ছাত্রনেতাদের চোখে আওয়ামী লীগ

পূর্ববাংলার মানুষের মুক্তির আকুতি থেকে জন্ম নেয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, পরে যার নাম হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। হাঁটি হাঁটি পা পা করে দলটির বয়স এবার ৭৫ বছর পূর্ণ হলো।

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ এই পথচলাকে বর্তমানের ছাত্রনেতারা দেখছেন দুই পর্বে— স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় ও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে দলটির সফল নেতৃত্ব ও মতাদর্শের বিষয়ে প্রশংসা করেন ছাত্রনেতারা। তারা বলছেন, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দলটির অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

তবে স্বাধীন বাংলাদেশে দলটির ভূমিকা ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে রয়েছে আলোচনা ও সমালোচনা। আওয়ামী লগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তাদের মূল দলের প্রশংসা করলেও বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো বলছে— আওয়ামী লীগের আগের অবস্থান পাল্টে গেছে। নীতিহীনরা দলটিকে গ্রাস করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রবণতা না রুখলে অচিরেই অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে দলটি।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানবীর হাসান সৈকত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হচ্ছে এমন একটি দল, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগ নামটি। আর স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া মানে হচ্ছে দলটির প্রতি বাংলাদেশের সাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষাও অনেক।’

তিনি বলেন, ‘আমরা জানি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। আমরা ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি, আওয়ামী লীগ জনমানুষের কল্যাণে কাজ করে। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের অর্ধেক সময় মানুষের মুক্তির জন্য কারাবরণ করেন। একইভাবে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা প্রত্যাশা রাখি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের কল্যাণে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে, সামনের দিনেও করে যাবে।’

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পথচলা দীর্ঘ সময়ের। আওয়ামী লীগের রাজনীতি মূল্যায়ন করতে হলে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দুই ধাপে মূল্যায়ন করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্র এক রকম ছিল। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে সেই চরিত্র ভিন্ন রকম। আমরা যদি স্বাধীনতার অর্ধ শতক পরে বর্তমান সময়ে এসে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মূল্যায়ন করি, তাহলে বলতে হবে— রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তার জনমুখী রাজনীতির পথ হারিয়েছে।’

‘স্বাধীনতার পর থেকেই জনগণকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সবসময়ই রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে কক্ষচ্যুত হয়েছে এবং বর্তমানে একটি স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে’, মন্তব্য করেন এই ছাত্রনেতা। তিনি বলেন, ‘প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল হিসেবে অতীতের ভুল শুধরে দেশ ও জাতির স্বার্থে আওয়ামী লীগের উচিত— জনমুখী রাজনীতিতে ফিরে আসা। অন্যথায়, বর্তমান ধারায় রাজনীতি চলমান রাখলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।’

ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির উত্থানের পেছনেও আওয়ামী লীগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নানা ধরনের সংকট সত্ত্বেও এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এত দীর্ঘ রাজনৈতিক ঐতিহ্য যে রাজনৈতিক দলের রয়েছে, সেই দল আজ দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে, গণতন্ত্র হরণ করে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করেছে। যা আওয়ামী লীগের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং এটি আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্যও কল্যাণকর হচ্ছে না’, বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এই ছাত্রনেতা আরও বলেন, ‘রাজনীতিতে ক্ষমতায় থাকতে পারাই শুধু সফলতা নয়, এটা আওয়ামী লীগের মতো দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আজ বুঝতে পারছে না। আমি আশা করবো, আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যা অর্জন করেছে, তা ধরে রাখবে।’

ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংযোগ রয়েছে। এককালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এদেশের জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেছে। কিন্তু শুরুর আওয়ামী লীগ আর বর্তমান আওয়ামী লীগের মধ্যে আমরা বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করি। এটা আমাদের জন্য আসলে দুঃখজনক। তারা ইতোমধ্যে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ধারাবাহিকভাবে এটা চলতে থাকলে তারা অস্তিত্ব সংকটেও পড়বে।’

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রথমত আওয়ামী লীগ একটি পুঁজিবাদী শ্রেণির দল। পাকিস্তানের বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠার পর সেই আন্দোলনে আওয়ামী লীগের যে ঐতিহাসিক অবদান ছিল, তা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ১৯৭১ সালে আমরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে দেশটি পেলাম, দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল— শোষণ ও বৈষম্যহীন একটি রাষ্ট্র পাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ দেশটিকে সাধারণ মানুষের পক্ষে পরিচালনা করেনি। বরং তারা শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে দেশ চালালো।’

‘দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে’,  দাবি করে বামপন্থী এই ছাত্রনেতা আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মধ্যে পুরনো যারা আছেন, যারা মনে করেন— আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের জন্য কিছু করবে, তারা দলের ভেতরে কোণঠাসা হয়ে আছেন। আওয়ামী লীগে দুর্নীতিবাজ বাড়ছে। এটার অবসান ঘটাতে হবে।’