আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অঙ্গনে আবারও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার শুল্কযুদ্ধ আবারও নতুন মাত্রা পেয়েছে, যার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। দুই পরাশক্তির পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ শুধু তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থাকে নতুন করে চাপের মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
সম্প্রতি চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশে উন্নীত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পাল্টা জবাবে মার্কিন পণ্যের ওপর চীনও ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করছেন, তাদের শুল্কনীতি ভালোভাবেই কাজ করছে। তবে বিনিয়োগকারী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ পরিস্থিতি এক গভীর মন্দার পূর্বাভাস। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে একদিকে আমদানি ব্যয় বাড়বে, অন্যদিকে রফতানি আদেশ ও মূল্য প্রাপ্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশ্ব বাণিজ্যের এই অস্থির পরিস্থিতি বিশেষভাবে প্রভাব ফেলতে পারে বাংলাদেশের ওপর, যা প্রধানত রফতানিনির্ভর একটি অর্থনীতি। তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিক, ইলেকট্রনিকস থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে চীনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল বাংলাদেশ। অপরদিকে, বাংলাদেশের প্রধান রফতানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ফলে এই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্বন্দ্ব সরাসরি ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নানামুখী চাপে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিতে?
বাংলাদেশের মতো দেশ, যার প্রধান রফতানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রধান আমদানি উৎস চীন; তাদের জন্য এই বাণিজ্যযুদ্ধ এক বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ। তৈরি পোশাক, চামড়া, ইলেকট্রনিকস ও প্লাস্টিক পণ্য রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি পণ্যের জন্য চীনের ওপর নির্ভরতা ব্যাপক।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, আর উচ্চ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের প্রতিযোগিতা কমে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এক প্রকার ‘মিডল ম্যান ট্র্যাপে’ পড়ে যেতে পারে; যেখানে রফতানি আদেশ স্থগিত, মূল্যছাড়ের চাপ এবং শুল্ক পুনর্নির্ধারণের মতো বাস্তবতা তৈরি হবে।
অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শুল্কযুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হবে, কাঁচামালের দাম বাড়বে এবং ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। এতে বাংলাদেশের পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, রফতানি আদেশ বাতিল হওয়া, মূল্যে ছাড় দিতে বাধ্য হওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কারণে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত রফতানি খরচ বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রের (আইটিসি) হিসাবে, কেবল যুক্তরাষ্ট্রের এই অতিরিক্ত শুল্কের ফলে বাংলাদেশ ২০২৯ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় হারাতে পারে।
আইটিসির নির্বাহী পরিচালক পামেলা কোক-হ্যামিল্টন মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্ববাণিজ্য ৩ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত তিনটি কৌশলের ওপর জোর দেওয়া। তা হলো পণ্যে বৈচিত্র্য, উচ্চমূল্য সংযোজন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা।
বিশ্লেষকদের মতে, একদিকে চীন থেকে কাঁচামাল সরবরাহে জটিলতা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিতে বাধা– এই দ্বিমুখী চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। তারা বলছেন, এখনই সময়, সমন্বিত কৌশল ও প্রস্তুতির। বাংলাদেশকে এখন থেকেই বিকল্প বাজার, নতুন বাণিজ্য অংশীদার ও উদ্ভাবনী কৌশলের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, না হলে বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশে সম্ভাব্য বড় ধাক্কা সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির উত্তেজনাপূর্ণ এই সময়ে বাংলাদেশ যদি এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতের ধাক্কা সামলানো কঠিন হবে। তিনি বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলতে থাকলে শুধু এ দুই দেশেরই নয়, পুরো বিশ্ব অর্থনীতি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, যার নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের মতো রফতানিনির্ভর দেশের জন্য এটি বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।
তিনি বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর করে এবং বাণিজ্যযুদ্ধ বন্ধ না হয়, তাহলে রফতানি খাত বড় ধাক্কার মুখে পড়বে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প, যা আমাদের রফতানির মূল চালিকাশক্তি, তা প্রতিযোগিতার বাইরে চলে যেতে পারে।
মহিউদ্দিন রুবেল আরও বলেন, ট্রাম্প সরকার ৯০ দিনের জন্য যে সময় দিয়েছে, সেটি আমাদের জন্য একটা সুযোগ। এই সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তভাবে ও বাস্তবসম্মত নেগোসিয়েশনে যেতে হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত এমন হতে হবে যাতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলতে থাকলেও বাংলাদেশ যেন সরাসরি ক্ষতির মুখে না পড়ে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য যদি এই পরিস্থিতিতে ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ কোনোভাবেই এর প্রভাব থেকে রেহাই পাবে না। আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই।
বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন শিগগিরই মেটার নয়। ফলে চীনের কিছু অর্ডার অন্য দেশে যাবে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের এমন নীতি নিতে হবে, যাতে এই শুল্কে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
রফতানিকারকদের মতে, নতুন শুল্ক চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত মার্কিন ক্রেতারা অর্ডার কমাতে পারেন। আবার যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি করে শুল্ক ছাড় পাবে, তারা ব্যবসা কেড়েও নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চলতি মাসের ২ তারিখে ৫৭টি দেশের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ বা তার বেশি হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের ওপর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। পরে ৭ এপ্রিল জারি করা আদেশে জানানো হয়, এই বাড়তি শুল্ক বিদ্যমান হারের সঙ্গে যোগ হবে। আপাতত তিন মাসের জন্য ওই বাড়তি শুল্ক স্থগিত করা হয়েছে। তবে আগের মতোই ১০ শতাংশ শুল্ক বহাল থাকছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের গড় শুল্কহার দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২৫ শতাংশ, যা বাজার প্রতিযোগিতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রস্তুতির তাগিদ
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের ওপর আরোপিত ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছে। এই সাময়িক স্বস্তির সুযোগ কাজে লাগাতে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ১২ এপ্রিল গুলশানে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) আয়োজিত ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক: করণীয় ও কৌশল’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বলা হয়, এই সময়কে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত আলোচনা জোরদার করা উচিত।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, এই সংকটে আমাদের চারটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। সেগুলো হলো– প্রভাব মূল্যায়ন, দরকষাকষির কৌশল, সরকারি-বেসরকারি ঐকমত্য ও প্রণোদনার সুযোগ পর্যালোচনা।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করেই আমাদের কৌশল নিতে হবে। একইসঙ্গে এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জও মাথায় রাখতে হবে।
বিজিএমইএ প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এই সংকট একটি সম্ভাবনাও তৈরি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের যে প্রস্তাব ছিল, বাস্তবায়নের সময় এখনই।
এফবিসিসিআই প্রশাসক হাফিজুর রহমান বলেন, এই পরিস্থিতিতে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে।
ওষুধ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের উদ্বেগও উঠে এসেছে আলোচনায়। এসিআই হেলথকেয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মুহিবুজ্জামান বলেন, ওষুধে শুল্ক যুক্ত হলে বড় ধাক্কা আসবে। দরকষাকষির মাধ্যমে ‘উইন-উইন’ সমাধান খোঁজা জরুরি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব বাণিজ্যে নতুন করে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক, রফতানিকারক ও ব্যবসায়ীদের উচিত এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া।
যেসব প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, বাংলাদেশকে এখনই কৌশলগত প্রস্তুতি নিতে হবে; যাতে শুল্কযুদ্ধের অভিঘাত সামাল দেওয়া যায়।
১. বাণিজ্যিক কূটনীতি জোরদার: যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে আলাদাভাবে উচ্চপর্যায়ের বাণিজ্য সংলাপ চালু রাখা এবং কৌশলগত অবস্থান তুলে ধরা দরকার।
২. বাজার বহুমুখীকরণ: ইউরোপ, জাপান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার উদীয়মান বাজারগুলোতে প্রবেশে কৌশল নিতে হবে।
৩. রফতানিতে প্রণোদনা ও সহায়তা: শুল্কের প্রভাবে যাতে রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য নগদ প্রণোদনা, করছাড় ও অন্যান্য সহায়তা বাড়াতে হবে। এছাড়া দর প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখতে রফতানিকারকদের করছাড়, নগদ সহায়তা ও পণ্যভিত্তিক শুল্কছাড় দিতে হবে।
৪. স্থানীয় উৎপাদনে জোর: চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে স্থানীয় কাঁচামাল ও শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো অপরিহার্য।
৫. বাণিজ্য ঝুঁকি বিশ্লেষণ ইউনিট বা ঝুঁকি পূর্বাভাস সেল গঠন: একটি কেন্দ্রীয় ‘বাণিজ্য ঝুঁকি বিশ্লেষণ সেল’ গঠন করে নিয়মিত শুল্ক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, বাজার বিশ্লেষণ এবং কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এই ইউনিট নিয়মিত আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিক তথ্য সরকারকে সরবরাহ করবে।
সম্প্রতি চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশে উন্নীত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পাল্টা জবাবে মার্কিন পণ্যের ওপর চীনও ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করছেন, তাদের শুল্কনীতি ভালোভাবেই কাজ করছে। তবে বিনিয়োগকারী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ পরিস্থিতি এক গভীর মন্দার পূর্বাভাস। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে একদিকে আমদানি ব্যয় বাড়বে, অন্যদিকে রফতানি আদেশ ও মূল্য প্রাপ্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশ্ব বাণিজ্যের এই অস্থির পরিস্থিতি বিশেষভাবে প্রভাব ফেলতে পারে বাংলাদেশের ওপর, যা প্রধানত রফতানিনির্ভর একটি অর্থনীতি। তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিক, ইলেকট্রনিকস থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে চীনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল বাংলাদেশ। অপরদিকে, বাংলাদেশের প্রধান রফতানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ফলে এই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্বন্দ্ব সরাসরি ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নানামুখী চাপে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিতে?
বাংলাদেশের মতো দেশ, যার প্রধান রফতানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রধান আমদানি উৎস চীন; তাদের জন্য এই বাণিজ্যযুদ্ধ এক বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ। তৈরি পোশাক, চামড়া, ইলেকট্রনিকস ও প্লাস্টিক পণ্য রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি পণ্যের জন্য চীনের ওপর নির্ভরতা ব্যাপক।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, আর উচ্চ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের প্রতিযোগিতা কমে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এক প্রকার ‘মিডল ম্যান ট্র্যাপে’ পড়ে যেতে পারে; যেখানে রফতানি আদেশ স্থগিত, মূল্যছাড়ের চাপ এবং শুল্ক পুনর্নির্ধারণের মতো বাস্তবতা তৈরি হবে।
অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শুল্কযুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হবে, কাঁচামালের দাম বাড়বে এবং ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। এতে বাংলাদেশের পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, রফতানি আদেশ বাতিল হওয়া, মূল্যে ছাড় দিতে বাধ্য হওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কারণে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত রফতানি খরচ বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রের (আইটিসি) হিসাবে, কেবল যুক্তরাষ্ট্রের এই অতিরিক্ত শুল্কের ফলে বাংলাদেশ ২০২৯ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় হারাতে পারে।
আইটিসির নির্বাহী পরিচালক পামেলা কোক-হ্যামিল্টন মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্ববাণিজ্য ৩ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত তিনটি কৌশলের ওপর জোর দেওয়া। তা হলো পণ্যে বৈচিত্র্য, উচ্চমূল্য সংযোজন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা।
বিশ্লেষকদের মতে, একদিকে চীন থেকে কাঁচামাল সরবরাহে জটিলতা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিতে বাধা– এই দ্বিমুখী চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। তারা বলছেন, এখনই সময়, সমন্বিত কৌশল ও প্রস্তুতির। বাংলাদেশকে এখন থেকেই বিকল্প বাজার, নতুন বাণিজ্য অংশীদার ও উদ্ভাবনী কৌশলের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, না হলে বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশে সম্ভাব্য বড় ধাক্কা সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির উত্তেজনাপূর্ণ এই সময়ে বাংলাদেশ যদি এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতের ধাক্কা সামলানো কঠিন হবে। তিনি বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলতে থাকলে শুধু এ দুই দেশেরই নয়, পুরো বিশ্ব অর্থনীতি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, যার নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের মতো রফতানিনির্ভর দেশের জন্য এটি বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।
তিনি বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর করে এবং বাণিজ্যযুদ্ধ বন্ধ না হয়, তাহলে রফতানি খাত বড় ধাক্কার মুখে পড়বে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প, যা আমাদের রফতানির মূল চালিকাশক্তি, তা প্রতিযোগিতার বাইরে চলে যেতে পারে।
মহিউদ্দিন রুবেল আরও বলেন, ট্রাম্প সরকার ৯০ দিনের জন্য যে সময় দিয়েছে, সেটি আমাদের জন্য একটা সুযোগ। এই সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তভাবে ও বাস্তবসম্মত নেগোসিয়েশনে যেতে হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত এমন হতে হবে যাতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলতে থাকলেও বাংলাদেশ যেন সরাসরি ক্ষতির মুখে না পড়ে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য যদি এই পরিস্থিতিতে ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ কোনোভাবেই এর প্রভাব থেকে রেহাই পাবে না। আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই।
বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন শিগগিরই মেটার নয়। ফলে চীনের কিছু অর্ডার অন্য দেশে যাবে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের এমন নীতি নিতে হবে, যাতে এই শুল্কে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
রফতানিকারকদের মতে, নতুন শুল্ক চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত মার্কিন ক্রেতারা অর্ডার কমাতে পারেন। আবার যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি করে শুল্ক ছাড় পাবে, তারা ব্যবসা কেড়েও নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চলতি মাসের ২ তারিখে ৫৭টি দেশের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ বা তার বেশি হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের ওপর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। পরে ৭ এপ্রিল জারি করা আদেশে জানানো হয়, এই বাড়তি শুল্ক বিদ্যমান হারের সঙ্গে যোগ হবে। আপাতত তিন মাসের জন্য ওই বাড়তি শুল্ক স্থগিত করা হয়েছে। তবে আগের মতোই ১০ শতাংশ শুল্ক বহাল থাকছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের গড় শুল্কহার দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২৫ শতাংশ, যা বাজার প্রতিযোগিতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রস্তুতির তাগিদ
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের ওপর আরোপিত ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছে। এই সাময়িক স্বস্তির সুযোগ কাজে লাগাতে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ১২ এপ্রিল গুলশানে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) আয়োজিত ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক: করণীয় ও কৌশল’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বলা হয়, এই সময়কে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত আলোচনা জোরদার করা উচিত।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, এই সংকটে আমাদের চারটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। সেগুলো হলো– প্রভাব মূল্যায়ন, দরকষাকষির কৌশল, সরকারি-বেসরকারি ঐকমত্য ও প্রণোদনার সুযোগ পর্যালোচনা।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করেই আমাদের কৌশল নিতে হবে। একইসঙ্গে এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জও মাথায় রাখতে হবে।
বিজিএমইএ প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এই সংকট একটি সম্ভাবনাও তৈরি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের যে প্রস্তাব ছিল, বাস্তবায়নের সময় এখনই।
এফবিসিসিআই প্রশাসক হাফিজুর রহমান বলেন, এই পরিস্থিতিতে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে।
ওষুধ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের উদ্বেগও উঠে এসেছে আলোচনায়। এসিআই হেলথকেয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মুহিবুজ্জামান বলেন, ওষুধে শুল্ক যুক্ত হলে বড় ধাক্কা আসবে। দরকষাকষির মাধ্যমে ‘উইন-উইন’ সমাধান খোঁজা জরুরি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব বাণিজ্যে নতুন করে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক, রফতানিকারক ও ব্যবসায়ীদের উচিত এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া।
যেসব প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, বাংলাদেশকে এখনই কৌশলগত প্রস্তুতি নিতে হবে; যাতে শুল্কযুদ্ধের অভিঘাত সামাল দেওয়া যায়।
১. বাণিজ্যিক কূটনীতি জোরদার: যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে আলাদাভাবে উচ্চপর্যায়ের বাণিজ্য সংলাপ চালু রাখা এবং কৌশলগত অবস্থান তুলে ধরা দরকার।
২. বাজার বহুমুখীকরণ: ইউরোপ, জাপান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার উদীয়মান বাজারগুলোতে প্রবেশে কৌশল নিতে হবে।
৩. রফতানিতে প্রণোদনা ও সহায়তা: শুল্কের প্রভাবে যাতে রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য নগদ প্রণোদনা, করছাড় ও অন্যান্য সহায়তা বাড়াতে হবে। এছাড়া দর প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখতে রফতানিকারকদের করছাড়, নগদ সহায়তা ও পণ্যভিত্তিক শুল্কছাড় দিতে হবে।
৪. স্থানীয় উৎপাদনে জোর: চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে স্থানীয় কাঁচামাল ও শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো অপরিহার্য।
৫. বাণিজ্য ঝুঁকি বিশ্লেষণ ইউনিট বা ঝুঁকি পূর্বাভাস সেল গঠন: একটি কেন্দ্রীয় ‘বাণিজ্য ঝুঁকি বিশ্লেষণ সেল’ গঠন করে নিয়মিত শুল্ক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, বাজার বিশ্লেষণ এবং কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এই ইউনিট নিয়মিত আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিক তথ্য সরকারকে সরবরাহ করবে।