দখল করা জমিতে মসজিদ নির্মাণ, ইসলাম কী বলে

হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় আসেন, তখন একটি মসজিদ নির্মাণে মনোযোগ দিয়েছিলেন। মসজিদের জন্য প্রস্তাবিত জায়গাটি ছিল দুজন এতিম বালকের। জমিটি তারা বিনামূল্যে দান করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু তারা এতিম ছিলেন। তাই রাসুল (সা.) তাদের জমির ন্যায্য মূল্য প্রদান করেন (আর রাহীকুল মাখতুম, ১২৩)। এখানে মসজিদের জায়গা দান করতে চাওয়ার পরও রাসুল (সা.) তারা এতিম-অসহায় এজন্য তাদের দান গ্রহণ করেননি। সেখানে দখলকৃত ও অন্যের মালিকানার জায়গাতে মসজিদ নির্মাণ কীভাবে বৈধ হবে?

ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্রতম ইবাদতঘর মসজিদে নববী নির্মাণের এই ইতিহাসের বাইরেও আরও অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। যাতে স্পষ্ট যে, বৈধ মালিকানা ছাড়া কোনও স্থানে মসজিদ নির্মাণ অবৈধ কাজ।

ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে দেখা যাবে, তুরস্কের ‘আয়া সোফিয়া’ মসজিদকে সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ জোর করে তৎকালীন বাইজানটাইনদের কাছ থেকে ‘কেড়ে নেন’ বলেও কেউ কেউ দাবি করেন। কিন্তু বাস্তব ইতিহাস ভিন্ন; ১৪৫৩ সালে কুসতুনতুনিয়া (বাইজানটাইন) বিজয় হয়। নিয়ম অনুসারে শহরের সবকিছুর মালিকানা চলে আসে মুসলিমদের হাতে। এরপরও সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ তৎকালীন গির্জার যাজকদের কাছে সেন্ট সোফিয়াকে কেনার প্রস্তাব দেন। এতে সেন্ট সোফিয়ার যাজকরা একটি লিখিত দলিলের মাধ্যমে সুলতান আল ফাতিহের কাছে গির্জা ঘরটিসহ জমি বেচে দেন এবং সুলতান তা মসজিদের জন্য ওয়াকফ করে একটি ট্রাস্টের কাছে সমর্পণ করেন। সেই থেকে ‘সেন্ট সোফিয়া’ গির্জাটি ‘আয়া সোফিয়া’ নামে মুসলিম বিশ্বের গৌরবোজ্জ্বল মসজিদ হিসেবে পরিচিত হয়ে এসেছে। যেহেতু সুলতান জমি ও স্থাপনা নিজ অর্থে কিনে নিয়েছিলেন, তাই সেটাকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়।

ইসলামি ইতিহাস বিষয়ে অভিজ্ঞ মাসিক মদিনার বিভাগীয় সম্পাদক মাওলানা খালেদুজ্জান সিরিয়ার ঐতিহাসিক উমাইয়া মসজিদ সম্পর্কেও একই কথা বলেন। তিনি জানান, ‘উমাইয়া শাসক ষষ্ঠ খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিক দামেস্কে মসজিদে উমাইয়া নির্মাণের ইচ্ছা করলেন। বর্তমান মসজিদটি যেখানে, সেই জায়গাটিতে ছিল একটি গির্জা। তখন তিনি পাদ্রিদের সঙ্গে কথা বললেন এবং সমঝোতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সেটি কিনে নিয়ে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করলেন। শুধু তাই নয়; কেনার পরও এই জায়গার বদলে খ্রিস্টানদের অন্যত্র গির্জা নির্মাণের জায়গা বরাদ্দ দেন। এসব উদাহরণের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, কোনও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত কিংবা অন্য কোনও কারণে অন্যের মালিকানাধীন জমিতে মসজিদ নির্মাণ করা যাবে না।

শুধু অন্যের জমিতে নয়; বৈধ জমিতেও যদি কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে মসজিদ নির্মাণ করে, সেটিও শরঈ মসজিদ বিবেচিত হবে না। রাসুল (সা.)-এর যুগের এমন একটি ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য—  মহানবী (সা.) মদিনায় আসার পর মদিনার আউফ গোত্রের বনু আমর বিন আউফ শাখার লোকেরা মদিনার অদূরে মসজিদে কোবা নির্মাণ করে। তাদের আমন্ত্রণে মহানবী (সা.) এখানে নামাজ আদায় করেন। বিষয়টি হিংসাকাতর করে তোলে খাজরাজ গোত্রে অবস্থানরত তাদের ভাই বনু গুনম বিন আউফ শাখার লোকদের। তারাও মসজিদে কোবার পাশে একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য জেদ ধরে। অবশেষে তারা মসজিদ নির্মাণ করে নেন।

মহানবী (সা.) যখন তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন, তখন তারা এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.), দুর্বল ও অক্ষমদের কথা ভেবে, বৃষ্টিময় রাতের কথা চিন্তা করে আমরা নিজেদের এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেছি। আপনি যদি তাতে নামাজ আদায় করেন এবং এর বরকতের জন্য দোয়া করেন, তাহলে আমরা খুশি হবো।’

মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমি তো এখন যুদ্ধের সফর নিয়ে ব্যস্ত। ফিরে আসার পর আমি যাবো। তোমাদের সঙ্গে নামাজ আদায় করবো।’

মহানবী (সা.) তাবুক থেকে ফিরে আসার পর তারা তাঁকে নিয়ে যেতে এসেছিলেন। ইতোমধ্যে তারা এই মসজিদে জুমাসহ তিন দিন নামাজও পড়ে ফেলেছেন। এরপর এ বিষয়ে কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়। মহানবীকে (সা.) সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, এই ‘মসজিদ’ জেদবশত এবং ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতিসাধনের জন্য নির্মিত হয়েছে। তারপর রাসুল (সা.) মালিক বিন দুখশুম, মাআন বিন আদি, আমের বিন সাকান ও ওহশিকে ডেকে এই ‘মসজিদ’ জ্বালিয়ে ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে তারা সেটি জ্বালিয়ে দেন এবং ধ্বংস করে ফেলেন। (আত-তাফসিরুল মুনির)

এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যারা মসজিদ নির্মাণ করেছে (ইসলামের) ক্ষতিসাধন, কুফরি ও মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ওই ব্যক্তির ঘাঁটিস্বরূপ, যে আগে থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে। তারা (মুনাফিকরা) অবশ্যই শপথ করবে, আমরা কল্যাণের (সৎ) উদ্দেশ্যেই তা (আলাদা ইবাদতখানা নির্মাণ) করেছি। আল্লাহ সাক্ষী, তারা তো মিথ্যাবাদী।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০৭)

অবৈধ জায়গায় মসজিদ নির্মাণের ব্যাপারে সবযুগের আলেমরাও একমত যে, তা জায়েজ নেই। এ প্রসঙ্গে দারুল উলুম দেওবন্দ ও জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া করাচির ফতোয়াও স্পষ্ট। প্রতিষ্ঠান দু’টি বলছে, কেউ অবৈধ জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করলে তা ভেঙে ফেলে অন্যত্র এমন ওয়াকফকৃত স্থানে মসজিদ নির্মাণ করতে হবে, যা কেউ নিজের সম্পত্তি থেকে ওয়াকফ করেছে।

তবে কোনও জায়গা যদি সরকারের খাস জমি হয় এবং সরকার তা অধিগ্রহণ করে নিয়ম অনুযায়ী মসজিদের জন্য বরাদ্দ দেয়, তাহলে সেখানে মসজিদ নির্মাণে কোনও সমস্যা নেই বলে জানিয়েছেন মাসিক মদিনার বিভাগীয় সম্পাদক মাওলানা খালেদুজ্জামান। তিনি বলেন, তবে অবশ্যই কোনও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে তিনি ওয়াকফ করা ছাড়া সেখানে মসজিদ নির্মাণ করা যাবে না।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও মাদ্রাসা শিক্ষক