সেই শৈশবেই ক্রিকেট ব্যাট ও বলের সঙ্গে প্রেম বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সহঅধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর। মূলত টিভিতে খেলা দেখেই তার ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। ওই সময় তার প্রিয় তারকা ছিল শচীন টেন্ডুলকার। শচীনের কোনও খেলা টিভিতে মিস করেননি কখনো। বিষয়টি পরিবারের চোখ এড়িয়ে গেলেও এড়ায়নি শান্তর বাবার এক বন্ধুর। তিনি একদিন শান্তর বাবাকে বোঝান, 'তোমার ছেলের ক্রিকেটে এতো ঝোঁক। তাকে ক্লেমন একাডেমিতে দাও না কেন?' ওখান থেকেই নাজমুল হোসেন শান্তর স্বপ্নের বীজ বোনা শুরু হয়। ১০ বছর বয়সে বাসা থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে একাডেমিতে আসতে হয়েছে শান্তকে।
পরিশ্রমী ক্রিকেটার হিসেবে নামডাক আছে নাজমুল হোসেন শান্তর। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে পারদর্শী নাজমুল একটু মুখচোরা স্বভাবের! যদিও বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমিতে জুড়ি নেই তার।
ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমি থেকে ক্রিকেট দীক্ষা শুরু করা নাজমুল হোসেন শান্ত ওখান থেকেই খেলেন অনূর্ধ্ব-১৪ জেলা ক্রিকেট। জেলার হয়ে খেলা শেষ করে সুযোগ পান বিভাগীয় দলে। ধারাবাহিকতায় অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় দলে ডাক পান এই ওপেনার কাম অফস্পিনার। ছিলেন অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ক্যাম্পেও। সেখান থেকে কোনও ম্যাচ না খেলেই প্রমোশন হয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলে।
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সহ-অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত দলের অন্যতম ভরসা হয়ে আছেন। ২০১৪ বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরের মাঠে আসন্ন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভালো কিছু করার আশায় উন্মুখ হয়ে আছেন তরুণ এই অলরাউন্ডার। সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে খেলা দুটি ম্যাচে দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছেন তিনি। তাইতো আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শিরোপাস্বপ্নের বড় সারথি নাজমুল হাসান শান্তর। তার ব্যাটের দিকে তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশের কোটি সমর্থক!
এই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর শান্ত। সেই সঙ্গে ভালো খেলে জাতীয় দলে ঢোকার রাস্তাটা তৈরি করে রাখতে চান যুব দলের সহ-অধিনায়ক। খুব তাড়াহুড়ো না করলেও তার স্বপ্নটা ছুঁতে ২-৩ বছরের বেশি অপেক্ষা করতে চান না তিনি। সাকিব ভক্ত শান্ত তার মতোই বিশ্বসেরা হতে চান। এই বিশ্বকাপে হয়তো বিশ্বসেরা হয়ে বড়দের ক্রিকেট বিশ্বসেরা হওয়ার রাস্তাটা প্রশস্ত করবেন অলরাউন্ডার শান্ত।
আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ১৫ যোদ্ধাকে নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা ট্রিবিউনে। আজ বুধবার থাকছে সহ-অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর একান্ত সাক্ষাৎকার :-
বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেট কিভাবে আসলেন?
নাজমুল হোসেন : ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেট পছন্দ করতাম। পাড়ায় বন্ধুদের নিয়ে ক্রিকেট খেলতাম। একদিন আব্বুর এক বন্ধু বাবাকে বুঝিয়ে আমাকে একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন। মূলত ওখান থেকেই শুরু আমার ক্রিকেটার হয়ে উঠার মিশন। এরপর আস্তে আস্তে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের স্তর পেরিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পেয়েছি। ২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আমি যখন দলে সুযোগ পেলাম ওটাই আমার ক্রিকেট জীবনের স্মরণীয় মুহুর্ত।
বাংলা ট্রিবিউন: ৬ দিন পরেই বিশ্বকাপ শুরু, এ পর্যায়ে দলের প্রস্তুতি কেমন দেখছেন?
নাজমুল হোসেন: অনেক ভালো প্রস্তুতি আমাদের। আমরা শিরোপা জেতার জন্যই মাঠে নামবো। তবে এতো বড় চিন্তা আগে থেকেই করছি না। ম্যাচ বাই ম্যাচ পরিকল্পনা করে এগুবো। গতবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নেট রান রেটে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছি। এবার আমরা অনেক সতর্ক। ছোট খাটো কোনও ভুল করতে চাই না। কোচ আমাদের এই বিষয়গুলোর ওপর খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজে আমরা দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং আক্রমনের বিপক্ষে খেলে আমাদের জন্য খুবই ভালো হয়েছে। কারণ ভারতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে আমাদের খুব ভালো যায়নি। ওখানে ব্যাটসম্যানরা খুব বেশি রান করতে পারেনি। সবাই এই সিরিজের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসটুকু বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সত্যিই এবারের মতো প্রস্তুতি আমরা কোনও বারই নিতে পারিনি।
বাংলা ট্রিবিউন: ব্যক্তিগত প্রস্তুতি কেমন মনে করছেন?
নাজমুল হোসেন: ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিরিজটি ভালো গেছে। এই সিরিজি আমি দুটি ম্যাচ খেলেছি। একটি ম্যাচে ৪১ নটআউট অন্যটিতে ৭৯ রান। এই ম্যাচ দুটি আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন বিশ্বকাপে ভালো কিছু করার একটি প্রেরণা পাচ্ছি। নার্ভাস থাকবো না। কেননা আমি জানি আমি রান করেছি ভালো বোলিং আক্রমনের বিপক্ষে। এই কারণে আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি থাকবে। এই সিরিজটি আমার জন্য অনেক কাজে দিয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: বিশেষ কোনও লক্ষ্য স্থির করেছেন?
নাজমুল হোসেন: পরিকল্পনা আছে এই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হওয়ার। আমি আমার প্রস্তুতি খুব ভালো ভাবেই নিয়েছি। এখন ভাগ্যের সহায়তা পেলে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো। সেই সঙ্গে অবশ্যই দল আমার কাছে যা চাইবে আমি তা পূরণ করার চেষ্টা করবো।
বাংলা ট্রিবিউন: বোলিং নিয়ে কিছু ভাবছেন কিনা?
নাজমুল হোসেন: আমি যেহেতু একজন অলরাউন্ডার হিসেবে খেলছি, তাই আমার দুটি দায়িত্বই আমাকে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। গত কয়েক ম্যাচে বোলিং না করলেও অনুশীলন ঠিকই করেছি। যখন অধিনায়ক আমার হাতে বল তুলে দেবেন, তখনই চেষ্টা করবো ব্যাটের পাশাপাশি বল হাতে ভূমিকা রাখার।
বাংলা ট্রিবিউন: কত সালের মধ্যে নিজেকে জাতীয় দলে দেখার আশা করেন?
নাজমুল হোসেন: এই বিশ্বকাপে ভালো খেলে জাতীয় দলের রাস্তাটা তৈরি করে রাখতে চাই। অতো তাড়াহুড়ো নেই। তবে ২-৩ বছরের মধ্যে হলেই হবে। প্রথম যেদিন জাতীয় দলের হয়ে খেলবো সেদিন মা ও বাবাকে গ্যালারিতো রাখবো। আমার বিশ্বাস মা ও বাবা অনেক খুশি হবেন।
বাংলা ট্রিবিউন: গত বিশ্বকাপের দলটিতে আপনি ছিলেন। এবারের থেকে ওটার পার্থক্য কী?
নাজমুল হোসেন: আমাদের এই দলে ভালো মানের স্পিনার আছে। এছাড়া আমাদের টপ অর্ডার অনেক শক্তিশালী। এছাড়া সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের সিরিজ খেলে নিজেদের আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিতে পেরেছি। ওখানে স্পিনারদের পাশাপাশি ব্যাটসম্যানরা খুব ভালো করেছে। ওপেনিংয়ে দুটি সেঞ্চুরি এসেছে। মিডল অর্ডারে সবাই আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নিতে পেরেছে।
বাংলা ট্রিবিউন : গত বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা কতটা কাজে লাগাতে পারবেন?
নাজমুল হোসেন : গত বিশ্বকাপ খেলার আগে আমার অভিজ্ঞতা ছিলো না। এবার আমি অভিজ্ঞ হিসেবেই মাঠে খেলবো। আমি জানি কী হতে পারে কিংবা না পারে। আমি সেভাবেই আমার পরিকল্পনা করছি। আগের অভিজ্ঞতার কাজে লাগিয়ে অবশ্যই চেষ্টা করবো সেরাটা দেওয়ার।
বাংলা ট্রিবিউন : এবার তাহলে আক্ষেপ দূর হচ্ছে?
নাজমুল হোসেন : গত ২ বছর ধরে আমরা প্রত্যেকটি সিরিজ ভালো খেলেছি। আমাদের ব্যাটসম্যান এবং বোলার সবাই আত্মবিশ্বাসী। এবার আর আমরা ব্যর্থ হবো না। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের নিজেদের মাটিতে খেলা। এখানে আমাদের ভালো কিছু করতেই হবে। তবে আমরা সতর্ক, এক লাফে গাছে উঠতে চাই না। একটি একটি ম্যাচ করে এগুতে চাই।
বাংলা ট্রিবিউন : দলের কোচ ও পরামর্শক স্টুয়ার্ট ল'র দিক নির্দশনা কেমন?
নাজমুল হোসেন : বাবুল স্যারতো আমাদের শুরু থেকেই আছেন। ভালো পারফরম্যান্স বের করে আনার জন্য তিনি আমাদের অনেক উৎসাহিত করেন। সবসমই তিনি আমাদের খোঁজ নেন। কোথায় কোথায় আমাদের সমস্যা। কিভাবে সমাধান কার যায়। এগুলো নিয়ে আলোচনা করেন বেশ গুরুত্ব সহকারে। অন্যদিকে স্টুয়ার্ট ল প্রথমে এসে আমাদের বলেছে তোমাদের সবকিছু ঠিক আছে। উনি মূলত আমাদের ছোট ছোট টিপস দেন। ব্যাটিং-বোলিংয়ের ক্ষেত্রে উনি বেশিকিছু বলেন না। হয়তো বলেন, ব্যাটিংয়ের কিভাবে আরও মনোযোগ ধরে রাখা যায়।
প্রোফাইল
নাম : নাজমুল হোসেন
ডাক নাম : শান্ত
জন্ম : ২৫ আগষ্ট ১৯৯৮
জন্মস্থান : রাজশাহী
উচ্চতা : ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি
ওজন : ৬৭ কেজি
পড়াশুনা : এইচএসসি প্রথম বর্ষ
বর্তমান ক্লাব : কলাবাগান ক্রিকেট একাডেমি
ব্যাটিং স্টাইল : বাঁহাতি ব্যাটসম্যান
বোলিং স্টাইল : ডান হাতি অফস্পিন
প্রিয় শট : স্টেইট ড্রাইভ ও কভার ড্রাইভ
প্রিয় ক্রিকেটার : মাইক হাসি (অস্ট্রেলিয়া) সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)প্রিয় মানুষ : আম্মু
ক্রিকেট ছাড়া অন্য প্রিয় খেলা : ফুটবল
প্রিয় ফুটবল তারকা : লিওনেল মেসি
প্রিয় ফুটবল দল : আর্জেন্টিনা
প্রিয় বন্ধু : নিহাদ-উজ-জামান
ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত : প্রথমবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়া
ছবি : সাজ্জাদ হোসেন
/এমআর/