স্মৃতির পাতা থেকে দুই বছর আগের কোনও ঘটনা মলিন হওয়া কষ্টসাধ্য। আর তা যদি হয় সাফল্যের চূড়ায় ওঠার মতো কিছু, তো অমলিন হয়ে থাকে দীর্ঘ সময়, বলা যায় আজীবন। লিওনেল মেসির জীবনেও ১৮ ডিসেম্বর থাকবে অবিস্মরণীয় হয়ে। ২০২২ সালের ঠিক এই দিনে নিজের নাম অমরত্বের খাতায় তুলেছিলেন তিনি। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের একমাত্র অপ্রাপ্তি ঘুচিয়েছিলেন দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামে। রোমহর্ষক এক ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রায় চার দশকের বিশ্বকাপ ট্রফি খরা কাটায় আর্জেন্টিনা। বলা যায়, এদিন ফুটবল তার ঋণ শোধ করেছিল, পরিপূর্ণ হয়েছিল ফুটবল।
২০২২ সালের বিশ্বকাপ শুরুই হয়েছিল ব্যতিক্রম দিয়ে। প্রথমবার শীতকালে আয়োজিত হয় বিশ্বসেরা হওয়ার লড়াই। প্রতিবারের মতো এবার প্রত্যাশার পারদ আকাশচুম্বী করে আর্জেন্টিনা তৃতীয় ট্রফির মিশনে নেমেছিল। তার আগের বছর কোপা আমেরিকা জিতে মেসি আন্তর্জাতিক ট্রফি খরা কাটান। বুকের ওপর থেকে পাহাড়সম চাপ হয়তো নেমে গিয়েছিল। কিন্তু মনের মধ্যে ঠিকই ছিল একটি বিশ্বকাপ ট্রফি ছুঁয়ে দেখতে না পারার অস্বস্তি।
ধরেই নেওয়া হয়েছিল মেসি শেষ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন। তার বিরাগভাজনরাও হয়তো চাইছিল, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পাক তিনি। কিন্তু শুরুতেই পা হড়কালো আর্জেন্টিনা। সৌদি আরব তাদেরকে হারিয়ে বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় চমক দিলো।
এই হোঁচট যেন আর্জেন্টিনাকে আরও তাঁতিয়ে দিয়েছিল, এমনকি মেসিকেও। তারুণ্যের ছোঁয়ায় তিনিও হয়ে গিয়েছিলেন তরুণ। গ্রুপ পর্ব থেকে শুরু করে নকআউট পর্বের প্রত্যেক ম্যাচে গোল করা প্রথম খেলোয়াড় ছিলেন এলএমটেন।
ফাইনালের ঝাঁজ আরও বেড়ে যায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের সঙ্গে খেলা পড়ায়, বিশেষ করে মেসি-এমবাপ্পে দ্বৈরথ এই ম্যাচকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল।
প্রথম পেনাল্টির কারিগর ছিলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ম্যাচে প্রথমবার জাল কাঁপিয়ে মেসি একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে গোল করার কীর্তি গড়েন।
কয়েক মিনিট পর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের সেরা গোল করে। দলগত প্রচেষ্টায় অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারের পাস ধরে ২-০ তে দলকে এগিয়ে দেন ডি মারিয়া।
ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল আর্জেন্টিনার হাতে। কিন্তু নাটকীয়ভাবে ম্যাচ ঘুরে যায় দেড় মিনিটের ব্যবধানে ফ্রান্স দুই গোল করলে। নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগে এমবাপ্পে দুইবার জাল কাঁপান, প্রথমটি ছিল পেনাল্টি থেকে।
ম্যাচ গড়ায় এক্সট্রা টাইমে। মেসি আবার দলকে এগিয়ে দেন ৩-২ গোলে। কিন্তু এমবাপ্পে দ্বিতীয়বার পেনাল্টি থেকে গোল করে ৩-৩ করেন স্কোর। ম্যাচ শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগে ফ্রান্স জয়সূচক গোল পেয়েই গিয়েছিল, কিন্তু র্যান্ডাল কোলো মুয়ানির লক্ষ্যে নেওয়া শট অবিশ্বাস্য চেষ্টায় রুখে দেন এমিলিয়ানো মার্তিনেজ, যা পরে আইকনিক সেভের খ্যাতি পায়।
পরে লাউতারো মার্তিনেজের হেড গোলবারের পাশ দিয়ে গেলে এবং এমবাপ্পের শট পাউলো দিবালা ক্লিয়ার করলে ম্যাচ টাইব্রেকারে যায়।
পেনাল্টি শুটআউটে বীরত্বপূর্ণ পারফর্ম করেন মার্তিনেজ। গ্লাভসে মোড়ানো হাত সেদিন যেন শক্ত দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিংসলে কোম্যানকে রুখে দেন আর্জেন্টিনা কিপার। অরেলিয়েন শুয়োমেনি বল মারেন গোলবারের পাশ দিয়ে। এই দুটি মিসেই মেসির বিশ্বকাপ জয় যেন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফ্রান্সের তৃতীয় গোলে পেনাল্টির নেপথ্যে থাকা মন্তিয়েল শেষ শটে জাল কাঁপান, ৪-২ গোলের জয়ে লেখা হয় এক ঐতিহাসিক উপাখ্যান। মেসিকে ঘিরে ধরে সতীর্থদের উদযাপন, কোচ লিওনেল স্কালোনির অনেক চেষ্টা করেও কান্না ধরে রাখতে না পারার মতো মুহূর্তগুলো এখনও স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল। যেন দুই বছর নয়, এই তো কিছু দিন আগের ঘটনা!
আর দেড় বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপ। যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডায় হতে যাওয়া ২০২৬ সালের আসর। এখন একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- অনিশ্চয়তার দোলাচলে থাকা মেসি কি খেলবেন শিরোপা ধরে রাখার মিশনে! ইন্টার মায়ামির ফরোয়ার্ড তার ক্যারিয়ারের ক্রান্তিলগ্নে। কিন্তু তার পায়ের জাদু এখনও সেই আগের মতোই। যদিও কোপা আমেরিকায় দ্বিতীয় শিরোপা জয়ে মাত্র এক গোল করেছেন ও একটি করিয়েছেন মেসি। তবে তরুণ দলকে তার উপস্থিতি অনুপ্রাণিত করেছে সবসময়ের মতো। ফাইনালে গোড়ালির ইনজুরি নিয়ে ছিটকে গেলেও তাকে হতাশ করেনি দল। স্পেনের পর প্রথম দল হিসেবে টানা তিনটি মেজর ট্রফি জিতেছে আর্জেন্টিনা।
বিশ্বকাপ বাছাইয়েও বেশ ভালো অবস্থানে তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। যদিও সবশেষ পাঁচ ম্যাচে জয় মাত্র দুটি, হারও সমান এবং একটি ড্র! ১২ ম্যাচে ২৫ পয়েন্ট নিয়ে আর্জেন্টিনা শীর্ষে, দ্বিতীয় স্থানে থাকা উরুগুয়ে পাঁচ পয়েন্ট পেছনে। সবচেয়ে বড় কথা এই বাছাইয়ে পাঁচ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে মেসি। এখনও তিনি অনিশ্চয়তার মাঝে থাকলেও তাকে পরের বিশ্বকাপেও দেখার আশা করতে দোষ কোথায়!