প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক এবং গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ভোক্তার স্বার্থবিরোধী উল্লেখ করে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের মতে, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের ওপর ভ্যাট ও করের বোঝা চাপালে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের শ্রমজীবী, প্রান্তিক কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষ। যে হারে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে তাতে বিস্কুট, কেক, জুসসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। আর ভোক্তা না থাকলে খাদ্যপণ্যের অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে এরই মধ্যে এ খাতের আড়াই লাখ শ্রমিকের কাজ হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ালে পুরো খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। পরিচালন ব্যয় বেড়ে গেলে রফতানি বাজার হারাতে হবে। ফলে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে। রাজস্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্য হিতে বিপরীত হতে পারে বলে মনে করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে অ্যাগ্রো প্রসেসরস’ অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সদস্যরা এসব উদ্বেগের কথা জানান। তারা সরকারকে সাত দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। অন্যথায় স্বেচ্ছায় কারখানা বন্ধ করে সচিবালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটি।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে চিঠি দেয়া হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। বাপা’র নেতারা মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে এই সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাবগুলো তুলে ধরতে পারলে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে।
৯ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। মেশিনে প্রস্তুতকৃত বিস্কুট, কেক, আচার, চাটনি, টমেটো পেস্ট, টমেটো কেচাপ, টমেটো সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প ইত্যাদি পণ্যের ওপর মূসক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলের রস ও ফ্রুট ড্রিংকসের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল/ ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস (নন-কার্বোনেটেড) পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক ০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক ৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বাপার সভাপতি এম এ হাশেম বলেন, “আমাদের ব্যবসা খাতে শ্রমজীবী, নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে প্রান্তিক কৃষক জড়িত। সরকার বলছে খুব একটা প্রভাব পড়বে না, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিস্কুট ও কেকের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর সঙ্গে যদি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পায়, তবে ৫ টাকা দামের বিস্কুট তৈরি করা সম্ভব হবে না। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ সমস্যায় পড়বে।”
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী বলেন, আমরা প্রান্তিক কৃষকের আম, টমেটো, আনারস, কলাসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে জুস, ড্রিংকস, আচার, সস তৈরি করি। টমেটো, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্পের ওপর মূসক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক চাষিরা। ভ্যাট ও গ্যাসের দাম বাড়লে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এতে অনেকেই এসব পণ্য কিনবেন না। আবার কারখানা বন্ধ হলে অনেক শ্রমিক বেকার হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশের শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ এ খাতে নিযুক্ত। কৃষিখাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের অবদান জিডিপিতে এখন ৭.৭ শতাংশ। বর্তমানে বাপা’র প্রায় ৪০০ সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। এর বাইরেও পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাদ্যপণ্য উৎপাদন করছে। সেখানে ৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। কাঁচামাল সরবরাহকারী, খুচরা বিক্রেতাসহ পরোক্ষভাবে প্রচুর লোক এ খাতে যুক্ত। হঠাৎ এ ধরনের উদ্যোগে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শীর্ষ পাঁচ রফতানি খাতের একটি। আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের সুপার শপেও এখন বাংলাদেশে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বেড়েছে। এ খাতে রফতানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এখন বর্ধিত ভ্যাট আরোপ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে রফতানি খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের কাছে বাজার হারাতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বাপার সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল হক, এসিআই এগ্রো বিজনেসের প্রেসিডেন্ট ড. এফ এইচ আনসারি, এসএমসি এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ নাসির, বাংলাদেশ বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভুইয়া, আকিজ ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের পরিচালক সৈয়দ জহুরুল আলম, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের চিফ অপারেটিং অফিসার পারভেজ সাইফুল ইসলাম, কিশোয়ান ও বনফুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল ইসলামসহ কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতের বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।