দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি হয়ে আছে বলে মনে করেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষ অর্থপাচারকারী দেশ হয়ে গেছে। সংস্কারের ক্ষেত্রে এসব বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে। এগুলো কীভাবে পরিবর্তন করা যায়— এ মুহূর্তে সেটা ভাবতে হবে। বড় বড় দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে দুর্নীতিকে বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছে দুদক। এর ফলে কর্তৃত্ববাদের বিকাশ হয়েছে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান বাংলাদেশকে ‘নতুন বাংলাদেশ’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কীভাবে দুদককে আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক প্রভাব বলয় থেকে উদ্ধার করা যায়—কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। এছাড়া তিনি দুর্নীতি দমনে দুদককে সংস্কারসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।
বাংলা ট্রিবিউন: দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধানের পদ পেলেন, আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
ইফতেখারুজ্জামান: বাংলাদেশের দুর্নীতি প্রতিরোধে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) দীর্ঘদিনের প্রয়াসের যে চেষ্টা ছিল, সেটা হচ্ছে রাষ্ট্র কাঠামো ও আইনি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করতে সহায়তা করা। সেই কাজেরই একটা স্বীকৃতি এটা। দুদকের কার্যক্রমকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার একটা বড় সুযোগ।
বাংলা ট্রিবিউন: কোন জায়গাগুলোতে সংস্কার হওয়া জরুরি?
ইফতেখারুজ্জামান: এ নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই, তবে চিন্তা আছে। পরিকল্পনাটা আমার একা করা উচিত না। আমাদের যে কমিশন হবে, কমিশনে নিযুক্ত হবেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে যেটা হবে, সেগুলোর পর্যালোচনা সাপেক্ষেই আমরা সংস্কার পরিকল্পনা করবো।
আপনারা যেহেতু যৌক্তিক কারণেই জানতে চাচ্ছেন, ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন তো বটেই, দুদকের যে কার্যকারিতা, সেটা আমাদের কমিশনেরও এজেন্ডা, দুদকের সংস্কারে গঠিত কমিশন।
দুদকের জন্মলগ্ন থেকেই আমার সম্পৃক্ততা রয়েছে। দুদকের যে মূল আইন সেটাও টিআইবি প্রণীত। যে আইনটির ওপর ভিত্তি করে দুদক প্রতিষ্ঠিত হলো। সেই ২০০৪ সাল থেকে দুদকের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা শুরু। তখন প্রথম যে কমিশনটা হয়েছিল, ওই কমিশনের ওপরই আমি আসলে একটা গবেষণা করেছিলাম। তখন থেকে আমি কমিশনকে ধারাবাহিকভাবে ফলো করার চেষ্টা করছি। যেহেতু দুদকের জন্মের পেছনে আমাদের (টিআইবির) ভূমিকা ছিল, আমরা সবসময় চেয়েছিলাম— এ প্রতিষ্ঠানটি (দুদক) কার্যকর হোক। যেহেতু টিআইবির সরাসরি অবদান ছিল, সেজন্য আমাদের উদ্দেশ্য ছিল— একইভাবে এটাকে কার্যকারিতার দিকে নিয়ে যাওয়া এবং অগ্রগতির ক্ষেত্রে সহায়তা করা।
অপরদিক থেকে যেহেতু ‘ওয়াচ ডগ’ হিসেবে আমাদের ভূমিকা, সে হিসেবে কমিশনের ত্রুটি-বিচ্যুতির ওপর ভিত্তি করে পরামর্শ দেওয়া। সেটা আমরা করে এসেছি। সেখানেও আমাকেই নেতৃত্ব দিতে হয়েছে। সে অবস্থা থেকে আমার যতটুকু ধারণা, মোটামুটি কয়েকটা জিনিস এ মুহূর্তে ভাবতে পারি। একটি হচ্ছে, আসলে শুরু থেকেই যেটা হয়েছে, দুদকের শীর্ষ পর্যায়ের নিয়োগ, অর্থাৎ যাদের চেয়ারম্যান এবং কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়, এ নিয়োগটা একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে সেটাই অব্যাহত ছিল। শেষ পর্যন্ত এমন একটা জায়গায় এসে ঠেকেছে যে, তাদের নিয়োগ দেওয়া হয় দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তারা দলীয়ভাবে প্রভাবিত ব্যক্তি। কাজেই দলীয় সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য থাকে। যে কারণে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তাদের বিরুদ্ধে যখন কোনও অভিযোগ আসে বা দুর্নীতির তথ্য আসে, তখন তারা কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন না।
বাংলা ট্রিবিউন: বড় পদগুলোতে শুধুই কি রাজনৈতিক আনুগত্যে নিয়োগ হয়?
ইফতেখারুজ্জামান: এটা শুধু কমিশনারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দুদক একটা আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি বা জিম্মি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যেটা হওয়ার কথা ছিল না। যে ব্যুরোকে বন্ধ করে দিয়ে স্বাধীন কমিশন হিসেবে ‘দুদক’ করা হলো, তার অন্যতম কারণটাই ছিল, ব্যুরোটা ছিল আমলাতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত। সে জায়গায় এটাকে আমরা স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলাম। কমিশনারদের পরবর্তী যে ধাপ, সেখানেও কমিশনের সচিব থেকে শুরু করে দুদকের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সবাই প্রেষণে পাঠানো আমলা দিয়ে পরিচালিত। যার ফলে দুদকের কর্মী হিসেবে তাদের আনুগত্য সরাসরি আমলাতন্ত্রের প্রতি। যার ফলে দুদকের কর্মী হিসেবে যে ভূমিকাটা থাকার কথা, সে ভূমিকার তুলনায় আমলাতন্ত্রের সুরক্ষা দেওয়া, কিংবা স্বার্থ রক্ষা করার বিষয়টি তাদের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে।
দুদকের ম্যান্ডেট হচ্ছে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখা। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর সব দেশেই যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, সরকারি খাত বিশেষ করে অন্য খাত অর্থাৎ বেসরকারি খাতেও দুর্নীতি, সরকারি খাতে আমলাতন্ত্রের এবং রাজনীতিতন্ত্রের যোগসাজশ ছাড়া দুর্নীতি হয় না। কাজেই একদিক থেকে আমলাতান্ত্রিক প্রভাব, আরেকদিক থেকে রাজনৈতিক প্রভাব— এই দুটির সংমিশ্রনের প্রভাবে দুদক ভূমিকা পালন করতে পারেনি। সংস্কারের ক্ষেত্রে এটাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। এটাকে কীভাবে পরিবর্তন করা যায়, সেটা ভাবতে হবে।
দ্বিতীয় হচ্ছে, কমিশনের তো আরও জনবল আছে। মোটামুটি একটা বড় সংস্থা। ঢাকায়, ঢাকার বাইরে আছে। তাদের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, কিছু কিছু আমার জানামতে, যেহেতু ক্লোজলি পর্যবেক্ষণ করেছি— আমরা ধারাবাহিকভাবে তাদের বেশকিছু প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। গত সাত-আট বছর থেকে আমাদের সঙ্গে দুদকের এমওইউ বা সমঝোতা স্মারক আছে। সেটার ভিত্তিতে আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছি। আমার ধারণা ও বিশ্বাস যে, দুদকের বেশকিছু কর্মী আছেন, যারা একদিক থেকে দক্ষ এবং অপরদিক থেকে আবার সৎভাবে সাহসের সঙ্গে কাজ করতেও আগ্রহী। কিন্তু তাদের কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে। তাদের অনেককেই ভিক্টিমাইজড করা হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত আছে।
যারা আবার আমলাতন্ত্র ও দলীয় প্রভাবে প্রভাবান্বিত, সেই চক্রের হাতে সব কর্তৃত্ব। একদিক থেকে টেনশন বিরাজ করেছে, অপরদিক থেকে কার্যক্রম শুরু করেও অগ্রগতি হয়নি। দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে তো এটা আশা করা যায় না। যেটা হয়েছে বড়জোড় সেটা হচ্ছে— চুনোপুটি বা নিম্ন পর্যায়ের ব্যক্তি বা কর্মকর্তা-কর্মচারী, তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা টানা হেঁচড়া হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে শাস্তি হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু যাদের রুই কাতলা বলা হয়, তারা কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে শুধু তাই না, তাদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে।
এর মাধ্যমেই আমাদের বাংলাদেশে যে কর্তৃত্ববাদের অভাবনীয় উত্থান হয়েছে— সেটাকে ধরে রাখার জন্য যে রাষ্ট্র কাঠামোকে দখল করা, তারমধ্যে দুদক অন্যতম। এই দখলের মূল উপাদানটাই ছিল দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দেওয়া। বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের। এর ফলে দুদক নিজেকে কিন্তু দুর্নীতির বিকাশের সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। কারণ এ সুরক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে দুর্নীতিকে বিকাশের আরও সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এরফলেই কর্তৃত্ববাদের বিকাশ হয়েছে। কর্তৃত্ববাদ হয়েছেই দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। কাজেই এক্ষেত্রে একটা দুষ্টচক্র কাজ করেছে। এ জিনিসটাকে আমাদের প্রতিহত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে, চিন্তা করতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: সংস্কারের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে কিনা?
ইফতেখারুজ্জামান: দুদককে আমলাদের হাত থেকে উদ্ধার করার বিষয়টি আছে। অবশ্যই পদ্ধতি আছে। যেমন- দুদকের নিজস্ব জনবল কিন্তু আছে। এই জনবলের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হওয়ার মতো যথেষ্ট যোগ্যতা অর্জন করেছে। অথচ আমার জানামতে, মহাপরিচালক পর্যায়ে এখন মাত্র দুজন আছেন দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তা। সেটাতো হওয়ার কথা নয়। তাদেরও পরিকল্পনা করতে হবে। তাছাড়া আমলাতন্ত্র থেকে যেটা আমি মনে করি, সচিব পদে আমলাতন্ত্র থেকে আসতে হয়। অসুবিধা নাই। কিন্তু সেই সচিব কাকে আনা হবে, সেটা দুদক নির্ধারণ করবে। সেটা আমলাতন্ত্র নির্ধারণ করবে না। আমলাতন্ত্রের পক্ষ থেকে হয়তো একটা তালিকা আসতে পারে যে, এরা সম্ভাব্য, প্রেষণে যাওয়ার উপযুক্ত।
আমলাতন্ত্র থেকে অনেকে দুদকে আসতে চায় এ কারণে যে, নিজের বিরুদ্ধেও হয়তো কোনও অভিযোগ আছে। এসেই প্রথম যে কাজটা করে, সেই ফাইলটা ক্লোজ করা। সেখানে আবার কমিশনও সহায়তা করে। এমন একটা কথা প্রচলিত আছে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাত দেওয়া যাবে না। হাত দিলে সেই হাত পুড়ে যাবে।
আপনি যখন নিয়োগ দিচ্ছেন, তখন সেই ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে দেখছেন যে, সে আপনার অনুগত কিনা। আপনার দলীয় ভাবধারায় প্রভাবিত কিনা। আপনি যদি দেখতেন এ লোকের পেশাগত উৎকর্ষতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা, দুদকের কমিশনার হওয়ার মতো উপযুক্ত— তার ওপর যে ম্যান্ডেটটা হবে, সেটা পালন করার মতো তার ট্র্যাক রেকর্ড আছে।
তবে আমি কখনই বিশ্বাস করি না যে, আমলাতন্ত্রের যারা আছেন, তারা সবাই ঢালাওভাবে দুর্নীতিবাজ। সবাই ঢালাওভাবে দলীয় প্রভাবে প্রভাবিত। এটা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এ সুযোগটাকে নষ্ট করা হয়েছে।
দুদকের যে মূল আইনটি এবং বিধিমালা, সেগুলোকে বিভিন্নভাবে সংকুচিত করা বা পরিবর্তনের মাধ্যমে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। সেগুলোতে আমাদের হাত দিতে হবে জোরালোভাবে। সেখানে আরও বেশি যুগোপযোগী করা, প্রেক্ষিত, নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে আইনকে ঢেলে সাজানো। পাশাপাশি আরও কিছু আইন আছে— যেটা সরাসরি দুদকের আইন না, কিন্তু দুদকের কাজের ওপর প্রভাব ফেলেছে। দুদকের যে সিডিউল আছে, সেই সিডিউলের মাত্র দু-তিনটা আইটেম ছাড়া, সবই দুদকের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে মানিলন্ডারিং অন্যতম। আমাদের সবার প্রত্যাশা হচ্ছে, দুদক মানিলন্ডারিং নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করবে। যারা অর্থপাচার করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এই কাজটা দুদকের হাত থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টগুলো দুদকের হাতে রয়েছে। অর্থপাচারের সহায়ক হিসেবে কাজ করা দুদকের এখতিয়ারে নেই। অথচ আমরা অযাচিতভাবেই দুদকের সমালোচনা করছি এ বিষয়ে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, প্রতিবছর কালো টাকা বৈধ করার জন্য যে কর আইনটা করা হয়, সেটার মাধ্যমে যেটা করা হয়, দুদকের যে এখতিয়ার আছে, যে অসামঞ্জস্য সম্পদ নিয়ে বিচার নিশ্চিত করা— সেই এখতিয়ারটাও দুদক থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। বিগত ২২ বছর যাবত সেটা হচ্ছে। এই জিনিসগুলো দেখতে হবে। সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টের মধ্যে কিছু ধারা আছে, যার মাধ্যমে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এ বিষয়গুলো সম্পূরক আইন হিসেবে যুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে আমাদেরকে।
বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি যারা ক্ষমতার কাছাকাছি, সেটা রাজনৈতিকভাবে হোক আর আমলাতান্ত্রিকভাবেই হোক, ব্যবসায়িক শক্তি, অর্থাৎ অর্থনৈতিক ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করেই হোক। এখন তো ব্যবসা, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্র একাকার হয়ে গেছে। এ প্রেক্ষিতে ক্ষমতার মূল স্তম্ভ হচ্ছে, ব্যবসা, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্র। এই ক্ষমতার মাধ্যমে যারা অপব্যবহার করেন তারা উচ্চ পর্যায়ের। তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে দেশে-বিদেশে অর্থপাচারের যে বিষয়টি, সেখানে আমরা যেহেতু আগেই বললাম যে, দুদকের ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে। এর বাইরেও যতটুকু এখতিয়ার আছে, সেটা কিন্তু দুদক পালন করতে গেলে, তার সঙ্গে সম্পূরক কিছু প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। যেমন- আমাদের বিএফআইইউ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আছে। যাদের হাতে অর্পিত ক্ষমতা আছে। এসব প্রতিষ্ঠান এবং দুদক সমন্বিতভাবে কাজ করে অর্থপাচার প্রতিরোধ করার কথা। সে কাজটি কিন্তু বাস্তবে হয়নি। তার কারণ হচ্ছে— তাদেরও অদক্ষতা, দলীয় রাজনীতির প্রভাবিত একটি অবস্থান, পেশাগত দেওলিয়াপনা। তারা নিজের ভূমিকাটা যেমন পালন করতে পারেনি, একইভাবে সমন্বিতভাবেও পারেনি। এক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে বলে কোনও দৃষ্টান্ত নাই। কাজেই এ জায়গাটিতে ব্যাপক আলোচিত ও ব্যাপক উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে অর্থপাচার। বাংলাদেশে যেভাবে অর্থপাচার হচ্ছে, এখন পৃথিবীর শীর্ষ পাচারকারী দেশ আমরা হয়ে গেছি। এখানেই আমাদের কী ধরনের সংস্কার করা দরকার, সেটা ভাবতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: কমিশনের কাজে জনগণের অংশগ্রহণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে কীভাবে?
ইফতেখারুজ্জামান: আমরা যে কাজটা করবো, আমার ধারণা— আমাদের কমিশনে যারা থাকবেন, তারা একমত হবেন যে, আমরা একটা প্রক্রিয়া করবো। যার মাধ্যমে অন্য অংশীজন যারা আছেন, তাদের অভিমত নেবো। যেমন, ছাত্র-জনতার মধ্যে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে। তাদের এখনকার ভাবনা বা নতুন বাংলাদেশ নিয়ে তাদের কী ধারণা। আমরা জানি যে, দুর্নীতিটা তাদের বড় একটা বিষয় ছিল। সেক্ষেত্রে তাদের ভাবনা চিন্তা কী, সেগুলো বোঝার জন্য তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবো। একইসঙ্গে গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা বলেছে। যতটুকু পালন করার কথা ততটুকু তারা করতে পারেনি। কাজ করতে গিয়ে বিশেষ করে দুদক বিট যারা করেন, তাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাদের সঙ্গেও আমার ওতপ্রোত সম্পর্ক। যারা দুর্নীতি বিষয়ক প্রতিবেদন করেন। পেশাগতভাবে আমরা একই পথের পথিক। কাজেই তাদেরও পরামর্শ আমরা নেবো। অন্যান্য অংশীদার যেমন- বিশেষজ্ঞ যারা আছেন, এ ক্ষেত্রে স্পেশালাইজড, কিন্তু কিছু মানুষ তো আছেন যারা, এগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন, লেখালেখি করেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আমরা চেষ্টা করবো আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাগুলোকে বিবেচনায় নেওয়ার জন্য। যতটুকু সম্ভব নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই করবো। এসবের ওপর ভিত্তি করে আমরা একটা গুচ্ছ পরামর্শ সরকারকে বিবেচনা করার জন্য দেবো।
শেষ কথা হচ্ছে, যে পরামর্শই দেই না কেনও, তার ওপর ভিত্তি করে একটা আদর্শ দুর্নীতি দমন কমিশনও চাই আমরা। তাতেও কিন্তু এই দুর্নীতি দমন কমিশন সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারবে না। যে পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন ও আমলাতান্ত্রিক অঙ্গনের নিজস্ব পরিমণ্ডলের সংস্কার না হয়। কারণ আমাদের আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক অঙ্গনে যারা ক্ষমতাবান আছেন, তারা যদি মনে করেন যে, ক্ষমতাটা হচ্ছে অন্তরঙ্গভাবে নিজের সম্পদ বিকাশের জন্য। এ সংস্কৃতিটা কিন্তু একেবারে তার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেছে। এ থেকে উত্তরণ করার জন্য আমাদের ছাত্র-জনতার যে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন, তার মূল চেতনা এবং তার শিক্ষাগুলো গ্রহণ করার মাধ্যমে যদি পরিবর্তনটা আনা সম্ভব হয়, তাহলেই দুদকের কার্যকারিতা আমরা নিশ্চিত করতে পারবো। কাজেই আমি মনে করি যে, আমাদের দুদক সংস্কার কমিশনের যে দায়িত্ব বা ম্যন্ডেট, তার থেকে রাজনীতিক বিশেষ করে আমলাতান্ত্রিক সংস্কারের যে অপরিহার্যতা, তা থেকে বিচ্ছিন্ন করার কোনও সুযোগ নেই। এটার সঙ্গে সম্পূরক হতে হবে। সেটাকেও আমি ভাবছি অত্যন্ত জোরালোভাবে ভাবা দরকার।
বাংলা ট্রিবিউন: মানসিক দৃষ্টিভঙ্গী না পাল্টালে এ সংস্কার কতটুকু কার্যকর হবে?
ইফতেখারুজ্জামান: অবশ্যই মানসিক সংস্কারটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটা মানুষেরই দরকার দুর্নীতি প্রতিরোধে আমরা যে উপাদানগুলো চাই— রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে, যারা দুর্নীতি করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে হবে। আইন ও নীতিমালা লাগবে। সাধারণ মানুষকেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। আমরা সামাজিক আন্দোলন যেটা করছি সারা দেশে, তরুণরা আমাদের সঙ্গে কাজ করছে স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে। সম্পূর্ণ দল নিরপেক্ষ দুর্নীতিমুক্ত বিভিন্ন পেশাজীবীরা আছেন।
সাধারণ মানুষকে তো দুর্নীতির কারণে একদিক থেকে যেমন- জিম্মি দশা, অপরদিকে তারা কিন্তু সোচ্চার হওয়ার জন্য উদগ্রী্ব। ইতোমধ্যে তারা সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চায়। করছেও অনেকে। বাস্তবে এটার কোনও সুফল আমরা পাই না। বাংলাদেশে শুধুমাত্র কর্তৃত্ববাদী সরকারের গত ১৫ বছরের দুর্নীতির ব্যাপকতা বহুগুণ বেড়েছে, এটাতে তো সন্দেহ নাই। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে কর্তৃত্ববাদের উপাদানগুলো।
তাছাড়া, দুর্নীতিতো মনোপলি শুধুমাত্র এই সরকারের ছিল না। দুর্নীতি এবং এ ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার কিন্তু আমাদের দেশে ধারাবাহিকভাবে সব সরকারই করেছে। একটা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, ক্ষমতায় থাকলে এটা আমার সময়। আমার সময় আমি করবো। ক্ষমতার বাইরে ছিলাম আমি করতে পারি নাই। যে কারণে এখন আমরা যেটা দেখছি— ৫ আগস্ট রাত থেকেই কিন্তু দখলবাজি, দলবাজি, চাঁদাবাজি সব শুরু হয়ে গেছে। এমনকি আমলাতন্ত্রও দখলবাজি হয়েছে। যেটা বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত। এ সংস্কৃতি থেকে যদি উত্তরণ না করা যায়, এটার উপায়টা কী। এটার কোনও ম্যাজিক বুলেট নাই, যে চট করে হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু তো চিন্তাভাবনা থাকতে হবে।
এমন না যে, দুর্নীতি দমন কমিশন এই সংস্কার কমিশনের এজেন্ডাটাকে সর্বব্যাপী করে ফেলা সম্ভব বা উচিত। কিন্তু আমাদের এগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: এখন তো কিছু কাজ হচ্ছে।
ইফতেখারুজ্জামান: ৫ আগস্টের পর দুদক যে দৃষ্টান্তটা দেখাচ্ছে, সেটা কিন্তু তারা নিজেরাই প্রমাণ দিচ্ছে। যারা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। আর যখন ক্ষমতার বাইরে থাকেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে লম্পঝম্প করা যায়। এখন যে উচ্চ পর্যায়ের দু’তিনশ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তারা অনুসন্ধান শুরু করেছে, সেটা মোস্ট ওয়েলকাম। এটাই করা উচিত দুদকের। কিন্তু এতদিন করেননি কেন? তাদের হাতে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল, অভিযোগ ছিল, আমাদের গবেষণাপ্রসূত যাদেরকে এখন অনুসন্ধান ও তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে তাদের সম্পর্কে, আমরা অন্য কিছু বাদ দিলাম, নির্বাচনের আগে আমরা হাজার হাজারগুণ সম্পদ বিকাশের যে চিত্র তুলে ধরেছিলাম, সেই তথ্যগুলো কিন্তু তাদের কাছে ছিল, কিন্তু কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখন করছেন কেন? এটা সফল হবে, এটা আমরা আশা করবো। কিন্তু কতটুকু সফল হবে সেটা দেখার বিষয়। অপরদিক থেকে আবার যেটা বলেছেন, তাদেরই শুরু করা অনেক মামলা, অনুসন্ধান, তদন্ত— যারা বিরোধী দলে ছিলেন অর্থাৎ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো ছিল সেগুলো রাতারাতি কিন্তু খারিজ করা হয়েছে, বা হচ্ছে বা মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আদালত থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
যদি হয়রানিমূলক হয় সেটা ভালো কথা। তাদের রাইটস আছে করতেই পারে। কিন্তু এতদিন যে দুদক নিজেকে ব্যবহার করতে দিয়েছে তাদের হয়রানির জন্য, রাজনৈতিক বিবেচনায়, সেটাতো দুদকে হওয়ার কথা ছিল না। এখন চাইলে যারা হয়রানির শিকার হয়েছেন, তারা দুদকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে পারেন। দুদক যে নিজেদের কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দিয়েছে, সেটার প্রমাণও কিন্তু দুদক নিজেই দিলো।