেশ প্রস্তুত।’
ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বর্তমানে নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে গেছে, যার ফলে স্বয়ংক্রিয় শুল্ক আরোপের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের “অকালীন উত্তরণ” নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বলে জানান তিনি।
উত্তরণ পেছানোর সুযোগ: জাতিসংঘে যেতে হলে কী করতে হবে
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা প্রধান ইশতিয়াক বারী জানান, ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ এলডিসি তালিকা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে যাবে। তবে ওষুধে মেধাস্বত্ব ছাড় ২০৩৩ সাল পর্যন্ত এবং কিছু বাণিজ্য সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত থাকবে।
ইশতিয়াক বারী বলেন, কোনও দেশ নিজের সিদ্ধান্তে উত্তরণ পেছাতে পারে না। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) কাছে আবেদন করতে হয় এবং সুনির্দিষ্ট যুক্তি দেখাতে হয়। এরপর সিদ্ধান্ত হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে।মুশতাক খান বলেন, তিনটি যুক্তি তুলে ধরে বাংলাদেশ উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন করতে পারে—
১. অকালীন উত্তরণে দারিদ্র্য বাড়ার আশঙ্কা, ২. ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক যুদ্ধ ও বৈশ্বিক বাণিজ্য অস্থিরতা ও ৩. দীর্ঘকালীন স্বৈরশাসনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এককভাবে আবেদন করলে সেটি প্রতিযোগিরা আটকে দিতে পারে। তাই নেপাল, ভুটানসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে ব্লক গঠন করে জাতিসংঘে যাওয়া উচিত।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ: উত্তরণ কি জনগণের সিদ্ধান্তে হওয়া উচিত?
বৈঠকে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্তটি জনগণের মতামতের প্রতিফলন হওয়া উচিত। ১৫ বছর দেশে গণতন্ত্র ছিল না। এখন গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে সংসদে বিতর্ক হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, অর্থনীতির যেসব পরিসংখ্যান তুলে ধরে সরকার এই উত্তরণে যাচ্ছে, সেগুলোর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ব্যাংক খাতের সংকট, রফতানি খাতে বৈচিত্র্যের অভাব, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা— সব মিলিয়ে এখনই উত্তরণের সময় নয়।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন— ফ্রান্সের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এএফডির কান্ট্রি ডিরেক্টর সিনথিয়া মেলা, প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম সোহেল, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের চেয়ারপারসন নুরিয়া লোপেজ, ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকসের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান এবং চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী মো. জাকির হোসেইন খান।