অর্থনীতির দুরবস্থা কাটাতে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের-আইএমএফের কাছ থেকে শর্ত মেনে ঋণ নেওয়া চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে। শর্তাবলি ঠিক করতে ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক ও আর্থিক সংস্কার এবং নীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশে সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইএমএফ মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ। প্রতিনিধি দলটি ব্যাংক খাতে সুশাসন আনা ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে।
বুধবার (২৬ অক্টোবর) অর্থ সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনসহ অর্থ বিভাগের বিভিন্ন উইংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছে প্রতিনিধি দল।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আইএমএফ এখনও পর্যন্ত কোনও শর্ত দেয়নি, তবে আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আইএমএফের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৃহস্পতিবার মিটিং করেছে। এছাড়া তারা আগামী ৩০ ও ৩১ অক্টোবর এবং ২ ও ৮ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করবে। আজ বিকাল ৩টা পর্যন্ত তিনটি বৈঠক হয়েছে। আরও তিনটি বৈঠক হবে।’
এর আগে গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ বিষয়ে আইএমএফের স্টাফ ও এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টরের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আর্থিক ও অর্থনৈতিক খাতে বেশ কিছু সংস্কারের সুপারিশ করা হয়। অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, সেসব সুপারিশ বা শর্ত এবারের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।
যদিও আইএমএফ কী কী শর্ত দিতে যাচ্ছে, এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কারভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে অতীতের উদাহরণ থেকে বলা যায়, যেকোনও দেশেই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফ নীতিগত কিছু সংস্কারের শর্ত দিয়ে থাকে। আইএমএফ ও বিশ্ব্যাংকের শর্ত মেনে বাংলাদেশে লোকসানের মুখে থাকা পাটকল বন্ধ করা হয়েছিল। আবার এসব সংস্থার পরামর্শে বাংলাদেশে ভ্যাট ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
এবার সফররত আইএমএফের দলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈঠকে বেশি আলোচনা হয়েছে আর্থিক খাতের সংস্কার প্রসঙ্গে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার সঙ্গে আর্থিক খাতের সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। বৈঠকগুলোতে উপস্থিত কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক ঋণের সুদহারের ওপর আরোপিত ক্যাপ প্রত্যাহার করা, মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা ও বাজার নির্ধারিত বিনিময় মূল্য নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছে আইএমএফ।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, সরকারের চাহিদা অনুযায়ী, সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার শর্ত হিসেবে নির্ধারিত সময়ের ৯০ দিনের মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি ঘোষণা করার শর্তারোপ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
এমনকি সরকারের নীতি সহায়তার অংশ হিসেবে বাড়তি সুবিধা পাওয়া কৃষি ও এসএমই খাতের ঋণের ক্ষেত্রেও একই শর্তারোপ করেছে সংস্থাটি।
তবে ‘৯০ দিনের বকেয়ার ওপর ভিত্তি করে ঋণখেলাপি’ ঘোষণা করতে নারাজ বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে লেখা এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, নতুন এই সংজ্ঞায়নের জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, কৃষি ও এসএমই খাতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের নীতি অনুসরণ করেই জাতীয় নীতিমালা পরিচালিত হয়।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, এক্সপেক্টেড ক্রেডিট লস (ইসিএল) ভিত্তিক প্রভিশন রুল বাস্তবায়ন করতে অন্তত পাঁচ বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অবশ্য আইএমএফের মতো বিশ্বব্যাংকও চায় আর্থিক খাতের সংস্কার। গত মাসে ঢাকায় সফরে আসা বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার অর্থমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে সংস্কারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহায়তা করার প্রস্তাব দেয় বিশ্বব্যাংক। ওই বৈঠকে ঢাকায় সফররত বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ও আবু ফরাহ মো. নাছেরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেন।
এদিকে কয়েক বছর ধরেই আলোচনা চলছে— ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে। কারণ, বাংলাদেশের প্রকৃত মন্দ ঋণ জ্ঞাত বা প্রকাশিত অঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। একের পর এক আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারি এবং ঋণখেলাপিদের বারবার সুযোগ দেওয়ার পর সেই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকায়।
২০১৯ সালে ব্যাংক খাত নিয়ে একটি রিপোর্টে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা হয়েছে। সংস্থাটির মতে, খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার তুলনায় দুই বা তিনগুণ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ হবে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ বর্তমানের বৃদ্ধি পাওয়া সংখ্যারও দ্বিগুণ। অনেকে বলছেন, প্রকৃত বিচারে তা চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
আইএমএফ ছাড়াও অনেকের মতে, বর্তমান সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেকোনও কারণেই হোক— খেলাপিদের নানা সুবিধা দিয়েছে, যার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখা গেছে।
জানা গেছে, আইএমএফ এখন বিভিন্ন শর্তারোপ করে বাংলাদেশকে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের দিকে নিতে চাচ্ছে। ব্যাসেল-৩ হলো আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সেক্টরে নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নতির উদ্দেশ্যে নির্ধারিত সংস্কার ব্যবস্থার একটি সেট।