শ্রমিক অসন্তোষ-অধিকার বিষয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে তাসলিমা আখতার

সময় বদলেছে, দমন করতে গেলে কী হয় গণঅভ্যুত্থান দেখিয়েছে

তাসলিমা আখতার একজন শ্রমিক অধিকারকর্মী এবং আলোকচিত্রী। গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি আশুলিয়া এলাকার কারখানাগুলোতে শ্রমিক ‘অসন্তোষ’কে ঘিরে নানা ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। কেন গার্মেন্টস অস্থির হলো এবং বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসে এতদিন ধরে কারখানা বন্ধ থাকার ঘটনাও বিরল। কারণ অনুসন্ধান ও অধিকারকর্মীর পর্যালোচনা জানতে তাসলিমা আখতারের সঙ্গে কথা বলেছে বাংলা ট্রিবিউন।

বাংলা ট্রিবিউন: সাম্প্রতিক অস্থিরতার বিষয়ে বিজিএমইএ থেকে বলা হচ্ছে শ্রমিকদের দাবিগুলো অযৌক্তিক। আসলেই কি তাই? মালিকদের কাছে দাবিদাওয়া সবসময় অযৌক্তিক কেন মনে হয়?

তাসলিমা আখতার: শ্রমিকদের দাবির কথা যদি বলি, তাহলে তারমধ্যে প্রধান হলো— বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং কোথাও কোথাও মজুরি বাড়ানো। অনেক কারখানায় বেতন নেই, রাজনৈতিক ক্ষমতাশীলরা গার্মেন্টস মালিক হওয়ায়, তারা অনেকেই এখন পালিয়ে গেছেন। সেসব কারখানা বন্ধ থাকায় বেকারত্বের শঙ্কা বাড়ছে। কারখানাভিত্তিক কিছু দাবিও সামনে এসেছে—  এর মধ্যে টিফিন বিল, হাজিরা বোনাস, নাইট বিল, ছুটির টাকা, মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধিসহ একাধিক দাবি শ্রমিকরা তুলেছেন। এগুলোর কোনোটাই অন্যায্য নয়। একজন শ্রমিক ‍দুপুরের খাবার খাওয়ার পর যদি ওভারটাইম করেন, তবে তাকে রাত ৯টা বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে ১২টা পর্যন্ত কারখানায় থাকতে হয়। এসময় তিনি কিছু যে খাবেন, সেই টিফিনের জন্য আপনি ১৫ টাকা দেবেন, সেটা কি করে হয়? ফলে তাদের দাবি যৌক্তিক। তবে কিছু দাবি আছে, সেগুলো দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। এসব ক্ষেত্রে যদি স্পষ্ট ঘোষণা আসতো, তাহলে শ্রমিকদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতার জন্ম নিতে পারতো না।

বাংলা ট্রিবিউন: তার মানে বলছেন, মানসিক অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে?

তাসলিমা আখতার: এবারের বিষয়টা একেবারেই আলাদা। জুলাই- আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর সবাই যার যার জায়গা থেকে দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।

শুধু পোশাক খাত নয়, গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন সেক্টর থেকেই দাবি উঠছে। গত ১৫ বছর মত প্রকাশের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে যে ভয়ভীতি, শঙ্কার মধ্যে বসবাস, শ্রমিকরাও এর বাইরে ছিলেন না। লম্বা সময় ধরে তারা নিজেদের কথা বলতে পারেননি। দাবি তুললে বা কথা বললেই হয় মামলায় পড়তে হতো, বা দালালদের দিয়ে কারখানায় ব্ল্যাক লিস্টে পড়তেন। সেই ভয় পেরিয়ে শ্রমিকরাও কথা বলতে শুরু করেছেন। এটাকে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে নিতে হবে। এই কথা বলাটা প্রকৃত শ্রমিকদের জন্য জরুরি। কেননা, কারখানা এলাকায় কিছু শ্রমিক ও শ্রমিক নেতার রূপধারী মানুষ থাকেন। যেকোনও পরিস্থিতি তৈরি হলে কিছু মানুষ নিয়ে তারা সেখানে হাজির হয়ে মালিকপক্ষের লোক হয়ে ফায়দা হাসিল করেন এবং শ্রমিকরা মাঝখান থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হন। শ্রমিকরা নিজেদের কথা নিজেরা বলতে শুরু করলে সেই জটিলতা আর হওয়ার সুযোগ থাকবে না। ফলে এই বলাটাকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে তার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। ফলে এর আগে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, পালাবদল দিয়ে এবারের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা যাবে বলে আমার মনে হয় না।

তাসলিমা আখতার (ছবি: সংগৃহীত)

বাংলা ট্রিবিউন: যেকোনও পরিবর্তনে যেসব সেক্টরে অস্থিরতা তৈরি করা হয়, তার মধ্যে গার্মেন্টস শিল্প একটি। এবারও কি তাই হলো, ঝুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার পালাবদল, নাকি অন্যকিছু। শ্রমিকের জায়গা থেকে দাবিটা কি শুধু শুধু. . .

তাসলিমা আখতার: না না, শুধু শুধু কেন হবে। তবে ৫ আগস্ট পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ফ্যাসিস্ট সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থও কাজ করছে। শুরু থেকে দেখেন, আনসারদের বিক্ষুব্ধ করা, রিকশা শ্রমিকদের দ্বিধাবিভক্ত করে আন্দোলন তৈরি থেকে শুরু করে মাজারে আগুন দিয়ে— নানাভাবে গণঅভ্যুত্থানের অর্জনকে নস্যাতের চেষ্টা আছে। তবে ওই যে বললাম, এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। এখন আর শ্রমিকদের চাকরির ভয় দেখিয়ে দমন করা যাবে না। এই আন্দোলনে ২৬ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আরও নাম না জানা কতজন আছে, কে জানে। এই শ্রমিকদের শহীদের মর্যাদা দেওয়া ও তাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না— শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার প্রতিউত্তরে দমনের ভাষা, বা কৌশল ব্যবহার করলে, সেটি হিতে বিপরীত হবে। সময় বদলেছে, শ্রমিকদের মন জয় করার চেষ্টা করতে হবে। দমনের পথে গেলে তার পরিণতি কী হয়, তা গণঅভ্যুত্থানই প্রমাণ করেছে।

বাংলা ট্রিবিউন: এই যে বহিরাগতরা উসকানিদাতারা অস্থিরতা তৈরি করে, তাহলে শ্রমিকদের দাবি কীভাবে আদায় হবে?

তাসলিমা আখতার: আমরা মনে করি, শ্রমিকদের সতর্ক থাকতে হবে। এই যে একটা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে বললাম, যারা একটা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই সেখানে গিয়ে হাজির হয়ে আরও ঘোলাটে পরিস্থিতি করতে হয়। গত কয়েকদিনে ‘বিগবস’ কারখানায় আগুন বা ‘মাসকট’ কারখানায় শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে শ্রমিকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছেন, কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের চক্রান্তে। সেক্ষেত্রে তাকেই মনে রাখতে হবে— কারও ঢাল হিসেবে যেন ব্যবহৃত না হন। এর বাইরে, দ্রুত কর্ম পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকার ও উদ্যোক্তাদের দিক থেকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া ও দীর্ঘমেয়াদি সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া জরুরি। এই খাতে যুক্ত শ্রমিক ও শ্রমিক নেতৃত্বসহ সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ইতিবাচক উদ্যোগ নিতে হবে৷

বাংলা ট্রিবিউন: মজুরি বাড়ানোর বাস্তবতা আছে কি? কদিন আগে বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা করা হলো।

তাসলিমা আখতার: দেখেন, মালিকরা কি ব্যবসাটা কম করছেন। আপনি দেখেন, শ্রমিকরা এক হয়ে একই ধরনের কোনও দাবি তোলেনি। কারখানার সমস্যার ভিত্তিতে একেক কারখানার শ্রমিকরা একেক ধরনের দাবি তুলেছেন। কেউ ৮দফা, কেউ ১২ থেকে ২১ দফা পর্যন্ত হাজির করেছেন। সেখানে একটা বড় আলাপ মজুরি নিয়ে। এই মজুরি চাওয়া শ্রমিকের জন্য ন্যায্যতার প্রশ্ন।

গত বছর শ্রমিকরা ২৫ হাজার টাকা মজুরি দাবি করলেও সেখানে সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরি করা হয়। এই বাজারে এই মজুরিতে চলা যে কঠিন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে কি। মাছ, মাংস, দুধ, ফলমূলের কথা বাদ দেই। শ্রমিকের জন্য ডিম খাওয়াটাও কঠিন হয়ে গেছে। তিনি এই টাকায় আশ্রয় নিশ্চিত করবে, নাকি সন্তানকে লেখাপড়া করাবে, নাকি খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। জীবন চালাতে তখন তাকে ওভারটাইম করতে হয়। সেটা ভীষণ ক্লান্তিকর। এই যে রাত ১২টা বা  ৩টা পর্যন্ত বাড়তি কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তিনি বিকালে বা রাতে কিছু খাবে না, এটা হয়? ফলে তাকে একটা মোটামোটি টিফিন খাওয়ার টাকা বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।

তবে মজুরি মূল্যায়ন যেহেতু সময়সাপেক্ষ বিষয়, এটার এখনই ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে। সেটা করে ধাপে ধাপে শ্রমিকদের অন্যান্য দাবি বিবেচনায় এনে কারখানা খুলে দিয়ে কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এই সেক্টর বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হবে।