নির্বাচন পেছানোর চক্রান্ত দেখছে ১২ দল

ডিসেম্বরে নির্বাচন আদায়ে ‘সর্বদলীয় জনমত’ গঠনে বিএনপি

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য অনুযায়ী চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায়ে সর্বদলীয় ঐকমত্য গঠন করতে চায় বিএনপি। এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি অন্যান্য ডান, বাম ও ইসলামি দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করতে চায় দলটি। এর অংশ হিসেবে রবিবার (২০ এপ্রিল) সিপিবি, বাসদসহ বাম ধারার দলগুলোর সঙ্গে চাচক্রে মিলিত হচ্ছেন বিএনপির সিনিয়র কয়েকজন নেতা।

এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শনিবার (১৯ এপ্রিল) যুগপতের অন্যতম শরিক ১২ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান নজরুল ইসলাম খান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান।

বৈঠকে গত ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিএনপির বৈঠকের বিষয়ে আলোচনা হয়। বিশেষ করে ওই বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে কী বলা হয়েছে, বৈঠকের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অসন্তুষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন, চিঠিতে কী ছিল— এসব বিষয় উত্থাপিত হয়।

এ বিষয়ে ১২ দলীয় জোটের একজন নেতার ভাষ্য— বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কাট অফ লাইন চায়। তারা এ বিষয়ে জনমত ও দলমত গঠন করতে চায়। এজন্য সব দলের সঙ্গে বসতে চায়। ডান, বাম, প্রগতিশীল, ইসলামি দল— সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বদলীয় মত তৈরি করতে চায়।

আরেক নেতা বলেন, ‘বিএনপির পক্ষ থেকে বিগত ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, ২৪-এর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, এমন দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠকের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে।’

ইতোমধ্যে দীর্ঘ প্রায় এক বছরের বেশি সময়ের প্রচেষ্টার পর অবশেষে সিপিবি-বাসদসহ বাম ধারার দলগুলোর সঙ্গে রবিবার চা-চক্রে মিলিত হচ্ছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এই চা-চক্রের অগ্রগতি হলে পরবর্তী সময়ে আরও আলোচনা দেখা যাবে।

শনিবার (১৯ এপ্রিল) বিকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গ্রেটার ঐক্য গড়ে তুলতে চায় বিএনপি।’

১২ দলীয় জোটের এক নেতা জানান, বিএনপি নির্বাচন প্রশ্নে সব দলকে মর্যাদার সঙ্গে সবার মতামতের ভিত্তিতে একটি অবস্থান তৈরি করে সরকারের উদ্দেশে জানাতে চান।

শনিবার এলডিপির সঙ্গে বিএনপির বৈঠকতবে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ কয়েকটি ইসলামি দল নির্বাচন প্রশ্নে ‘ডিসেম্বরের মধ্যে থাকতে চায় না’। প্রকাশ্যে এসব দল সংস্কার করার ও আওয়ামী লীগের বিচার শুরু করার পর নির্বাচনের দাবি তুলছে।

১২ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা অবশ্য নির্বাচন পেছানোর দাবিতে বিরাজনীতিকরণের চক্রান্ত দেখছেন।

রবিবার (২০ এপ্রিল) দুপুরে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর প্রথম ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। আমরা জেনেছি— বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে। আমরাও মতামত দিয়েছি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে যেন নির্বাচন হয়। এটাই নির্বাচনের কাট-অফ টাইম। এরপরও কেউ কেউ চায় নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করতে। কিন্তু লক্ষণীয়, ডিসেম্বরের পর আমাদের দেশে প্রাকৃতিকভাবে অনেক দুর্যোগের শঙ্কা থাকে, রোজা থাকে, বৃষ্টিবাদল শুরু হয়। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরই উপযুক্ত সময় জাতীয় নির্বাচনের।’

‘তবে নির্বাচন পেছানোর একটি কথা সামনে আসছে। এটা বিরাজনীতিকরণের চক্রান্ত। এ কারণে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। গণতন্ত্রে প্রবেশের ফটক হচ্ছে নির্বাচন’ বলে উল্লেখ করেন সৈয়দ এহসানুল হুদা।

নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে আনতে রবিবার গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করবে বিএনপি। দলটির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বিকাল ৫টায় গুলশানে এই বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী নেতৃত্ব দেবেন।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার ওপর আস্থার সংকট দেখা দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এক্ষেত্রে তার ওপর আস্থার রাখার পাশাপাশি কূটনৈতিক পর্যায়ে শক্ত ভূমিকা প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রক্রিয়াটিও গুরুত্বপূর্ণ।

‘আর এ কারণেই সিপিবি-বাসদের আজকের বৈঠকটি গুরুত্ব রাখে বিশেষ’ এমনটি মত দেন গণতন্ত্র মঞ্চের একজন প্রভাবশালী নেতা।

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল মনে করেন, বিএনপি বেশি চাপাচাপি করলে সরকার দেশি-বিদেশি ‘ট্র্যাপে’ পড়তে পারে। এক্ষেত্রে সুবিধা পাবে জামায়াত। নির্বাচন নিয়ে অধৈর্য হলে পরিস্থিতি ভয়ানক পরিণতি ধারণ করতে পারে, এমন সতর্কতাও বিএনপির থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

ইতোমধ্যে এবি পার্টির চেয়ার‌ম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে কর্মসূচির দিকে গেলে অন্য একটি পক্ষ ‘এ মুহূর্তে নির্বাচন নয়’ বলে প্রকাশ্যে আসলে পরিস্থিতি অযথা জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

ইতোমধ্যে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনের নেতারা সংস্কার আগে বললেও জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের লন্ডন সফরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ, ইসলামী আন্দোলনের নির্বাচনি পরিচালনা কমিটি গঠন, এনসিপির নেতাদের নির্বাচনি আসনকেন্দ্রিক প্রচারণার কারণে তাদের অবস্থান নিয়ে অনেকে মধ্যে ‘ধোঁয়াশা’ রয়েছে।

 

বিএনপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে ইসলামী ঐক্যজোটের একজন শীর্ষনেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরে দেখা যাক, ইনশাল্লাহ।’

এর বাইরে ইসলামপন্থি ও তরিকতপন্থি কয়েকটি দলের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে বিএনপির সিনিয়র নেতারা যোগাযোগ রাখছেন। এরমধ্যে একটি দলের চেয়ারম্যান এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, তিনি ও তার দলের নেতারা নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম গঠনে কাজ করছেন। বিএনপির সঙ্গে তাদের নির্বাচনি সমঝোতা দেখা যেতে পারে।

শনিবার (১৯ এপ্রিল) ১২ দলীয় জোট, এলডিপির সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারাই রাজপথে ছিলেন আমরা সবার সঙ্গে কী করা যায়— তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি। এই আলোচনা শেষে আমরা বলবো আপনাদের যে, কী করা যায় বা কী করা যায় না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি না যে, তেমন কিছু দরকার হবে। কারণ এই সরকার যারা আছে, আমরাই এই সরকারকে বসিয়েছি, এই প্রত্যাশায় যে, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তারা ভূমিকা পালন করবেন। তারা জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করুন, এটা আমরা আশা করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘কাজেই এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। আমরা মনে করি, সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করবে। সরকার কাজ করেন সেজন্য আমরা আমাদের মতামত তুলে ধরছি আপনাদের মাধ্যমে। সরকার সেটা শুনবে, শুনে কাজ করবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।’

উল্লেখ্য, নজরুল ইসলাম খান জানান, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে মতামত তুলে ধরবে সরকারের উদ্দেশে।