মানচিত্র এঁকে শ্রোতাদের বোঝানো হয় ইসলামের ইতিহাস

মাওলানা সানাউল্লাহ জামালি (৩০) রাজধানীর মগবাজারে অবস্থিত হজরত শাহ নূরী (রহ.) জামে মসজিদের খতিব। কিশোরগঞ্জের সদরের তরুণ এই আলেম পাশাপাশি ডেমরার দারুন নাজাত মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। সম্প্রতি মাওলানা জামালির কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। সেগুলোতে দেখা যাচ্ছে, তার মসজিদে জুমার নামাজের আগে শ্রোতাদের সামনে মানচিত্র এঁকে এঁকে ইসলামি ইতিহাস নিয়ে বয়ান করছেন তিনি।

ইসলামি ইতিহাস বোঝানোর অভিনব এই পদ্ধতি মন কেড়েছে অনেকের। কিন্তু কেন তিনি এই পদ্ধতিতে বয়ান করছেন এবং কীভাবে এটি শুরু করলেন, ইত্যাদি বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। এতে তিনি নিজের কথাগুলো অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেলায়েত হুসাইন

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার ভিডিও দেখলাম। একটি ভিডিওতে আপনি মানচিত্র এঁকে এঁকে কারবালার ঘটনা বোঝাচ্ছিলেন। এই যে মানচিত্র, এটা কি আনুমানিক নাকি ইসলামি ইতিহাসের যে মানচিত্র আছে, ওটার ওপর ভিত্তি করে আঁকেন?

মাওলানা সানাউল্লাহ জামালি: মূলত আমাদের ইসলামের ইতিহাস প্রায় দেড় হাজার বছর আগের ঘটনাবলি নিয়ে। তখনকার ভৌগোলিক মানচিত্র যেটা, তা বর্তমানের সঙ্গে অনেকটা ফারাক আছে। মানুষকে যখন আমি বোঝাই, তখন বর্তমান মানচিত্রটা আঁকি। যে জায়গাটা অতীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেটা বর্তমান মানচিত্রে দেখাই এবং সেটার অবস্থান কোথায়, তা বলে দিই। আর অনেক জায়গায় শুধু অতীতের মানচিত্রগুলো আঁকা আছে, সেখানে বর্তমান বিভিন্ন দেশের যে সীমারেখা আছে, সেগুলো আঁকা নেই। এ কারণে এটা বোঝাতে কষ্ট হয় যে বর্তমান পৃথিবীর কোন দেশে জায়গারটির অবস্থান।

রাসুল (সা.) যে বুসরাতে গেলেন চাচাসহ, সে জায়গাটাকে বুসরা বলা আছে। তখন তো মূলত সেটা সিরিয়া ছিল না, তখন সেটা বিশাল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, যাকে বলা হতো শাম। সেই জায়গাটা (বুসরা) এখন সিরিয়ার মধ্যে আছে। আর এটা (মানচিত্র) এমন না যে আমার মনমতো টেনেছি; বরং আধুনিক মানচিত্র অনুসারে আঁকি। একইসঙ্গে মানচিত্র অনুযায়ী আঁকার পর সেটা অতীতের ইতিহাসের কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল বা ছিল না, সেটা বলে দিই। এভাবে উপস্থান করি।

বাংলা ট্রিবিউন: দেশের তো অনেক আলোচক আছেন, যারা কেউ তাফসির, কেউবা হাদিস বিষয়ে আলোচনা করেন। তবে আপনার আলোচনাটা ইতিহাসনির্ভর। সম্ভবত ইতিহাস নিয়েই বেশি আলোচনা করেন, তাই না?

মাওলানা সানাউল্লাহ জামালি: বিষয়টি এমন নয়। কোরআন ও হাদিসে যে বিশ্লেষণ আছে, সেগুলোই করি। এর মধ্যে কিছু ইতিহাস থাকে, সেগুলো সঙ্গে চলে আসে। মূলত ব্যাপারটা ইতিহাস নয়; বরং ব্যাপারটি হলো কোরআন ও সুন্নাহ। এ দুটির আলোচনা করতে গিয়ে কখনও কখনও ভৌগোলিক আলোচনা চলে আসে। কখনও বিজ্ঞানের একটা কথা বলতে হয়। তাই মূলত ইতিহাসকে টপিক ধরে তার ওপর আলোচনা করি। যেমন আমি যদি ‘আসহাবে ফিল’ সম্পর্কে আলোচনা করি, এটা কোরআনের একটি ঘটনা, আবরাহার একটি ঘটনা। কিন্তু আবরাহার অবস্থান কোথায় ছিল, সেটা এর সঙ্গে চলে আসে। ব্যাপারটা হচ্ছে এ রকম। আমি আবরাহাকে ফোকাস করতে চাচ্ছি না। আমি চাচ্ছি কোরআন-হাদিসকে ফোকাস করতে। সঙ্গে কোরআন-হাদিসের যে সংশ্লিষ্ট বিষয় আছে, সেগুলো যতদূর সম্ভব মানুষকে বোঝানোর সহনশীলতার জন্য এটা নিয়ে আসি।

বাংলা ট্রিবিউন: অনেকেই তো ইতিহাসটা বলেন কিন্তু মুখে বলেন। আর আপনি বোর্ডে এঁকে এঁকে দেখান। এটা কেন করেন?

মাওলানা সানাউল্লাহ জামালি: এটা একটা চমৎকার প্রশ্ন। আসলে আমাদের ইলম যেটা, একটা মানুষ যখন চোখে দেখে, এটাকে বলা হয় ‘ইলমুল ইয়াকিন’। বিশ্বাস ও বোঝার ক্ষেত্রে তিনটি ধাপ আছে—ইলমুল ইয়াকিন, আইনুল ইয়াকিন ও হাক্কুল ইয়াকিন। যখন মানুষ থিউরিক্যাল শুধু শোনে, তখন যতটা না উপলব্ধি করতে পারে, তার চেয়ে যখন দেখে সেটা আরও ভালো উপলব্ধি করতে পারে।

কোনও একজন ব্যক্তি বললো যে আগুনে পুড়লে খুব কষ্ট হয়, গা ঝলসে যায়, খুব বীভৎস ও বিশ্রী অবস্থা হয়। এটা বললে ঠিক আছে। কিন্তু একজন মানুষের সামনে যদি কাউকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন ব্যাপারটা আরও কঠিন হয়। আবার যদি সে নিজেই এটার মধ্যে পড়ে যায়, তাহলে আরও বেশি ভালোভাবে বুঝতে পারবে। আমরা তো অতীতের ইতিহাসে কাউকে নিয়ে যেতে পারি না, সেটা তো চলে গিয়েছে বা কোনও একটা বিষয় বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সেই জায়গায় তাকে নিয়ে যেতে পারি না। কিন্তু যখন এটা এঁকে বোঝাই, তখন মানুষ কেমন যেন অনুভব করে যে সে এটা দেখছে।

যেমন আমি যখন কারবালার একটা বর্ণনা দিলাম, তখন অনেকে টেলিফোন ও মেসেজ করে জানালেন যে হুজুর, মনে হলো যে সেদিন আমি কারবালার মাঠে ছিলাম। ঘটনাটি কেমন যেন আমি নিজের চোখে দেখছি, এমন একটা অবস্থা। তাতে মানুষের ফিলিংসটা খুব ভালো কাজ করে এবং একটা বিষয় বা ঘটনা বোঝার ক্ষেত্রে খুব সহজ হয় ও তা স্মরণীয় হয়ে থাকে। এ জন্যই মূলত এভাবে এঁকে এঁকে বয়ান করে থাকি। 

বাংলা ট্রিবিউন: এভাবে ইতিহাস বলা শুরু করেছেন কবে থেকে?

মাওলানা সানাউল্লাহ জামালি: সেটা খুব আগে থেকে না। আপনি কারবালা বিষয়ক যে ভিডিওটা দেখেছেন, এর আগে শুধু এভাবে আর মাত্র দুটি বয়ান করেছি। এক. কেবলা নির্ধারণ বিষয়ক। মানে আমরা কেবলা কীভাবে নির্ধারণ করি; সূর্যের আলো দেখেও তা করা যায়, চাঁদ দেখেও করা যায়। সেটাও আমি হাতে-কলমে দেখিয়েছি। কোরআন মাজিদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কিছু সাংস্কৃতিক সংকেত আছে, এই বিষয়গুলো নিয়েও আমি একটু দেখিয়েছি। বলা যেতে পারে, এটা শুরু করেছি চার মাস হলো।

বাংলা ট্রিবিউন: এ পর্যন্ত মানচিত্র এঁকে এঁকে এ রকম কয়টা ভিডিও বয়ান করেছেন?

মাওলানা সানাউল্লাহ জামালি: সাতটার মতো বয়ান আছে এ রকম।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি যেমন বললেন, অনেকে মুগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে আমিও একজন। আসলে এভাবে এঁকে এঁকে ইতিহাস বলার অনুপ্রেরণা কীভাবে পেলেন, যার মাধ্যমে মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছেন?

মাওলানা সানাউল্লাহ জামালি: অনুপ্রেরণাটা কারও থেকে শোনার পর কিংবা কেউ বলার পর নয়; আমি নিজে থেকেই প্রথমে শুরু করি। কারণ, আমি নিজেই একজন শিক্ষক। আমি যখন ক্লাসে পাঠদান করি, যেমন আমি একবার প্রক্সি ক্লাস নিলাম, ক্লাসের বিষয় ছিল রবিন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’। এটি একটি ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ কবিতা। আর এর মধ্যে কিছু ইঙ্গিত দেওয়া আছে। কবির ভাব কেমন! সেখাবে উনি একটা উদাহরণ এনেছেন, একজন কৃষক ধান কাটছেন, ধান বাড়িতে আনছেন। এই উদাহরণ টানতে গিয়ে উনি কিছু বাক্য ব্যবহার করেছেন, যেগুলো বোঝা একটু কঠিন। তাই আমি একটা ধানক্ষেত আঁকলাম, একজন কৃষক ও একটি নদীও আঁকলাম। দেখলাম, যিনি ওই বাংলা ক্লাসটা নিয়মিত করান, তার থেকে শিক্ষার্থীরা আমার ক্লাসটা বেশি গ্রহণ করেছে।

যদিও আমি এ বিষয়ের শিক্ষক নই, তবু শিক্ষার্থীরা বললো, বাংলাটা যেন আমি তাদের পড়াই। তখন আমি দেখলাম, এই এঁকে বোঝানোতে তারা ভালো বুঝতে পারছে। তাই আমি ভাবলাম, এটা যদি কোরআনের ক্ষেত্রে হয়, তাহলে কোরআন-হাদিস মুসলমানরা আরও ভালো বুঝতে পারবে। মূলত এখান থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া। পরে মসজিদে ট্রাই করে দেখি, মুসল্লিরাও খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছেন।

বাংলা ট্রিবিউন: একজন মুফাসসির কিংবা ইসলামি বক্তা হিসেবে আপনার স্বপ্ন ও লক্ষ্য কী?

মাওলানা সানাউল্লাহ জামালি: আমি কোরআনের ছাত্র। আমার মূল লক্ষ্য হচ্ছে কোরআনের আলোটা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং আমার বড় একটা উদ্দেশ্য এটাও যে আমরা যখন কথা বলি, তখন একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি করি। এ ক্ষেত্রে আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যখন কথা বলবো, তখন নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করবো না। কোরআনের সৌন্দর্য প্রকাশ করবো। এটাই মানুষকে বলবো।

একটা সময় মানুষের মধ্যে যখন কোরআনের সৌন্দর্য প্রকাশ পাবে, তখন এই মারামারি বা কোরআনের যে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, তা হবে না। একটা সময় সবাই কোরআনের সঠিক ব্যাখ্যা করবে এবং সমাজটা খুব সুন্দর হবে। একটা সময় যুবকরা কোরআনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একে অপরের প্রতি আন্তরিক হবে, ইনশা আল্লাহ।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনাকে ধন্যবাদ।

মাওলানা সানাউল্লাহ জামালি: বাংলা ট্রিবিউনকেও ধন্যবাদ।