২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অগ্রযাত্রা শুরু করবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ কার্যকর করা এবং যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই মোকাবিলা করতে পারবে।
বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন ও স্যোশাল মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত টানা ৩ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গণতান্ত্রিক ধারা ও স্থিতিশীলতা বজায় রেখে জনকল্যাণমুখী ও সুসমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক দেশ বিনির্মাণের পথে জাতিকে অগ্রসরমান রেখেছে। ইতোমধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি টেকসই ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। ২০২৬ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হবে। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি।
বঙ্গবন্ধুন শাসনামলের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তানের পোড়া-মাটি নীতির ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত অকাঠামো ও অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে জাতির পিতা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। মাত্র ৩ বছর ৭ মাস ৩ দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকার পরিচালনা করে বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৯১ মার্কিন ডলার। জাতির পিতা মাত্র সাড়ে ৩ বছরে তা বাড়িয়ে ২৭৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত করেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত বাংলাদেশের অবৈধ সরকারগুলো দীর্ঘ ১৬ বছরে মাথাপিছু আয় মাত্র ৫ ডলার বাড়ায়। জাতির পিতার আমলে প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ অতিক্রম করে। কিন্তু জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর থেমে যায় বাংলাদেশের সব উন্নয়ন অগ্রগতি।
জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে অবৈধ নির্বাচন করার ব্যবস্থা করে। সে নির্বাচনে ১০০ শতাংশের বেশি ভোট দেখানো হয়। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জনগণের সমর্থন নিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতাসীন সরকার, জাতির পিতার হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারী এবং যুদ্ধাপরাধীদের সব রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসি।
দেশে ফেরার পর জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করেন উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, সংগ্রাম করতে গিয়ে বার বার আমার ওপর আঘাত এসেছে। সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, বার বার গ্রেফতার হয়েছি। আমাকে অন্তত ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমি দমে যাইনি। অবশেষে মানুষের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হই।
রাজনৈতিক দল ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেয় ফখরুদ্দীনরা
ওয়ান ইলেভেনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে কারচুপির উদ্দেশ্যে ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটারের তালিকা প্রণয়ন এবং আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন গঠন করে। তাদের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশকে অন্ধকারের পথে ধাবিত করে। যার ফলে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। সামরিক বাহিনী অন্তরালে থেকে ক্ষমতা দখল করে। ইয়াজউদ্দীন, ফখরুদ্দীন, মইনুদ্দীনের এই সরকার জনগণের অধিকার হরণ করে তাদের ওপর স্টিমরোলার চালানো শুরু করে। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোকে ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেয়। আমাকে ও আমার দলের বহু নেতাকর্মীসহ অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের বন্দি করা হয়। ভিন্ন দল গঠন করার চেষ্টা করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তাদের এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সচেতন দেশবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ায়। জনগণের আন্দোলনের মুখে তারা নবম সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৩৩টি আসনে বিজয়ী হয়। আর বিএনপি এককভাবে মাত্র ৩০টি আসনে জয়ী হয়। বাকি আসনগুলি উভয় জোটের শরিকেরা পায়।
১৫ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিরাট ব্যবধান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। মানুষ আজ স্বপ্ন দেখে উন্নত জীবনের। স্বপ্ন দেখে সুন্দরভাবে বাঁচার।
খাতভিত্তিক উন্নয়ন
২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের অগ্রগতি চিত্র তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, প্রবৃদ্ধি ৭.২৫ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ৫ গুণ বৃদ্ধি, বাজেটের আকার ১২ গুণ বৃদ্ধি, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ১৩ গুণ বৃদ্ধি, জিডিপির আকার ১২ গুণ বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ গুণ বৃদ্ধি, রফতানি আয় ৫ গুণ বৃদ্ধি। বার্ষিক রেমিট্যান্স ৬ গুণ বৃদ্ধি। বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ৫ গুণ বৃদ্ধি।
একজন কৃষিশ্রমিকের ক্রয় ক্ষমতা ৩ গুণ বৃদ্ধি, শ্রমিকদের মজুরি ৯ গুণ বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ গুণ বৃদ্ধি, রফতানি আয় ৫ গুণ বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার ৪১.৫১ শতাংশ থেকে ১৮.৭ শতাংশে হ্রাস, অতি দারিদ্র্যে হার ৫ গুণ কমেছে।
সুপেয় পানি ৫৫ শতাংশ থেকে ৯৮.৮ শতাংশ বৃদ্ধি, স্যানিটারি ল্যাট্রিন ৪৩.২৮ শতাংশ থেকে ৯৭.৩২ শতাংশ বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুহার হাজারে ৮৪ থেকে কমে ২১ জন, মাতৃ মৃত্যুহার প্রতি লাখে ৩৬০ জন থেকে কমে ১৫৬ জন।
মানুষের গড় আয়ু হয়েছে ৭২.৮ বছর। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৮ গুণ বৃদ্ধি। বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগের হার ২৮ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি। স্বাক্ষরতার হার ৭৬.৮ শতাংশ বৃদ্ধি। কারিগরি শিক্ষা ২২ গুণ বৃদ্ধি। দানাদার শস্য উৎপাদন ৪ গুণ বৃদ্ধি।
মেগাপ্রকল্প
সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। ঢাকায় মেট্রোরেল চালু করেছি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে, পাতাল রেলের কার্যক্রম উদ্বোধন করেছি। রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছি। উদ্বোধন করা হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। চট্টগ্রামে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পাতাল সড়কপথ- বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ করেছি। কক্সবাজারে দৃষ্টিনন্দন রেলস্টেশন স্থাপন করে ঢাকা-কক্সবাজার রেল রুট চালু করেছি। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
তিনি জানান, অর্থনীতির যে কোনও সূচকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০০৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে উৎকর্ষ সাধন হয়েছে। ২০০৯ সালে জিডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে জিডিপির পরিমাণ বেড়ে ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ৭ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়।
ইশতেহার
আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের প্রসঙ্গ টেনে দলের সভাপতি বলেন, কী অবস্থায় দেশকে পেয়েছিলাম, আর আপনাদের জীবনমান উন্নয়নে কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি, ইশতেহারে তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছি। দেশের যে উন্নয়নের ধারা সূচিত হয়েছে, তা টেকসই করে আরও উন্নত জীবন যাতে আপনারা পান, আপনাদের ভোটে নির্বাচিত হতে পারলে আগামী ৫ বছরে আমরা কী কী কাজ করবো সেই ব্যাখ্যা তুলে ধরেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ধারাবাহিকতায় আমরা ২০২৪ সাল থেকে স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ে তোলার ইশতেহার ঘোষণা দিয়েছি। এবারের ইশতেহারে জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্য থেকে যে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছি আমি তা আপনাদের সামনে উল্লেখ করছি–
১. সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার করা।
২. দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয় ক্ষমতার আওতার মধ্যে রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
৩. কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুব সমাজের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা।
৪. আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
৫. উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা যান্ত্রিকীকরণ ও উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া।
৬. কৃষি পণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা।
৭. গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত অবকাঠামো এবং শিল্প কলকারখানা গড়ে তুলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
৮. ব্যাংক বীমা ও আর্থিক খাতের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৯. নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্য সেবা সুলভ করা।
১০. সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করে ব্যক্তি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
১১. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে গড়ে তোলা ও তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
১২. সাম্প্রদায়িকতা ও সবধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করা।