টেনশনে মেহেদী হাসান তাই সব কথা খুলে বলেন তার প্রথম কোচকে। কোচ আল মাহমুদ শেষ পর্যন্ত ছোট্ট মিরাজের দায়িত্ব তুলে নেন। এমনকি কেডস-জার্সিও কিনে দেন। ওখান থেকেই শুরু ক্রিকেটে নাম লেখানো মিরাজ ক্রমান্বয়ে অনূর্ধ্ব-১৪ জেলা দলে সুযোগ পান। খেলেন বিভাগীয় দলেও।
ক্রিকেটের সিঁড়ি একে একে ভাঙছিল যখন মেহেদী তখনো স্বপ্ন বাস্তবায়নের বাধা তার বাবা! গাঁইগুঁই করে বলেন ক্রিকেট খেলে কী হবে? অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় সেরা ব্যাটসম্যান হন মিরাজ। প্রাইজমানি হিসেবে পান ২৫ হাজার টাকা। সেবার মিরাজের সঙ্গে ছিলেন তার বাবাও। স্টেডিয়াম, গ্যালারির দর্শক দেখে মুগ্ধ মিরজারের বাবার সংশয় কেটে যায় নিমেশেই। তখনই মিরাজকে কাছে ডেকে বলেন, তুই ক্রিকেট খেলে যা। একদিন তোকে জাতীয় দলে খেলতে হবে।
এরপর আর থামতে হয়নি মিরাজকে। থরথর করে এগিয়ে যাচ্ছেন মিরাজ। অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭ হয়ে এখন অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলছেন সেদিনকার ছোট্ট মিরাজ। বর্তমান দলটির দায়িত্বও তার কাঁধে। অফস্পিনের পাশাপাশি মিডল-অর্ডার ব্যাটিংয়ে পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার।
এখনও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে না উঠলেও ভবিষ্যতের সাকিব আল হাসানের সঙ্গে তুলনা করা হয় মেহেদী হাসান মিরাজকে। প্রতিশ্রুতিশীল এই ক্রিকেটার গত কয়েক বছর ধরেই সাফল্য ধরে রেখেছেন। বড়দের সঙ্গে প্রিমিয়ার লিগ ও জাতীয় লিগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পারফরম্যান্স করে চলেছেন তিনি। ২৭ জানুয়ারি থেকে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্বকাপে অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করে বিশ্বকাপের শিরোপা জেতাতে চান মিরাজ।
বাংলা ট্রিবিউন : ক্রিকেটে আসার গল্পটা বলেন…
মেহেদী হাসান মিরাজ : আমার বাবা ক্রিকেট খেলা পছন্দ করতো না। তারপরও আমি লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক খেলেছি। অনেক বার ধরা পড়ে মারও খেয়েছি বাবার হাতে। একদিন এলাকার এক বড় ভাইয়ের কাছে কোচিং করানোর জন্য অনুরোধ করি। উনি রাজি হন। তবে আমি চিন্তায় পড়ে যাই কিভাবে কোচিংয়ের টাকা দেব। এরপর আমার প্রথম কোচকে আমি সব ঘটনা খুলে বলি। আমার কোচ আল মাহমুদ আমার দায়িত্ব নিয়ে নেন। তারপরও বাবা বলতো ক্রিকেট খেলে কী হবে? একদিন বাবা মিরপুর স্টেডিয়ামে গিয়ে মুগ্ধ হন। তারপর থেকেই তিনি আমাকে আর বাধা দেন না। এভাবেই আস্তে আস্তে বয়সভিত্তিক ধাপগুলো পেরিয়ে খেলে ফেলি ২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ।
বাংলা ট্রিবিউন : খুব সন্নিকটে লড়াই, দলের প্রস্তুতি কেমন দেখছেন?
মেহেদী হাসান মিরাজ : সবাই খুব ভালো পজিশনে আছে এবং সবাই খুব ভালো ক্রিকেট খেলছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজটি আমাদের অনেক ভালো কেটেছে। ব্যাটসম্যানরা রানে ফিরেছে। বিশ্বকাপের আগে যা প্রয়োজন ছিল। এছাড়া বোলাররাও ভালো বোলিং করেছে। সবমিলিয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাসের মাত্রাটা অনেক উঁচুতে এখন। বিশ্বকাপে শুধু এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। তাহলেই আমাদের পক্ষে খুব ভালো একটি ফল করা সম্ভব হবে।
বাংলা ট্রিবিউন : দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হচ্ছে বিশ্বকাপ মিশন, কী ভাবছেন?
মেহেদী হাসান মিরাজ : বিশ্বকাপে আমাদের শুরুটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ জয় দিয়ে শুরু করতে পারলে পরবর্তী ম্যাচগুলোতে আমাদের জন্য ভালো হবে। আমরা প্রথম ম্যাচের দিকেই তাকিয়ে আছি। সেখানে জয় দিয়ে শুরু করতে চাই। এটা করতে পারলে পরের ম্যাচগুলো আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।
বাংলা ট্রিবিউন : পিনাক ঘোষ ও ঈমনের ধারাবাহিক নিয়ে চিন্তিত কিনা?
মেহেদী হাসান মিরাজ: ওরা দুইজন খুব ভালো খেলোয়াড়। কিন্তু তাদের ধারাবাহিকতায় কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পিনাক সেঞ্চুরি করেছে। ঈমন ভালো শুরু করেছিল। হয়তো ওদের ধারাবাহিকতা কিছুটা সমস্যা আছে। তারপরও এটা দলে প্রভাব ফেলবে না। কেননা আমাদের ব্যাটিং লাইনআপ অনেক শক্তিশালী। ওরা ব্যর্থ হলে অন্যদিন আরেকজন দাঁড়িয়ে যাবে। এটা টিম ওয়ার্ক। ওরা নিজেরাই চেষ্টা করছে সমস্যাগুলো শুধরে নেওয়ার। আমার বিশ্বাস মূল মঞ্চে ওরা ঘুরে দাঁড়াবে।
বাংলা ট্রিবিউন : শাওনের দুর্ঘটনা কতটা প্রভাব ফেলতে পারে?
মেহেদী হাসান মিরাজ : বোলিং অনুশীলনের সময় শাওনের মাথায় বলের আঘাত লেগেছে। তবে ওইরকম গুরুতর কোনও কিছু হয়নি। সিটি স্ক্যান করা হয়েছে, ডাক্তার বলেছে ও ঠিক আছে। সব রিপোর্টই ইতিবাচক এসেছে। আজকে শাওন জিমও করেছে আমাদের সঙ্গে। হয়তো মানসিক ভাবে একটু চাপে থাকতে পারে। যেহেতু বিশ্বকাপের আগে এমন একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে ও(শাওন) একটু ভয় পেয়েছে বিশ্বকাপ খেলতে পারবে কিনা এই ভেবে। শাওন খুব সাহসী। এগুলো কোনও সমস্যাই না। ২-১ দিন বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। আমার বিশ্বাস ২৭ জানুয়ারির আগে সম্পূর্ণ ফিট হয়ে উঠবে।
মেহেদী হাসান মিরাজ : আমার লক্ষ্য একটাই নিজে পারফরম্যান্স করা এবং সেই সঙ্গে টিমকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া। অধিনায়ক হিসেবে আমার একটাই চাওয়া থাকবে, আমার টিম যদি রেজাল্ট না করে আমাদের পারফরম্যান্সও কাজে আসবে না। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সও চাই, তার সঙ্গে টিম রেজাল্টও।
বাংলা ট্রিবিউন : সতীর্থদের কাছে কি চাওয়া থাকবে?
মেহেদী হাসান মিরাজ : সবাইকে বলবো নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখতে। চাপ নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ আমরা জানি আমাদের স্কিল সম্পর্কে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে সবাই সবার সেরাটা দিলেই আমরা জয় পাবো। এরজন্য সবাইকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন : বিশ্বকাপে ভালো খেলে বড়দের ক্রিকেটে নিজেকে জানানোর মঞ্চ ভাবছেন কিনা?
মেহেদী হাসান মিরাজ : বিশ্বকাপ বড় একটি ইভেন্ট। এখানে যদি কেউ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করে সেক্ষেত্রে ক্রিকেট বিশ্বের সবাই জানার সুযোগ পাবে। আমার ব্যক্তিগত একটি লক্ষ্য আছে। এই বিশ্বকাপে আমি নিজের সর্বোচ্চ উজাড় করে ক্রিকেট খেলতে চাই। আমি সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই এখানে। পুরো টুর্নামেন্টে ভালো কিছু পারফরম্যান্স করে এক নাম্বার অলরাউন্ডার হতে চাই। এই স্বপ্ন মাথায় নিয়েই আমি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাঠে নামবো। টুর্নামেন্ট শেষে আমি সেরা অলরাউন্ডার হয়ে বাংলাদেশকে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতাতে চাই।
বাংলা ট্রিবিউন : ২০১৪ বিশ্বকাপের দলটির সঙ্গে কী পার্থক্য দেখছেন?
মেহেদী হাসান মিরাজ : গত বছরের দলটিও ভালো ছিল, তারপরও কিছুটা পার্থক্য আছে এবারের দল থেকে। গত বারের দলে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় খুব কম ছিল। এবার আমাদের দলে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় আছে ৫ জন। এছাড়া গত বছর ৩-৪ জন খেলোয়াড়ের প্রিমিয়ার লিগ ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছে মাত্র। এবার ১১ খেলোয়াড় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, প্রিমিয়ার লিগ, প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছে। ওখানে খেলার অভিজ্ঞতা আমাদের এগিয়ে রাখছে। গত বছর বিশ্বকাপে আমাদের ‘গ্যাপ’ ছিল। এবার তাও নেই। সবমিলিয়ে এবারের দলটি তাই শিরোপা জয়ের দাবিদার।
বাংলা ট্রিবিউন : ব্যাটিং লাইনআপে ৬-৭ নাম্বার খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওখানে ব্যাটসম্যানদের দ্রুত রান তুলতে হয়। এটা নিয়ে কি ভাবেছেন?
মেহেদী হাসান মিরাজ : ৬-৭ নাম্বারে আমাদের অনেক ভালো ব্যাটসম্যান আছে। সাইফউদ্দিন, সাঈদ সরকার ও শফিউল হায়াতের মতো ভালো ব্যাটসম্যান আছে। ওরা যদি শেষ ৫-৬ ওভার নিজেদের মতো স্বাচ্ছন্দ্যভাবে খেলতে পারলে দলের জন্যই ভালো হবে। ওদের হাতে অনেক স্ট্রোক আছে যা দলের স্কোর বোর্ডে রান বাড়াতে সহায়তা করবে। ওরা হয়তো শেষ কয়েক ম্যাচে সেভাবে রান করতে পারেনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে ওরা রানে ফিরবে। তারা জানে তাদের দায়িত্ব কি।
মেহেদী হাসান মিরাজ : বাবুল স্যার আমাদের সঙ্গে দেড় বছর ধরে কাজ করছেন। আমাদের সঙ্গে খুব আন্তরিক ভাবে মেলামেশা করেন তিনি। আমাদের নিয়ে সে গত দেড় বছর অনেক পরিশ্রম করেছে। সে প্রায়ই বলে তোমরা ভালো খেললে আমার খুব ভালো লাগে। বিশ্বকাপে অবশ্যই চাই এমন কিছু করতে যাতে করে বাবুল স্যারের মুখে হাসিটা যেন উধাও না হয়। এছাড়া সোহেল স্যার আছেন। উনিও অনেক কষ্ট করেছেন। বিশেষ করে ফিল্ডিং ও স্পিনারদের নিয়ে তার পরিশ্রম ছিল অনেক বেশি। আমাদের দলে যত ভালো স্পিনার তৈরি হয়েছে সবকিছুই তার অবদান। বাবুল স্যার ও সোহেল স্যার আমাদের নিয়ে অনেক পরিশ্রম করেছেন বিধায় আমাদের এতো ভালো ফল হচ্ছে। এছাড়া স্টুয়ার্ট ল আমাদের সঙ্গে খুব বেশি দিন কাজ না করলেও বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলা ট্রিবিউন : মুশফিকের সঙ্গে কেমন কথা হয়েছে?
মেহেদী হাসান মিরাজ : মুশফিক ভাই যখন একাডেমি মাঠে ব্যাটিং অনুশীলন করছিলো, তখন একদিন গিয়ে কথা বলেছিলাম। উনি আমাকে বলেছেন, ‘তোরা অনেক পরিশ্রম করছিস, কষ্ট করছিস, তোদের কোচরাও অনেক কষ্ট করেছে। তোদের এমন পরিশ্রম দেখে খুব ভালো লাগছে। তোরা অনেক ভালো রেজাল্ট করবি। দেশের মধ্যে খেলা একটু চাপ থাকবে কিন্তু তোরা কোনও চাপ নিবি না। তোদের ন্যাচরাল খেলাটাই খেলবি। সবারই অনেক আশা থাকবে, ভালো রেজাল্ট করার ব্যাপারে। এই জিনিসটা কখনোই মাথায় নিবি না। চেস্টা করবি ভালো ক্রিকেট খেলার। সেই সঙ্গে ইতিবাচক থাকবি সব সময়।’
নাম : মেহেদী হাসান মিরাজ
ডাক নাম : মিরাজ
জন্ম : ২৫ অক্টোবর ১৯৯৭
জন্মস্থান : খুলনা
উচ্চতা : ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি
ওজন : ৬০ কেজি
পড়াশুনা : এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষ
প্রথম ক্লাব : মুসলিম একাদশ
বর্তমান ক্লাব : কলাবাগান ক্রিকেট একাডেমি
ব্যাটিং স্টাইল : ডানহাতি ব্যাটসম্যান
বোলিং স্টাইল : অফস্পিন
প্রিয় শটস : স্ট্রেইট ড্রাইভ
প্রিয় ডেলিভারি : আর্ম বল
প্রিয় মানুষ : আল মাহমুদ আমার প্রথম কোচ
প্রিয় ক্রিকেটার : মাইকেল ক্লার্ক (অস্ট্রেলিয়া) মুশফিকুর রহিম (বাংলাদেশ)
ক্রিকেট ছাড়া অন্য প্রিয় খেলা : ফুটবল
প্রিয় ফুটবল তারকা : নেইমার
প্রিয় ফুটবল দল : ব্রাজিল
প্রিয় বন্ধু : মোহাম্মদ নয়ন
ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত : সিএবির বিপক্ষে আমার প্রথম সেঞ্চুরি। ওই ম্যাচে আমি ১৩০ রানের ইনিংস খেলেছিলাম অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে।
ছবি : সাজ্জাদ হোসেন
/এফআইআর/