মিরাজের মাইলফলকের ম্যাচে বাংলাদেশের সিরিজ হারের দুঃখ

আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে শততম ম্যাচ খেলার মাইলফলক ছুঁয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। এই ম্যাচ দিয়ে আবার অধিনায়ক হিসেবে তার যাত্রা শুরু। নিয়মিত অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত হুট করে চোটে পড়ায় দলের অধিনায়কত্বের ভার তার কাঁধে বর্তেছে। এমন মাইলফলকের ম্যাচে সিরিজ হারের কাঁটায় ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে মিরাজকে। সোমবার (১১ নভেম্বর) ব্যাটিং ব্যর্থতায় স্কোরবোর্ডে ২৪৪ রানের সংগ্রহ দাঁড় করায় টাইগাররা। জবাবে খেলতে নেমে ১০ বল আগেই ৫ উইকেট হারিয়ে সিরিজ জয়ের আনন্দে মাতে আফগানিস্তান।

আফগানদের বিপক্ষে বাংলাদেশের এটিই প্রথম সিরিজ হার নয়। দলটির কাছে পরপর দুটি সিরিজ হারলো লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। গত বছর বাংলাদেশে এসে ২-১ ব্যবধানেই সিরিজ জিতেছিল তারা। বাংলাদেশে সিরিজ জিতে নবী-রশিদরা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও সিরিজ জিতেছিল। সব মিলিয়ে আফগানদের এটি টানা তৃতীয় সিরিজ জয়। সিরিজ হারতে বাংলাদেশ দল সব প্রচেষ্টাই যেন করেছে! প্রথমে বাজে ব্যাটিং, পরে বাজে বোলিংয়ের পাশাপাশি বাজে ফিল্ডিংয়ের খেসারত দিয়েছে দল। মাহমুদউল্লাহ ৯৮ রানের ইনিংস খেললেও সেঞ্চুরি পেতে শেষ দুই ওভারে কার্যকরী কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি তাকে ও অপরপ্রান্তে থাকা সঙ্গীদের। সব মিলিয়েই বাংলাদেশের এই সিরিজ হার।

শারজা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অলিখিত ফাইনালে বাংলাদেশের দেওয়া ২৪৫ রানের লক্ষ্য তাড়ায় দারুণ খেলেছে আফগানিস্তান। চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য তাড়ায় নেমে ওপেনিং জুটিতে ৪১ রান তোলে দলটি। সপ্তম ওভারে সেদিকউল্লাহ আতালকে (১৪) বোল্ড করে বাংলাদেশকে দারুণ ব্রেক-থ্রু এনে দেন অভিষিক্ত নাহিদ রানা। ব্যাট সময় মতো সামনে নিয়ে আসতে পারেননি আফগান ওপেনার, তাতেই বোল্ড! ওয়ানডেতে নাহিদের এটিই প্রথম উইকেট। এরপর দলীয় ৬৩ রানে রহমত শাহ (৮) ও ৮৪ রানে হাসমতউল্লাহ শাহিদিকে (৬) ফেরান মোস্তাফিজুর রহমান।

শুরুর এই ধারা ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশের বোলাররা। এক কথায় বাংলাদেশের কাছ থেকে ম্যাচটি ছিনিয়ে নেন ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজ। যদিও গুরবাহেজর এই সেঞ্চুরির কৃতিত্ব বেশিরভাগই বাংলাদেশের ফিল্ডারদের। আফগান এই ব্যাটারকে একের পর এক সুযোগ দেন বাংলাদেশের ফিল্ডার। একাধিক জীবন পেয়ে ক্যারিয়ারের অষ্টম সেঞ্চুরি করেন এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটার। চতুর্থ উইকেটে ওমরজাইয়ের সঙ্গে তিনি গড়েন ১০০ রানের জুটি। গুরবাজ ফেরার পর মোহাম্মাদ নবীকে নিয়ে বাকি কাজ সারেন ওমরজাই। ষষ্ঠ উইকেটে অবিচ্ছিন্ন জুটিতে তারা দুজন ৪৮ বলে করেন ৫৮ রান।

তারপরও সুযোগটা নিতে পারতো বাংলাদেশ দল। শেষ ৫ ওভারে ৩৩ রানের প্রয়োজন ছিল আফগানদের। কিন্তু নাহিদ রানা ও মোস্তাফিজের পর পর দুই ওভারে বেশ কিছু বাউন্ডারি ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয়। ফলে শেষ ১২ বলে আফগানদের প্রয়োজন ছিল ৬ রানের। ওমরজাই খুব বেশিক্ষণ সময় নিলেন না। শরিফুলের করা ৪৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে বিশাল এক ছক্কা উড়িয়ে শারজায় আফগান পতাকা উড়ালেন। পুরো স্টেডিয়াম যেখানে বাংলাদেশের রাজত্ব ছিল, সেখানে তখন পিনপতন নীরবতা। ওমরজাই ৭৭ বলে ৭০ ও নবী ২৭ বলে ৩৪ রানে অপরাজিত ছিলেন।

হাফ সেঞ্চুরির পর দর্শকদের উদ্দেশ্যে ব্যাট উঁচিয়ে ধরেন মিরাজ

অভিষিক্ত নাহিদ রানা ৪০ রান খরচায় নিয়েছেন দুটি উইকেট। মোস্তাফিজ ৫০ রানে নেন দুটি উইকেট। বাকি একটি উইকেট নেন মেহেদী হাসান মিরাজ। নাসুম আহমেদ ২৪ রান খরচ করে ছিলেন উইকেটশূন্য।

এর আগে টস জিতে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন। শান্তর ইনজুরিতে স্বপ্ন পূরণ হয় মিরাজের। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই তার স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের বিভিন্ন ধাপে তার ছিল নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা। বর্তমান নিয়মিত অধিনায়ক শান্তরও অধিনায়ক ছিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। সব মিলয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের দিনে টস জিতে দারুণ শুরু করেছিল বাংলাদেশ দল। কিন্তু ভালো খেলতে থাকা সৌম্য সরকার হুট করেই ভুল করে বসেন। কিছুটা দেরিতে খেলতে গিয়ে ইনসাইড আউট হয়ে সাজঘরে ফিরতে হয় তাকে। তার আগে ৫৩ রানের কার্যকরী একটি জুটি গড়ে গেছেন তিনি। 

সৌম্যর বিদায়ের পরই মোড়ক লাগে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপে। দ্রুত তিন উইকেট হারানোর পর রানের চাকাও থমকে যায়। ৭২ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর শঙ্কা ছিল দ্রুত অলআউট হওয়ার। তবে সেই শঙ্কা তুরি মেরে উড়িয়ে দেন অধিনায়ক মিরাজ ও অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ। মিরাজ অনেকটা সময় নিয়ে উইকেটে থিতু হয়েছেন। অন্যদিকে তীব্র সমালোচনার মুখে থাকা মাহমুদউল্লাহ দেখে শুনে রানের গতি সচল রাখার চেষ্টা করেন। আগের চার ম্যাচে মাহমুদউল্লাহর সর্বোচ্চ রান ছিল ৩। আজ খেললেন ৯৮ রানের ইনিংস। শেষ বলে রানআউট হওয়ার পর বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়ায় ৮ উইকেটে ২৪৪ রান। ১৮৮ বলে ১৪৫ রানের জুটির ওপর দাঁড়িয়ে মূলত এই সংগ্রহটা দাঁড় করাতে পারে বাংলাদেশ।

তবে রানটা আরও একটু বাড়লেও বাড়তে পারতো! যদি না মাহমুদউল্লাহ সেঞ্চুরির চেষ্টা না করতেন কিংবা তার সতীর্থরা মাহমুদউল্লাহকে সেঞ্চুরির চেষ্টা করার সুযোগ না দিতেন। ৪৯তম ওভারে নাসুম-মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিংয়ে ১২ রান আসে। শেষ ওভারে আসে মাত্র ৫ রান। কারণ সিঙ্গেল নেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন দুই প্রান্তের দুই ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ ও শরিফুল। শেষ পর্যন্ত যদিও সেঞ্চুরি বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। ১৪৫ বলে ৭ চার ও ৩ ছক্কায় মাহমুদউল্লাহ নিজের ৯৮ রানের  ইনিংসটি খেলেন।

বাংলাদেশের দুইশো পেরুনো স্কোরে ভূমিকা আছেন মিরাজেরও। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছেন তিনি। তার মতো আরও চার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, হাবিবুল বাশার, আমিনুল ইসলাম বুলবুল এবং নাজমুল হোসেন শান্তও অধিনায়ক হিসেবে নিজেদের প্রথম ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছেন। শুধু অধিনায়ক নয়, এটি মিরাজের শততম ওয়ানডে ম্যাচও ছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেটে নিজেদের শততম ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি পাওয়া ক্রিকেটার আছেন আর দুই জন- মুশফিকুর রহিম ও হাবিবুল বাশার সুমন। কিন্তু এমন মাইলফলকের ম্যাচে এসেও হতাশায় মুখ লুকাতে হলো মিরাজকে। নিজের প্রথম নেতৃত্বেই এমন হার কী সহজে ভোলা যায়?