কেউ বাদ দেওয়ার আগেই বিদায় নিচ্ছি: তুষার ইমরান

জাতীয় দলের বাইরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র তুষার ইমরান। ঘরোয়া ক্রিকেটের রান মেশিনও বলা যায় তাকে। গত কয়েক বছরের পারফরম্যান্স সেই মর্যাদা এনে দিয়েছে তাকে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১২ হাজার রানের খুব কাছেই ছিলেন। কিন্তু চোটের কারণে এই মাইলফলক স্পর্শ না করেই আগামীকাল (রবিবার) ঢাকা বিভাগের বিপক্ষে জাতীয় লিগের ম্যাচে অবসরের ঘোষণা দিচ্ছেন খুলনা বিভাগের এই ক্রিকেটার।

১২ হাজার রান থেকে মাত্র ২৮ রান দূরে থাকা এই ক্রিকেটার ২০০৭ সাল থেকে জাতীয় দলের বাইরে। ১৪ বছর আগে নিউজিল্যান্ড সফরের ওয়ানডে ছিল তার বাংলাদেশের হয়ে সর্বশেষ ম্যাচ। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেললেও আর জাতীয় দলে ফেরা হয়নি। ৩৮ ছুঁই ছুঁই ডানহাতি ব্যাটার অবশেষে খেলোয়াড়ি জীবনকে বিদায় বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আজ (শনিবার) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। যেখানে ২১ বছরের ক্যারিয়ারে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও উঠে এসেছে।

বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দীর্ঘ দিন ২২ গজে থাকার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটা কঠিন ছিল?

তুষার ইমরান: সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে কষ্ট লাগছে। তবে বুঝিনি এতটা কষ্ট লাগবে! যে ক্রিকেটটা পছন্দ করতাম, সেই জিনিস থেকে সরে যাওয়াটা তো সহজ নয়। তবু যেতে হচ্ছে, আর কত! বিদায় তো নিতেই হবে। এবাবের জাতীয় লিগটা মিস করেছি। ইনজুরির কারণে পাঁচ রাউন্ডের মধ্যে শুরুতে দুই রাউন্ড এবং কালকের (রবিবার) ম্যাচ মিস করবো। তবু কালই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের জার্সিতে তুষার ইমরানবাংলা ট্রিবিউন: আপনি তো ১২ হাজার রানের মাইলফলকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আরেকটি মৌসুম খেলে রেকর্ডটি করা যেত না?

তুষার: আগামী মৌসুমে সুযোগ হতো কিনা এটা বলা কঠিন। ইনজুরির কারণে ‍দুটো ম্যাচ মিস করেছি, নয়তো হয়েই যেত ১২ হাজার রান। কালকের ম্যাচটাও খেলতে পারছি না। সামনে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ আছে, সেখানে সুযোগ না হলে তাহলে আবার সামনের মৌসুমের অপেক্ষা করতে হবে। অতদিনে কত কিছুই তো হতে পারে...। ইনজুরি নিয়ে খেলাটা কঠিন, বাকি রানের জন্য আফসোস হয়তো থাকবে। কিন্তু ইনজুরি নিয়ে মাঠে নামাটা বেশ কঠিন হবে। এজন্য ভালোভাবেই অবসরটা নিতে চাই। সম্মান থাকতে থাকতে বিদায় নিতে চাচ্ছি। কেউ বাদ দেওয়ার আগেই আমি বিদায় নিতে চাইছি।

বাংলা ট্রিবিউন: মাইলফলকটা ছোঁয়া হচ্ছে না। তারপরও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রায় ১২ হাজার রান। ভাবলে কেমন লাগে?

তুষার: এই সমস্ত কিছুই আমার ডেডিকেশন। আমি কখনোই হতাশ হয়নি। ২০০৭ সালের পর জাতীয় দলের বাইরে, তবু আমার চেষ্টা ছিল নিজেকে প্রমাণ করার। হয়তো সুযোগ পাইনি, কিন্তু আমি উপভোগের মন্ত্রে খেলে গেছি। এই কারণেই হয়তো এত রান করতে পেরেছি। ১২ হাজার রানের কাছাকাছি যাবো, সেটা কখনও চিন্তাও করিনি। পাঁচটা ইনিংস পেয়েছি, চেষ্টা করেছি ওখানে। কিন্তু হয়নি। তবে আমার আফসোস নেই। যতটুকু পেরেছি অর্জন করেছি।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের জার্সিতে তুষার ইমরানবাংলা ট্রিবিউন: বিদায়বেলার কোনও আক্ষেপ আছে?

তুষার: আক্ষেপ তো একটা ছিল। আমার ২০-২১ বছরের ক্যারিয়ার। আমি ২০০৭ সালে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ি। এরপর গত ১৪-১৫ বছর ধরে জাতীয় দলে ফেরার জন্য ফাইট করে গেছি। ২০১৭-১৮ সালের দিকে যেমন পারফরম্যান্স করেছিলাম, মনে হচ্ছিল আমি কামব্যাক করেই ফেলবো। ওই জায়গাতে কিছুটা অতৃপ্তি আছে। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি নিজেকে ফিট রাখার। কীভাবে জাতীয় দল কিংবা বাইরের  খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা যায়, সেই চেষ্টা করেছি। সুযোগ না পাওয়াটা আমাকে হতাশ করলেও আমি কখনোই হাল ছাড়িনি। কিছু কিছু আক্ষেপ তো আছেই। আরও ভালোভাবে ক্যারিয়ার শেষ করতে পারতাম। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ক্যারিয়ারটা ভালোভাবে শেষ করতে পারলেও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে পারিনি। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ দলকে সার্ভিস দিতে পারিনি।

২০০৭ সালের পর আর জাতীয় দলে ফেরা হয়নি তুষারেরবাংলা ট্রিবিউন: টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে ৪৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। বিশেষ কোনও স্মৃতি কি মনে পড়ছে?

তুষার: অনেক স্মৃতি আছে। ২০০৩ বিশ্বকাপের কথা বেশি মনে পড়ে। ওই বিশ্বকাপে আমরা অনেক বাজে ক্রিকেট খেলি। কেনিয়া সেবার সেমিফাইনাল খেলেছিল। গ্রুপ পর্বে কেনিয়ার বিপক্ষে আমার ৪৮ রানের একটি ইনিংস আছে। আমি দেশে থাকতেই বলে গিয়েছিলাম, আমার লক্ষ্য কেনিয়ার বিপক্ষে ভালো একটি ইনিংস খেলে ওদের হারানো। ভালো একটা ইনিংস খেলেও দলকে জেতাতে না পারাটা আমাকে এখনও পীড়া দেয়।

এছাড়া ২০০২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানোর আরেকটি সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু এক ম্যাচে ৬৫ ও আরেক ম্যাচে ৪৩ রান করলেও দলকে জেতাতে পারিনি। ওই দলে ওয়াসিম আকরাম, শোয়েব আখতার, ওয়াকার ইউনুস, আব্দুল রাজ্জাকের মতো বোলার ছিল। তাদের বিপক্ষে জয়ের খুব কাছে গিয়েও জিততে না পারাটা আমাকে এখনও কষ্ট দেয়। এরপর ২০০৩ সালে পাকিস্তানে গিয়েও জেতার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। ওই ম্যাচে আমি ৩৩ রান করেছিলাম। আমাদের জন্য দারুণ সুযোগ ছিল ম্যাচটি জেতার। কিন্তু শেষ ওভারে গিয়ে আমরা ম্যাচ হেরে গেছি।

একটা ম্যাচে আমার কিছুটা কন্ট্রিবিউশন ছিল, আমার ক্যারিয়ারে অন্যতম প্রাপ্তি সেটি। ২০০৫ সালে কার্ডিফে আমরা অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমবার হারিয়েছিলাম। ওই ম্যাচে আমি ২৪ রানের ইনিংস খেলেছিলাম।

জাতীয় লিগে রানের বৃষ্টি ঝরিয়েছেন তুষারবাংলা ট্রিবিউন: শুনেছি ক্রিকেট কোচিংয়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন?

তুষার: হ্যাঁ। শেখ জামাল ক্রিকেট একাডেমির হেড কোচের দায়িত্বে আছি। কোচিং নিয়ে থাকার পরিকল্পনা আমার। আমার অভিজ্ঞতাগুলো ছড়িয়ে দিতে চাই সবার মাঝে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার সঙ্গে খেলা অনেকেই ক্রিকেট বোর্ডে যুক্ত হয়েছেন। সুযোগ পেলে ক্রিকেট বোর্ডে কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?

তুষার: ক্রিকেট বোর্ড চাইলে অবশ্যই যেকোনও ভাবেই থাকার চেষ্টা করবো। বোর্ড না চাইলে তো কোনও সুযোগ নেই। আমি ক্রিকেট নিয়ে যেকোনও দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছি।

বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেটার, বোর্ড কিংবা দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার আছে কি?

তুষার: বিশেষ করে, ক্রিকেট খেলোয়াড়দেরকে বলতে চাই, সবাই তো আর জাতীয় দলে খেলে না কিংবা সবার সৌভাগ্য হয় না। ক্রিকেটটাকে উপভোগ করে, মন দিয়ে খেলতে হবে। এভাবে চিন্তা করলে জাতীয় দলের দরজা আপনাআপনিই খুলে যাবে। এই প্রসেসেই একজন ক্রিকেটার তার ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারবে। সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে, সবাই যেন ভালোবেসেই ক্রিকেটটা খেলে। আমার ভক্ত কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী যারা ছিলেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই আমি ব্যাট গুছিয়ে রাখলেও ক্রিকেট থেকে বিদায় নিচ্ছি না। আমার জন্য দোয়া করবেন।