বিশেষ সাক্ষাৎকারে জেড আই খান পান্না

সংবিধানে হাত দিয়েন না

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই মাস পূর্তি হলো। এই দুই মাসে সংস্কার, রাষ্ট্র মেরামত, সংবিধান পরিবর্তনের মতো নানা শব্দ আলোচনায় উঠে এসেছে। ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’, জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের জন্য বিচার থেকে শুরু করে নানা কিছুর মধ্য দিয়ে কেমন আছে বাংলাদেশ––সেসব নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন মুখোমুখি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের ট্রাস্টি জেড আই খান পান্নার।

বাংলা ট্রিবিউন: আমরা শুরু করি, বাংলাদেশ কেমন আছে?

জেড আই খান পান্না: বাংলাদেশ বাংলাদেশের মতো আছে। আমলটা পরিবর্তন হয়েছে। শেখ হাসিনার আমলের পর উনি দেশত্যাগের পরে এখন দেশ ইউনূস (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) সাহেবের হাতে আছে। উনি এবং উনার উপদেষ্টারা যেভাবে চালাচ্ছেন সেভাবে চলছে কিনা এটা আমি জানি না। তবে তারা চালাচ্ছেন।  চলছে কিনা এটা আরও কিছু দিন পরে বোঝা যাবে।  গাড়ি চালু হতে তো একটু টাইম নেয়। সেই টাইমটা দিতে হবে।

তবে গত দুই মাসে যেটা দেখেছি, আমার কাছে যেটা লক্ষণীয়––উন্নতি তেমন নেই, আইনশৃঙ্খলার অবনতি আছে। কিন্তু একটা জায়গায় উন্নতি আছে, এদের বিরুদ্ধে কোনও দুর্নীতির অভিযোগ নেই। এটা স্বীকার করতেই হবে। ওই ছাত্রদের তো আমি হিসাবে ধরি না, তবে হিসাবে ধরি না তাও ঠিক না। তারাই আন্দোলন করেছে। তাদের কোনও দোষ-ত্রুটি হতেই পারে। কিন্তু মূল যারা উদাহরণ হিসেবে আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান খান শুভ্র, সৈয়দ রেজওয়ানা হাসান আছেন, তাদের কারও সম্পর্কে কোনও দুর্নীতির অভিযোগ নেই।

মূল্যায়নের আগে অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও সময় দিতে চান জেড আই খান পান্না

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি বলেছেন চলছে কিনা জানি না। কিন্তু এই পটপরিবর্তনের পর আসলে কোন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি?

জেড আই খান পান্না: পদক্ষেপগুলোর মধ্যে জরুরি হলো––আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবনতি ঘটেছে, রিপেয়ার করতে (পুলিশকে) হলে তাদের (উপদেষ্টাদের) প্রকাশ্যে লজ্জা-শরম ঢেকে স্বীকার করতে হবে যে কতজন পুলিশ নিহত হয়েছে। সঠিকভাবে হোক বা বেঠিকভাবে হোক। নিহত কতজন হয়েছে এদের তালিকাটা দিতে হবে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার সন্দেহ হচ্ছে কেন?

জেড আই খান পান্না: চার শতাধিক থানায় আক্রমণ হয়েছে। এটা কারা করেছে? থানাগুলো কারা আক্রমণ করেছে? মফস্বলের থানাগুলো কোনও বাধা সৃষ্টি করেছিল? নাকি সেখানে আন্দোলন হচ্ছিল? আন্দোলন তো সব ঢাকাকেন্দ্রিক। আক্রমণগুলো ৫ তারিখের পর হয়েছে। তাহলে সেগুলো এভিডেন্স হিসেবে কেন নেবে না? সেগুলো কেন কমপ্লেইন হিসেবে নেবে না?

সেই পুলিশ যদি ওইখানে নিহত হয় তাহলে তো নির্দিষ্ট করে মামলা হওয়া দরকার এবং সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি কারা সেটাও তা জানা দরকার। এরা তো এই সরকারের জন্যও ঘাতক হতে পারে। তাহলে এটি কি সন্দেহের বিষয় না? আমি তো একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা। বলেন তো একাত্তরের কতটি থানা লুট হয়েছে? একটাও না। আমরা ঢুকেছি থানায়, যারা পাক হানাদারদের সাহায্য করেছিল তারা আর্মস রেখে ভেগে চলে গেছে। কোনও কনফ্লিক্ট হয়নি তো। কারণ এই দেশের স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য সর্বপ্রথম আত্মাহুতি দিয়েছিল রাজারবাগের পুলিশেরা। সর্বত্র সেনাবাহিনী থেকেও প্রথম অগ্রাধিকার অবস্থায় ছিল পুলিশেরা। সেই পুলিশের কতজন মারা গিয়েছে সেটা আমি জানবো না? তাহলে তো আমাদেরই আত্মীয়, আমাদেরই স্বজন বা এমনকি খুঁজলে পরে দেখা যাবে ড. ইউনূসেরও আত্মীয় আছে (নিহত পুলিশদের মধ্যে)। এটা তো নৈতিকভাবে দায়িত্ব। তার ছাত্রও আছে, এটা নৈতিক দায়িত্ব। একইসঙ্গে এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। কারণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে তারা মিসিং হয়েছেন, কতজন হয়েছেন প্রতিটি থানায় যে রেকর্ড করা হয়েছে এর জন্য দায়ী কারা? দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কি কোনও অভিযোগ আনা যাবে না? অভিযোগ তো একটা আনা উচিত। 

জুলাই-আগস্টে নিহত পুলিশ সদস্যদের সঠিক হিসাব দাবি করেছেন সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট এই আইনজীবী

বাংলা ট্রিবিউন: সে কাজগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো করতে পারে কিনা?

জেড আই খান পান্না: করার মতো পরিবেশ আছে কিনা? যেমন আমি নিজেই তো অনেক হুমকি পাচ্ছি। সোজাসুজি আমি বলি, এগুলো আমি তোয়াক্কা করি না। অনেক আগে থেকেই আমি এমন হুমকি পেয়ে আসছি। কারণ আমি জানি যে আমার মৃত্যু একদিন হবে। যেভাবে সিদ্ধান্ত আছে সেভাবেই হবে। একাত্তরে আমার পায়ের হাঁটুতে গুলি লেগেছে, আমি মারা যাইনি। তারপরও বহুবার বহুভাবে গুলি লেগেছে, কিন্তু আমি মারা যাইনি। যেদিন মারা যাবো সেদিন একেবারেই মারা যাবো। সেটা আততায়ীর হাতেও হতে পারে, করোনাতেও হতে পারে, ঘুমের মধ্যেও স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি বলেছেন একাত্তরের পর চব্বিশের জুলাই মাসে দ্বিতীয় বৃহত্তর গণহত্যা হয়েছে। এর বিচারের প্রক্রিয়া অনেক বেশি ছড়িয়ে গেছে বলে কি মনে করেন? আসামি শনাক্ত, তদন্তসহ বিচারের যে প্রক্রিয়া থাকে তা কি দৃশ্যমান? 

জেড আই খান পান্না: দৃশ্যমান মনে হয়নি আমার কাছে এখনও। কারণ হলো যে তদন্ত কর্মকর্তার অভিজ্ঞতার বিষয় আছে কিন্তু। আমি একজন ভালো আইনজীবী হতে পারি, কিন্তু ভালো তদন্ত কর্মকর্তা হতে পারবো এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। আমি একজন ভালো পুলিশ অফিসার হতে পারি, কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা যে ভালো হবো তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। যেটা দেখছি, মিডিয়া ও টেলিভিশনে তদন্ত চলছে। বাস্তবে কোথাও তদন্ত চলছে সেটা আমার চোখে দৃশ্যমান হয়নি। হয়তো এটা আমার ভুলও হতে পারে। কিন্তু আমার চোখে দৃশ্যমান হয়নি।

‘রিসেট বাটন’ কথাটি নিয়ে আপত্তি আছে জেড আই খান পান্নার

বাংলা ট্রিবিউন: সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার ‘রিসেট বাটন’ দিয়ে অতীত মুছে ফেলার প্রশ্নে আপনি কেন এত প্রতিক্রিয়া দেখালেন?

জেড আই খান পান্না: কেন দেখাবো না? কোথায় অডাসিটি (সাহস) পায় যে আমার একাত্তরের সব ইতিহাস মুছে দেবে? চব্বিশের পূর্বের সব ইতিহাস মুছে দেবে? কার এই অডাসিটি আছে? আমার সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় হলো একাত্তর। একাত্তর না হলে তো বাংলাদেশ হয় না, বাংলাদেশ না হলে তো উনাদের মতো লোক এতো জোর গলায় কথা বলতে পারে না। সংবিধান হাতে নিয়েই তারা শপথবাক্য পাঠ করেছে। সেই সংবিধান রক্ষা করেছেন? একাত্তরকে যে অস্বীকার করতে চায় তাহলে তো সে বাংলাদেশকেই অস্বীকার করে।

বাংলা ট্রিবিউন: শুরু থেকেই ছাত্রদের একটি গোষ্ঠী নতুন করে শুরু করতে হবে, নতুন বাংলাদেশ, নতুন স্বাধীনতা এগুলো বলেছিল।

জেড আই খান পান্না: না। নতুন করে এটা বিভিন্নভাবে আনা যায়। নতুন করে মানে একাত্তরকে বাদ দিয়ে না। বাংলাদেশকে নিয়েই অর্থাৎ মোর ডেমোক্র্যাটিক ওয়েতে, মোর সেক্যুলার ওয়েতে এগুলো হতে পারে। 

বাংলা ট্রিবিউন: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হিসেবে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করছিল। এখন সেটি জুলাই কেন্দ্রিক গণহত্যার অভিযোগ জানানোর জায়গা এবং নতুনভাবে গঠন করা হচ্ছে। জুলাই গণহত্যার জন্য আলাদা একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন?

জেড আই খান পান্না: ট্রাইব্যুনাল তো আলাদাই। আইন একটা সামনে রেখেছিল আসিফ নজরুল। খসড়া (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের খসড়া) আইনটা এখনও আমার মোবাইলে আছে। আইনের একটা ধারায় বলা হয়েছে––এই গণহত্যার দায়ে রাজনৈতিক দল অনধিক ১০ বছর পর্যন্ত বেআইনি করে রাখা হবে। এ বাদে খুব একটা বিষয় নজরে পড়েনি আমার চোখে। যেটা পড়েছে সেটা আমি সেখানে বলেছি এবং এটা বেশ ভালোভাবে ব্যারিস্টার সারা হোসেন ও ডেভিড বার্গম্যান  বলেছেন। তারা বলেছেন, তোমরা এটাকে আওয়ামী লীগকে টার্গেট করেছো? তারা একেবারে সরাসরি বলেছেন, মনে হয় তোমরা এটা আওয়ামী লীগকে টার্গেট করে এই আইনটা করতেছো।

বাংলা ট্রিবিউনের সিটি এডিটর উদিসা ইসলামের সঙ্গে আলাপচারিতায় জেড আই খান পান্না

বাংলা ট্রিবিউন: আইনটি যে নতুন করে সংস্কার করা হচ্ছে, বারবার বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে কার্যকর থাকবে না। আজ (৬ অক্টোবর) মাহমুদুর রহমান দাবি করেছেন এক সপ্তাহের মধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে।

জেড আই খান পান্না: মাহমুদুর রহমান কে? তিনি আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তো কি হয়েছে উনার? এত জ্ঞানী-বুদ্ধিমান হলেন কবে থেকে? উনি এর আগে কী ছিলেন? কোনও একটা সরকারি সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন এবং একইসাথে উনি বেক্সিমকোর অ্যাডভাইজারও ছিলেন। একই সময়ে উনি বেক্সিমকো অ্যাডভাইজার ছিলেন এবং এবং একই সময়ে তিনি বেক্সিমকো থেকে টাকা উত্তোলনও করতেন। পত্রিকায় আসার পরে তিনি বেক্সিমকো থেকে রিজাইন করেছেন। এই ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক কতটুকু ভালো হতে পারে? তার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস হওয়া উচিত। সরকারি থেকেও... বেসরকারি সংস্থার গাড়ি এবং বেতন অ্যাডভাইজার হিসেবে দুটোতো থাকতে পারে না। স্যরি। উনি কী বলেছেন না বলেছেন আমি ওনার কথার গুরুত্ব দিতে চাই না।

বাংলা ট্রিবিউন: দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা বারবার উঠছে, সে বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই যে এত বড় একটি ঐতিহাসিক দল, সেটাকে এভাবে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা?

জেড আই খান পান্না: আওয়ামী লীগের ইতিহাস ৭৫ বছরের। পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বিরোধী দল কিন্তু আওয়ামী লীগ। এটা বটবৃক্ষের মতো। বটবৃক্ষ কীভাবে জন্মায় তা তো জানেন। বটবৃক্ষের ফলগুলো বাদুড়ে খায় এবং ফলগুলো খেয়ে মুখ থেকে ফলগুলো যেখানে ফেলে তখন সে দানা থেকে কিন্তু আবার বটবৃক্ষ হয়। বাংলাদেশের এমন কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চল নেই যেখানে ন্যূনতম আওয়ামী লীগের কর্মী নেই। এদের (আওয়ামী লীগ সমর্থক) বলবো আমি দলান্ধ, ধর্মান্ধের মতো। ধর্মে যেরকম মানুষ বিশ্বাসে অন্ধ থাকে, ধর্ম-কর্ম করলাম না কিন্তু ধর্ম আমি মানি। ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বললে খুন করে ফেলতে পারে। এরকম দলান্ধ লোক আছে (আওয়ামী লীগে)। যেটা অন্য কোনও দলের নেই। আগে ছিল কমিউনিস্ট পার্টিতে। গ্রামে গেলে দেখা যেত একজন আছে যে কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচিত। এখন সেই অবস্থাতে নাই।

সংবিধান বাতিল নয়, বরং সংশোধনের পক্ষে জেড আই খান পান্না

সরকার অনেক কিছুই করে। ১৯৬৭-এর দিকে ইত্তেফাক, বরিশালে খাদেম আর খুলনার একটি, এই তিনটি পত্রিকা একসময় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আল্টিমেটলি থাকেনি, ওই ব্যান থাকেনি, ব্যান উঠে গেছে। আমাকেই ১৯৬৯-এর দিকে পূর্ব পাকিস্তান রাসটিকেট করেছিল। আমি পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও ভর্তি হতে পারিনি। পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে ভর্তি হয়েছি। আমার লেখাপড়া কিন্তু আটকাতে পারেনি। এই আইনগুলো কেন? আমার শিক্ষার পথ কেন বন্ধ করবে? মনে পড়েছে সেটা ভিন্ন। কিন্তু আজকের দিনে কেউ করলে পরে সেটা অফেন্স। মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।

আমি যদি খুনি হই, দোষীও হই আমার শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ যে মৌলিক অধিকার যেগুলো আছে সেগুলো তো বাধা দিতে পারেন না। শাস্তি আমাকে দিতে পারে, কিন্তু এই শাস্তি আমাকে দিতে পারে না যে তোমার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবা। এটা সভ্য জগতে চলে না। এই কারণে বললাম, আওয়ামী লীগকে বেআইনি করতে পারে, করলো, তাতে তাদের (নিষিদ্ধকারীরা) মানসিক একটা শান্তি পাবে, স্বস্তি পাবে। কিন্তু আপনি কি মনে করেছেন আওয়ামী লীগ পরবর্তীতে জামায়াত (জামায়াতে ইসলামী) হয়ে যাবে? বা নতুন কিংস পার্টিতে জয়েন করবে? নট অ্যাট অল।

আমি আওয়ামী লীগ করেছি ১৯৭১-১৯৭২ পর্যন্ত। এখন আমি আওয়ামী লীগ করি না। এখন তো কোনও দলই করি না। তারপরও আমি মনে করি আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতার মূল সংগঠক এবং নেতৃত্বদানকারী সংগঠন। তার নেতৃত্বেই সকল রাজনৈতিক আন্দোলন, দুয়েকটা আন্দোলন জামায়াত ইসলামের মতো অখ্যাত কুখ্যাত দলের। পাকিস্তানে তো এখন জামায়াত নাই, ভারতেও নাই। থাকতে পারে আফগানিস্তানে। মাঝে মাঝে স্লোগান দেয় যে– আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান। তো বাংলাদেশ কখনোই পাবে না, আর তালেবান যারা তারা ওইখানে গিয়েই তালেবানি করতে পারে। সিম্পল যেটা সেটা হলো, মৌলবাদী সংগঠন যদি হয়, সন্ত্রাসী যদি হয়, অতি সন্ত্রাসী, চরমপন্থি- তাদের আপনি বেআইনি ঘোষণা করতে পারেন। আওয়ামী লীগ তো তা না।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি সংবিধান সংশোধনের কথা বলছিলেন যে তিনটি জায়গায় সংশোধন করলেই হবে। সেই তিনটি জায়গা কোনটা?

জেড আই খান পান্না: তিনটি জায়গার একটি হলো– ৭০ অনুচ্ছেদ, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। এই তিনটি জায়গা সংশোধন করলেই হয়ে যায়। 

বাংলা ট্রিবিউন: সংবিধান সংশোধন করে কি বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা আনা সম্ভব? 

জেড আই খান পান্না: কোস্টারিকা নামে একটা দেশ আছে। যে দেশটা আমেরিকান না। কিন্তু তারা আমেরিকার একটি অঙ্গরাজ্য হওয়ার জন্য উদগ্রীব। এখন সেই অবস্থা যদি হয় আমি স্বাধীন থাকবো না, মূলত বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিচারক নিয়োগ এই প্রক্রিয়াটা আমাদের এখানে নাই। এখানে প্রক্রিয়াটা হলো, যে দল যখন যায় তখন তার বিচারক নিয়োগ দেয়। সে দলের মধ্যেও সৎ, যোগ্য, একনিষ্ঠ লোক আছে তাদের না। তারা নিয়োগ দেয় যারা অয়েলিং করতে পারে। পার্টিকুলারলি ব্যাকবোন তাদের নেই।  যোগ্যতার ভিত্তিতে নেয় না। সেখানে একটি নিয়োগের ওপরে একটি নিয়ম থাকা দরকার, যাতে যোগ্যতা ও মেধা, নিষ্ঠা, সততা; পাশাপাশি শাস্তির একটি প্রভিশন থাকা দরকার যে অন্য দশটা মানুষের মতো শাস্তি হলে তার হবে না, কারণ বিচার উনি করবেন সাধারণ মানুষের। তার মর্যাদা সাধারণ বা অন্য কোনও অফিসারের থেকে ওপরে। অতএব সে যদি বেআইনি, যদি ঘুষ খায়, দুর্নীতি করে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়, তাহলে তার শাস্তি যেন ওইভাবে হয়।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কি মনে করেন রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার দরকার?

জেড আই খান পান্না: মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। সারা পৃথিবীতে কিন্তু একটি পরিবর্তন আসছে। এটা অধঃপতনের দিকেই আমি বলবো। আব্রাহাম লিংকনের সাকসেসর (উত্তরাধিকারী) হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু। এখন আসছেন নরেন্দ্র মোদি। মাও সে তুংয়ের জায়গায় চিনপিং। এগুলো তো দেখতে হবে অধঃপতন শুধু আমাদের দেশে না, পৃথিবীব্যাপী। আবার ব্যতিক্রমও আছে, জার্মানির মার্কেল। বহু বছর ক্ষমতায় থাকার পরও নিজে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন।

আবার একটি পরিবর্তনের হাওয়াও আছে। সত্তরের দশকে শ্রীলঙ্কায় জনতা বিমূর্তি পার্টি বামপন্থি দল শ্রীলঙ্কার এক-তৃতীয়াংশ দখল করে নিয়েছিল। তাদের প্রথম-দ্বিতীয় জেনারেশন হত্যা করা হয়েছিল, তৃতীয় জেনারেশন ক্ষমতায় এসেছিল বিপুল ভোটে। নেপালে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে পার্টি রুল করছে। দুটোই কমিউনিস্ট পার্টি, এটা না হয় ওটা।

শপথ ভঙ্গ করলে অন্তর্বতী সরকার বৈধতা হারাবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী

বাংলা ট্রিবিউন: সেই পরিবর্তনের হাওয়া বাংলাদেশে কীভাবে দেখেন?

জেড আই খান পান্না: অ্যানার্কির মধ্যে কিন্তু দুপক্ষেরই লাভ হয়। একটা বামপন্থিদের, আরেকটা হলো মৌলবাদীদের। আপাতত লাভটা আমি দেখতে পাচ্ছি মৌলবাদীদের। এই কারণে যদি বামপন্থিরা কিছু করতে পারে। ন্যূনতম জায়গায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের সামনে এগোতে হবে। নেতৃত্ব দিতে হবে। 

বাংলা ট্রিবিউন: বর্তমান যে সরকার বা যে কাঠামো, তাদের কাছে আপনার কোনও আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা আছে?

জেড আই খান পান্না: একটা কথা বলবো যে সংবিধানে হাত দিয়েন না। আইন পরিবর্তন দরকার। খসড়া হলেও দরকার। সেটা হলো পুলিশ আইন, দণ্ডবিধি, ফৌজদারি আইন। এগুলো ব্রিটিশরা করেছিল সিপাহি বিদ্রোহ দমনের প্রেক্ষাপটে। এটায় আমাদের হাত দিতে হবে। কারণ আমরা সবাই ক্ষমতায় গেলে চাই যেন দমন-পীড়ন করতে পারি। ব্রিটিশরা যা করেছে শাসক অবস্থায় আমরাও যেন তা করতে পারি সেটা না। এসব পরিবর্তন করা দরকার। এই উপলব্ধিবোধ থেকে সামান্য যদি একটু হাত দেয় বা একটা কমিশন করে দেয় যে ল কমিশন এসব পরিবর্তন করবে।

যেসব মামলা পেন্ডিং আদালতে, সরাসরি ভেতর থেকে সিলেক্ট করেন। ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে আছে ৩০ হাজারের ওপর। তার মধ্যে ৫ হাজারের বেশি হবে ওভার কোয়ালিফাইড। রাতারাতি জুডিসিয়াল অফিসার সিলেকশনের যে সমস্যা, তা কমে যাবে। কাঠামোটা আপনি দিতে পারেন কিনা, কাঠামো দেওয়ারও একটা ওয়ে আছে। এখনও দেখা যায়নি আইনজীবীদের রেভিনিউ কত হয়েছে। আমরা যে কোর্ট ফি দেই, রেভিনিউ দেই, তা সবসময় অনেক বেশি। এই অংশটি দিয়ে কাঠামো (বিচার বিভাগের) তৈরি করুন।

এ সরকারের আরেকটি বিষয় আছে– এ সরকার যাতে জেলা প্রশাসক, পুলিশের এসপি এবং সরকারি সব কর্মকর্তা, তারা যেন সপরিবারে যার যার পোস্টিংয়ের জায়গায় থাকেন। তারা কেউ পোস্টিংয়ের জায়গায় থাকেন না। অথচ তাদের কারণেই জেলায় স্কুলগুলো করা হয়েছিল, সরকারি স্কুলগুলো করা হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলের আলিশান ঘরবাড়ি পড়ে আছে। সেগুলোতে যাবে না কেন তারা? মফস্বল এলাকার ছেলেমেয়েরা কি পড়াশোনা করে না? বঙ্গবন্ধু নিজেও গ্রামে পড়াশোনা করেছেন। আমার মনে হয় ড. ইউনূসও পড়াশোনা করেছেন। তাহলে কেন হবে না? জেলা প্রশাসকদের যদি প্রতিটি জেলায় বাধ্যতামূলকভাবে সপরিবারে পাঠাতে পারে, তাহলে দেশের অনেক উন্নতি হবে।

বাংলা ট্রিবিউন: গত দুই মাসে যেসব মামলা হয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশ হত্যা মামলা।

জেড আই খান পান্না: যেসব মামলা দিয়েছে, তা হয়রানির জন্য। আমি কয়েকটা মামলা দেখলাম, এর মধ্যে ৩৭টি মামলা প্রায় একই। শুধু বাদীর নাম ভিন্ন, আর ভিকটিমের নাম ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে গত ৪ আগস্ট গাড়ি ভাঙা হয়েছে। ভিডিওতে আছে বাইরের গেট খুলে এসে গাড়িগুলো ভেঙেছে এবং অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দিয়েছে। ওখানে একটি অক্সিজেন প্লান্ট আছে। ভাগ্য ভালো সেটিতে আগুন লাগেনি। সেটিতে আগুন লাগলে ওই এরিয়া আর থাকতো না। সেদিন ডাক্তাররা নেমে এসে প্রতিরোধ করে আগুন নিভিয়েছিল। অক্সিজেন প্লান্ট রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। অথচ তারপরে একজন নারী নিজেকে অভিভাবক দাবি করে সন্তানদের শাহবাগে উৎসাহ দেওয়ার জন্য এসেছেন বলে জানালেন– তিনি দেখেছেন যে ডাক্তাররা গাড়ি ভাঙতেছে। চিন্তা করেন তার প্রেক্ষাপট! মামলায় কোনও ডাক্তারের নাম দেয়নি, ফলে ডাক্তাররা এখন আতঙ্ক নিয়ে আত্মগোপন অবস্থায় আছেন। সেদিন একজন ডাক্তারকে কোনাবাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসেছে। কোনাবাড়ি থেকে যে ধরেছে গাজীপুরে কোনও রেকর্ড নেই। ডিবি নিয়ে আসছে, কিন্তু কোনও রেকর্ড নেই। শাহবাগ থানা মুখে মুখে বলতেছে যে আমাদের কাছে হ্যান্ডওভার করে গেছে।

বাংলা ট্রিবিউন: এগুলো নিয়ে আপনার কোনও কিছু বলার আছে কিনা?

জেড আই খান পান্না: আইনকে বেআইনিভাবে প্রয়োগে হয়রানির এই পথ পরিহার করুক। এটা কিন্তু আসিফ নজরুল বারবার বলতেছেন এটা হওয়া ঠিক না। তারপরও দেখতেছি তার কথা কেউ তোয়াক্কা করতেছে না। আসিফ নজরুলকে আমি বলবো যে তুমি ব্যর্থ হয়ে গেছো। তোমার কথা কেউ শুনতেছে না। তুমি বাধ্য করো শোনার জন্য। 

বাংলা ট্রিবিউন: বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে শুরু থেকেই কথা উঠেছে যে সংবিধানের কোথাও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলে কিছু নেই, এর বৈধতা জায়গায় আসতে করণীয় কি?

জেড আই খান পান্না: আপিল বিভাগ এদের এক রকমের বৈধতা দিয়ে দিয়েছে। অবৈধভাবে হলেও দিয়ে দিয়েছে। বৈধ। আরেকটা বিষয় হচ্ছে এই সংবিধান লিখিত। সংবিধানের যে সব কিছুই লিখিত থাকতে হবে সেটি নয়। অলিখিতও কিছু থাকে। আবার অলিখিত সংবিধানেও কিছু কিছু লিখিত থাকে। ব্রিটেনের  সংবিধান অলিখিত, এখানেও কিছু কিছু লিখিত আছে। সংবিধানেও অলিখিত বিষয় রয়েছে যেমন এই ভ্যাকিউমের সময় কী হবে? সে কারণে এটিকে লেজিটিমেট বলা যেতে পারে। অবৈধ একটা জায়গায় হবে, তারা যে সংবিধানে শপথ করেছে তার কোনোকিছু ভঙ্গ করলে। জনগণকে রক্ষা করা তাদের নৈতিক এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব। এখান থেকে তারা সরে গেলে তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আসবে।

বাংলা ট্রিবিউন: একজন জেড আই খান পান্না কোন সাহসের জায়গা থেকে কথাগুলো বলেন?

জেড আই খান পান্না: বিবেকের জায়গা থেকে। এর থেকে বড় সাহস নাই। স্কুলে স্কাউটে আমি সর্বোচ্চ পদক কায়েদে আদম ব্যাজ পেয়েছিলাম। এখন তার বিএনসিসি আমাদের সময়ে ইউটিসি ছিল। যাওয়ার পর আমাকে পাকিস্তানের হাবিলদার বললো তোমার দ্বারা জীবনেও রাইফেল হাতে নিয়ে প্যারেড করা চলবে না। ফিজিক্যালি তুমি ফিট না। বিষয়টি আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল এবং আমি ধরে নিয়েছিলাম রাইফেল হাতে নিয়ে আমার দ্বারা কিছুই সম্ভব না। কিন্তু ৭১ আমাকে বাধ্য করেছে। সে সময়ে এমন কোনও অস্ত্র নেই- এলএমজি, এসএমডি, গ্রেনেড, জি থ্রি রাইফেল সবগুলোই চালাতে পেরেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনাকে ধন্যবাদ।

জেড আই খান পান্না: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ছবি: নাসিরুল ইসলাম