X
শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫
৪ বৈশাখ ১৪৩২

যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্কারোপ কার্যকর, পোশাক খাতে বড় ধাক্কার শঙ্কা

গোলাম মওলা
০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৫০আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:০৫

বিশ্ববাণিজ্যে আলোড়ন তুলেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ‘পাল্টা’ শুল্ক-নীতি। বাংলাদেশ সময় বুধবার (৯ এপ্রিল) সকাল ১০টা ১ মিনিট (স্থানীয় সময় ১২টা ১ মিনিট) থেকে এ শুল্ক কার্যকর হয়েছে। এই সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকা বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক প্রযোজ্য হবে, যদি না সেই পণ্য ৯ এপ্রিলের আগে জাহাজে উঠিয়ে চূড়ান্ত গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের আওতায় বিশ্বের প্রায় সব দেশের রফতানি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল ট্রাম্প চীনের ওপর আরোপিত শুল্কহার আরও বাড়িয়ে ১০৪ শতাংশে উন্নীত করেছেন।

ট্রাম্প তার ঘোষণায় বলেন, ২ এপ্রিল থেকে তিনি ৬০টি দেশকে ‘বড় অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন— যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে উচ্চশুল্ক আরোপ করে আসছিল। সেই তুলনায় তাদের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক কম ছিল। তাই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে এসব দেশের ওপর ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত নতুন শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

এতে করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রফতানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। ক্রেতাদের চাপে পড়েছেন আমদানিকারকেরাও। নতুন এই শুল্কনীতি ইতোমধ্যে বৈশ্বিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে এবং অনেক দেশ মার্কিন বাজারে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর রফতানি বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নতুন করে হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, এই অনিশ্চয়তার মধ্যে কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান রফতানি আদেশ স্থগিত করেছে। ফলে উৎপাদন ও রফতানি পরিকল্পনায় বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও জুতা রফতানি খাতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। শুল্ক হার ৩৭ শতাংশে উন্নীত হওয়ায় মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশি রফতানিকারকদের ওপর মূল্যছাড়ের চাপ বাড়িয়েছেন, কেউ কেউ কার্যাদেশ স্থগিতও করেছেন। খাত-সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, মার্কিন বাজারে কার্যাদেশ স্থগিত ও মূল্যছাড়ের দাবি নিয়ে চাপ বাড়াতে শুরু করেছে কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এতে দেশের পোশাক রফতানি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা।

বিভিন্ন রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ব্র্যান্ড রেডি-টু-শিপ পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দাবি করছে। এক রফতানিকারক  জানিয়েছেন, একটি মার্কিন ব্র্যান্ড ৩ দশমিক ৩ শতাংশ করে ছাড় দিতে বলেছে; সরবরাহকারী, কাপড় সরবরাহকারী ও খুচরা বিক্রেতা—এই তিন পক্ষকে।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘কয়েকজন মার্কিন ক্রেতা বাংলাদেশি রফতানিকারকদের পণ্যের দাম কমাতে বলেছে, যদিও এখনও বিস্তারিত জানানো যাচ্ছে না।’

যে কারণে রফতানি আদেশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা

আগে নির্দিষ্ট এইচএস কোড অনুযায়ী, বাংলাদেশের পোশাকের ওপর শুল্ক ছিল ১৫ শতাংশ। ফলে ৫ এপ্রিলের পর থেকে সেটি দাঁড়ায় ২৫ শতাংশে। নতুন করে ৯ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ ‘দেশভিত্তিক বাড়তি শুল্ক’ আরোপ করায় মোট শুল্কহার গিয়ে ঠেকছে ৫২ শতাংশে।

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে তৈরি একটি পোশাকের মূল্য ১০ ডলার। ৫ এপ্রিলের আগেও সেটির ওপর ১৫ শতাংশ শুল্কে মূল্য দাঁড়াতো ১১ দশমিক ৫০ ডলার। ৫ এপ্রিল থেকে ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্কে সেটি বেড়ে হয় ১২ দশমিক ৫০ ডলার। আর আজ থেকে নতুন ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপে সেই পণ্যের চূড়ান্ত মূল্য দাঁড়াবে ১৫ দশমিক ২০ ডলার।

বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারক ও সাধারণ ক্রেতাদের জন্য এই বাড়তি মূল্য একটি বড় চাপ হয়ে দাঁড়াবে। এর ফলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেলে মার্কিন বাজারে পোশাকের চাহিদা কমে যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে যেসব দেশের ওপর শুল্কহার তুলনামূলক কম, আমদানিকারকরা সেসব দেশ থেকে পণ্য আনতেই বেশি আগ্রহী হবেন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রফতানি আদেশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পাল্টা শুল্কের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি খাত বড় ধরনের সংকটে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি জানান, ইতোমধ্যে অনেক রফতানি আদেশ স্থগিত হয়েছে। পাশাপাশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্যছাড়ও দাবি করছে।

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার জায়গা হলো— যেসব পোশাক পুরোনো মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে, সেগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ক্রেতারা নতুন শুল্ক পরিস্থিতির কারণে সেগুলো গ্রহণ করবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, যদি সময়মতো ক্রেতারা ওই চালান গ্রহণ না করে, তাহলে পণ্য আটকে যাবে এবং রফতানির অর্থ দেশে ফিরবে না। এতে রফতানিকারকরা বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত সমাধানের জন্য তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্পষ্ট উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তবে সরকার সঠিক পথে এগোচ্ছে। এখন সময় এসেছে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষিতে যাওয়ার। নিছক চিঠিপত্র চালাচালি করে এই সমস্যার সমাধান হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি, যাতে আলোচনার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায় এবং দেশের রফতানি স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।’

বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি ও জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক হাসান জানান, ‘আমাদের এখন পর্যন্ত কার্যাদেশে কোনও সমস্যা হয়নি। তবে নতুন কার্যাদেশ পেতে দেরি হতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের কার্যাদেশ প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে ধারণা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মার্কিন ক্রেতারা বিকল্প হিসেবে মিশর, জর্ডান বা ভারতের দিকে ঝুঁকতে পারেন, যেহেতু সেসব দেশে শুল্কহার তুলনামূলক কম।’

এদিকে প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর বলেন, ‘ব্যবসা এখনও স্বাভাবিক আছে। বাংলাদেশের সুতি কাপড়ের পোশাক রফতানিতে সম্ভাবনা অনেক বেশি।’

একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন ক্রেতার বরাত দিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় বলা হয়েছে, ‘যদি বাংলাদেশের শুল্ক ৩৭ শতাংশেই থাকে এবং অন্যান্য দেশের ওপর শুল্ক কম থাকে, তাহলে ভারত, পাকিস্তান, মিশর ও কেনিয়ার কাছে বাংলাদেশ বাজার হারাতে পারে। আগামী কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও বদলাতে পারে।’

বিজিএমইএ সাবেক পরিচালক ও বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল জানান, ‘কয়েকজন ক্রেতা পণ্য রফতানি স্থগিত রাখতে বলেছেন। ছোট ব্র্যান্ডগুলো রফতানিকারকদের ওপর পুরো শুল্ক বহনের চাপ দিচ্ছে, যা অযৌক্তিক।’

তিনি বলেন, ‘শিল্পের পক্ষে এই শুল্ক বহন করা অত্যন্ত কঠিন। আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিকের জীবিকা বিবেচনায় রেখে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবে।’

এদিকে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বিজিএমইএর শীর্ষ নেতাদের এক বৈঠকে অতিরিক্ত শুল্কারোপের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন  সবাই।

বিজিএমইএ’র ফোরাম প্যানেল লিডার মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, গত মার্চে তৈরি পোশাক খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও নতুন করে বিপদের মুখে পড়েছি আমরা। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বুঝে দ্রুত কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক জানান, রফতানিকারকদের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান চলমান কার্যাদেশ স্থগিত করার নির্দেশনা দিয়েছে। একইসঙ্গে মূল্যছাড়ের চাপও দিচ্ছে। যখন ন্যায্য দাম পাওয়ার লড়াই চলছে, তখন এই পরিস্থিতি খাতটির জন্য আরও চাপ তৈরি করছে।

বিজিএমইএ’র আরেক সাবেক সভাপতি আনিসুর রহমান সিনহা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, সেটি স্পষ্টভাবে জানতে হবে সরকারকে। অন্যথায় অনাকাঙ্ক্ষিত এই ‘সুনামি’ মোকাবিলা করা কঠিন হবে।”

পাশাপাশি সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ মন্তব্য করেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানে তুলনামূলক কম শুল্ক আরোপ হওয়ায় মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। বিশেষ করে যেসব কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে বড় আকারে রফতানি করে, তারা ব্যাপক চাপে পড়বে।’

বিজিএমইএর ফোরামের মহাসচিব ড. রশিদ আহমেদ হোসাইনী বলেন, ‘গত শতকে এমন নজিরবিহীন পরিস্থিতি দেখা যায়নি। প্রয়োজনে আমদানি বাড়িয়ে শুল্ক পুনর্বিবেচনার কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের অর্থনীতি রক্ষা করতে রফতানি খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’

/ইউএস/
সম্পর্কিত
যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের শুল্ক দেয় বাংলাদেশ: সিপিডি
রফতানিতে বিকল্প বাজার খোঁজার আহ্বান রেহমান সোবহানের
মালিক কেন শ্রমিকের মুখোমুখি হন না
সর্বশেষ খবর
সংঘর্ষে উড়ে গেছে বাসের ছাদ, তবু পাঁচ কিলোমিটার চালিয়ে গেলেন চালক
সংঘর্ষে উড়ে গেছে বাসের ছাদ, তবু পাঁচ কিলোমিটার চালিয়ে গেলেন চালক
কিট সি কিং স্কলারশিপ বিজয়ী হলেন জ্যোতি
কিট সি কিং স্কলারশিপ বিজয়ী হলেন জ্যোতি
প্রেমের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায়, তরুণী গ্রেফতার
প্রেমের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায়, তরুণী গ্রেফতার
টিপকাণ্ডে ১৮ জনের বিরুদ্ধে সেই কনস্টেবলের মামলা
টিপকাণ্ডে ১৮ জনের বিরুদ্ধে সেই কনস্টেবলের মামলা
সর্বাধিক পঠিত
পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা
পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা
ঋণের কিস্তি ছাড় স্থগিত রাখলো আইএমএফ
ঋণের কিস্তি ছাড় স্থগিত রাখলো আইএমএফ
ভাসানচরকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে অন্তর্ভুক্ত না করতে আইনি নোটিশ
ভাসানচরকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে অন্তর্ভুক্ত না করতে আইনি নোটিশ
২৯ ঘণ্টা বন্ধ থাকবে খিলক্ষেত-কুড়িল-বসুন্ধরা সড়ক
২৯ ঘণ্টা বন্ধ থাকবে খিলক্ষেত-কুড়িল-বসুন্ধরা সড়ক
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ, উভয় পাশে যান চলাচল বন্ধ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ, উভয় পাশে যান চলাচল বন্ধ