মুশফিক-গিলক্রিস্টকে দেখেই তাহজিবুলের ক্রিকেট স্বপ্ন

বয়স যখন ঠিক ৬ বছর, তখনই ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় তাহজিবুল ইসলাম সিয়ামের। তারপর সময় যত গড়িয়েছে, খেলাটির প্রতি ভালোবাসা বেড়েছে একটু একটু করে। বাংলাদেশ বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং পোস্টে চাকরি করা মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম আজিম কখনও ছেলের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। উল্টো ছেলেকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। ২০১৫ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতে উত্তরার ফ্রেন্ডস ক্লাবে এই উইকেটকিপারকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সিয়ামের ভিত গড়ে দিয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপি।

শুরুতে অবশ্য ২০১৬ সালে বিকেএসপির তৃণমূল ক্যাম্পে যুক্ত হয়ে কিছু দিন ক্যাম্প করেছিলেন। কিন্তু তখন সুযোগ পাননি। কিছু দিন পর ক্যাম্প না করেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন সরাসরি। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান অবশেষে। সেখান থেকে দিনাজপুর বিকেএসপি হয়ে ফেরেন ঢাকা বিকেএসপিতে। এই সময়টাতে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের অনেক ধাপই পার হয়েছেন উইকেটকিপার এই ব্যাটার। মাঝে কিছু দিন অফফর্ম থাকায় কী করবেন, তা নিয়ে দ্বন্দ্বে ছিলেন। অবশেষে ফিটনেসের ওপর জোর দিয়ে নিজের ট্র্যাকে ফিরে আসেন।

তাহজিবুলের প্রিয় ক্রিকেটার সৌম্য সরকার ও ঋষভ পান্ত। মুশফিকুর রহিম-সাকিব আল হাসান-তামিম ইকবালদের ডেডিকেশন মুগ্ধ করে তাকে। অন্যদিকে মুশফিক-গিলক্রিস্টকে দেখেই তাহজিবুলের উইকেটকিপার ব্যাটার হওয়ার স্বপ্ন দেখা। আরও চাওয়া দেশসেরা ফিনিশার হবেন।

কম্বিনেশনের কারণে দলে নিয়মিত ‍সুযোগ না পেলেও সবসময়ের জন্য প্রস্তুত আছেন ঢাকার এই ক্রিকেটার। বিশ্বকাপ ঘিরে নির্দিষ্ট করে কোনও লক্ষ্য ঠিক করতে চান না। দলের উপকার হবে এমন কিছুই ভাবনা তার।

আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ১৭ যোদ্ধাকে নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা ট্রিবিউনে। আজ (শুক্রবার) থাকছে উইকেটকিপার ব্যাটার তাহজিবুল ইসলাম সিয়ামের একান্ত সাক্ষাৎকার-

বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন কীভাবে?

তাহজিবুল: ছোটবেলায় সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতাম ক্রিকেট। ৬ বছর বয়স থেকেই টেপটেনিস বলে ক্রিকেট খেলতাম। খেলতে খেলতে ১২ বছর বয়সে আমাকে আর কেউ আটকাতে পারছিল না। সারা দিন খেলাধুলাই করতাম। এভাবে চলতে চলতে একদিন বাবা আমাকে ভালো লাগার জায়গা ক্রিকেটে ভর্তি করিয়ে দেন। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। ২০১৬ সালে উত্তর ফ্রেন্ডস ক্লাবে আমার ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয়।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তো বিকেএসপির ছাত্র, প্রথমবার নাকি বিকেএসপিতে সুযোগ হয়নি?

তাহজিবুল: আল আমিন হোসেন নামের একজন বড় ভাইয়ের কাছে আমি ক্রিকেট বলে অনুশীলন করা শুরু করি। ওখানে এক বছরের মতো অনুশীলন করে বিকেএসপিতে তৃণমূল পর্যায়ের ক্যাম্পে যাই। চার মাসের মতো ক্যাম্প করে পরে যুক্ত হই এক মাসের ক্যাম্পে। কিন্তু ২০১৬ সালে পরীক্ষা দিয়েও টিকতে পারিনি। পরের বার আর ক্যাম্প না করেই পরীক্ষা দেই। ২০১৭ সালে প্রথম দিনাজপুরের ক্যাম্পে সুযোগ পাই। ওখানে অনূর্ধ্ব-১৬ খেলে যাই চট্টগ্রাম। তারপর অনূর্ধ্ব-১৭ খেলতে আসার পর আমাকে ঢাকাতেই রেখে দেয়। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।

বাংলা ট্রিবিউন:  বলছিলেন, বাবার অনেক সাপোর্ট পেয়েছেন। শুরু থেকেই এভাবে সাপোর্ট পেয়েছেন?

তাহজিবুল: শুরুতে সব মা-বাবার মতো আমার মা-বাবাও চাননি ক্রিকেটার হই। আমি মূলত বিকেএসপিতে সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই বাবা-মা বেশি বেশি সাপোর্ট দেওয়া শুরু করে। শুধু বাবা-মা নয়, পুরো পরিবারের সাপোর্টই পেয়েছি। এলাকার লোকজনসহ অনেক আত্মীয়-স্বজন বলতো, পড়াশোনা নষ্ট হবে, কী দরকার ক্রিকেটে ভর্তি করানোর। তখন আমার বাবা বলতেন, ‘এটা শুধু ওর ইচ্ছে না, আমারও ইচ্ছে।’ সব মিলিয়ে আমাকে অনেক বেশি পুশ করেছেন বাবা। বাবাই তো আমাকে উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাবে প্রথম ভর্তি করিয়ে দেন।

বাংলা ট্রিবিউন: বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে আপনার পারফরম্যান্স কী?

তাহজিবুল: বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর অনূর্ধ্ব-১৪ স্ট্যান্ডবাই থাকি। পরের বছর অনূর্ধ্ব-১৪ দলের হয়ে ম্যাচ উইনিং পারফরম্যান্স করেছি। এমন পারফরম্যান্স দেখে শিপন স্যার (যুব দলের প্রধান নির্বাচক) আমাকে অনূর্ধ্ব-১৫ দলের জন্য নির্বাচন করে। অনূর্ধ্ব-১৫-এর সব ক্যাম্প করে অনূর্ধ্ব-১৬-তে সুযোগ পাই। সেখানে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলে অনূর্ধ্ব-১৭ দলের সঙ্গে যোগ দেই। ২০১৯ সালে পাকিস্তান সিরিজের আগে কিছু ম্যাচ হয়েছিল, সেখানে ভালো করতে পারিনি বলে খেলার সুযোগ হয়নি। তখন থেকেই বোধোদয় হয়, তাহলে আমার কোনও সমস্যা আছে। তাই ২০১৯ সালের শেষের দিকে ফিটনেসের ওপর জোর দেই। তারপর বিকেএসপিতে টানা পরিশ্রম করে নিজেকে বদলে ফেলি।

বাংলা ট্রিবিউন: তাহলে আপনার অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পাওয়ার টার্নিং পয়েন্ট কোনটি?

তাহজিবুল: ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৮ দলে খেলার কথা থাকলেও করোনার কারণে খেলতে পারিনি। আমি লকডাউনের মধ্যেই অনুমতি নিয়ে অনুশীলন শুরু করি। যেহেতু খেলা হয়নি, এই কারণে ২০২১ সালে অনূর্ধ্ব-১৮ দলে খেলার জন্য বিভাগ থেকে খেলোয়াড় সংগ্রহ করা হয়। তখন আমি বিকেএসপিতে। সুযোগ পেতে পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল, ওইদিনই বিকেএসপিতে ফল ঘোষণা করা হয়। প্রথম ম্যাচে ৫০, দ্বিতীয় ম্যাচে ৬৫ নটআউট, তৃতীয় ম্যাচে ৪৫ রান করি। আমার ব্যাপারে শিপন স্যার খোঁজ খবর নিলেন। ইতিবাচক মন্তব্য করেন টুটুল স্যার ও অঙ্কন স্যার। ফলে চ্যালেঞ্জ সিরিজে সুযোগ পেয়ে যাই। ওখানেও ভালো করে বিকেএসপিতে ফিরে যাই। একদিন হুট করে হাসান স্যারকে কল দিয়ে শিপন স্যার বললেন, ‘তাহজিবুলকে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ডাকবো। ওর পাসপোর্ট জমা দিতে বইলো।’ মাঝখানে আমার একটা বছর যে গ্যাপ গেছে, ওটারও দরকার ছিল। ওই গ্যাপের পরই আমি বুঝতে পেরেছি, কীভাবে কামব্যাক করতে হয়।

বাংলা ট্রিবিউন: ম্যাচে ফিনিশিং রোল প্লে করা বেশ কঠিন, যতদূর জানি আপনাকে সেভাবেই দলে নেওয়া…

তাহজিবুল: আমাকে প্রথম থেকেই এই দায়িত্বের জন্য দলে নেওয়া হয়েছিল। নাম্বার সিক্স ও নাম্বার সেভেনের জন্য। প্রথমে আফগানিস্তান সিরিজ খেলি। সেখানে প্রথম তিন ম্যাচে মোটামুটি করি। চার নম্বর ম্যাচে ৫০ নটআউট ছিলাম। আগে থেকেই জানানো ছিল, আমার রোলটা কী হবে। আমি সেভাবেই অনুশীলন করি। চেষ্টা থাকবে সেরা ফিনিশার হওয়ার।

বাংলা ট্রিবিউন: খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি আপনার, প্রস্তুতির ঘাটতি কি রয়েই গেলো?

তাহজিবুল: আমার প্রস্তুতি ভালো। কম্বিনেশনের কারণে হয়তো সব ম্যাচ খেলতে পারিনি। তবে প্রস্তুতি যথেষ্ট ভালো, নেটে অনুশীলন করছি। এখানে আজ (শুক্রবার) থেকে মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছি। চেষ্টা করবো যতটা দিন সময় পাবো, মানিয়ে নিতে। আমি বরাবরই প্রস্তুত আছি। যখন সুযোগ পাবে চেষ্টা থাকবে প্রত্যাশা পূরণ করার। নিজের বিশ্বাস আছে যে আমি পারবো।

বাংলা ট্রিবিউন: উইকেট কিপার ব্যাটারই হয়ে ওঠা কেন?

তাহজিবুল: আমার ছোটবেলা থেকেই উইকেট কিপার ব্যাটারদের ভালো লাগতো। ছোটবেলা থেকে মুশফিক ভাইয়ের ব্যাটিং-উইকেট কিপিং দেখতাম। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ব্যাটিং-কিপিং ইউটিউবে দেখেছি। আমার খুব পছন্দের ক্রিকেটার। ঋষভ পান্তকে পছন্দ করি। তার ব্যাটিং-কিপিং দুটোই ভালো লাগে। মুশফিক-গিলক্রিস্টকে দেখেই আসলে আমার কিপার-ব্যাটার হয়ে ওঠা।

বাংলা ট্রিবিউন: মুশফিকের কঠোর পরিশ্রম আপনাকে কতটা অনুপ্রাণিত করে?

তাহজিবুল: অবশ্যই। সাকিব ভাই বলেন, মুশফিক ভাই বলেন, তাদের দেখে অনেক কিছু শেখার আছে। তারা মানসিকভাবে খুব শক্ত। এখন অব্দি তাদের বিকল্প পাওয়া যায়নি, সবকিছুই ভিন্নরকম। তাদের কাছ থেকে শেখার আছে।

বাংলা ট্রিবিউন: বলেছিলেন, বাবা আপনাকে ক্রিকেটার হতে অনুপ্রাণিত করেছেন। ঠিক কীভাবে?

তাহজিবুল: আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করেন। দলের সবার পরিবার কিন্তু এখন সাপোর্ট দেয়। একটা লেভেলে চলে আসছে বলেই হয়তো দেয়। কিন্তু আমার বাবা আমাকে ছোটবেলা থেকেই সাপোর্ট দিয়ে এসেছেন। এই জায়গাতে আমি অনেক ভাগ্যবান। ছোট ক্যারিয়ারে বিভিন্ন জায়গা থেকে বাদ পড়েছি, আবার দলেও ঢুকেছি। এই সময়টাতে বাবাই আমার পাশে ছিলেন। আমাকে খারাপ সময়গুলোতে বাবা মানসিকভাবে অনেক সাহায্য করেছেন।

বাংলা ট্রিবিউন: শুনেছি সৌম্য সরকারও আপনার প্রিয় ক্রিকেটার?

তাহজিবুল: সৌম্য সরকার ভাইয়ের প্রথম খেলা দেখেছিলাম ২০১৫ সালে। বিশ্বকাপের পর যে পারফরম্যান্স ছিল, সেটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। মিড অফ এবং মিড অনের ওপর দিয়ে দারুণ কিছু শটস খেলেছিল। আমি চাই উনি আবার ফর্মে ফিরে আসুক। আর পান্তকে আইপিএলে দেখেই আমার ভালো লাগা। আমাদের বাংলাদেশের কেউ যখন চিনতো না, তখন থেকেই তার উইকেট কিপিং-ব্যাটিং আমার পছন্দের।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি ঢাকা লিগে খেলেছেন, কীভাবে সুযোগ পেলেন?

তাহজিবুল: শাইনপুকুরের হয়ে দুটি ম্যাচ খেলেছি। খুব ভালো কিছু করতে পারিনি। তালহা স্যার (তালহা জুবায়ের) শাইনপুকুরের কোচ ছিল আর আমাদের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ ছিল। হুট করেই আমাকে কল করে স্যার জানান, আমাকে প্রিমিয়ার লিগ খেলতে হবে। আমি সারপ্রাইজ হয়ে গিয়েছিলাম।

প্রোফাইল

পুরো নাম: গাজী মোহাম্মদ তাহজিবুল ইসলাম

ডাক নাম: সিয়াম

জন্ম: ২৩ জুলাই ২০০৪

জন্মস্থান:  উত্তরা

বাবা:  মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম আজিম

মা:  রুমানা আক্তার রুমানা

উচ্চতা: ৬ ফুট ২ ইঞ্চি

পড়াশোনা: এসএসসি

প্রথম ক্লাব:  বিকেএসপি

বর্তমান ক্লাব: বিকেএসপি

ব্যাটিং স্টাইল: বাঁহাতি ব্যাটার

প্রিয় শটস:  স্লগ সুইপ, মিড অন এবং মিড অফের ওপর দিয়ে খেলা

প্রিয় মানুষ: বাবা-মা

প্রিয় ক্রিকেটার:  সৌম্য সরকার ও ঋষভ পান্ত

ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত: অনূর্ধ্ব-১৯ দলে প্রথম সুযোগ, আর ঢাকা লিগে অভিষেক।