বাংলা ট্রিবিউনকে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

১৫ বছরে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অধিকারের পক্ষে জোরালো ছিল না

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এই কাজগুলোর মধ্যেই তিনি আছেন গত কয়েক দশক ধরে। এতদিন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী হিসেবে পরিবেশ-প্রতিবেশের অধিকার নিয়ে কাজ করে এসেছেন। রিজওয়ানা প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ গোল্ডম্যান পরিবেশ পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১২ সালে তিনি ফিলিপাইনভিত্তিক র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান। এই মুহূর্তে সরকারের কাছে পরিবেশ ও পানিসম্পদ বিষয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিতে করণীয় ও বাস্তবতা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।

বাংলা ট্রিবিউন: সম্প্রতি আপনি ঘোষণা করেছেন যে, ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে পলিথিন নিষিদ্ধ হবে। পলিথিন আমাদের এখানে যেভাবে জেঁকে বসেছে— লালবাগের যে পলিথিন কারখানা, সেই উৎসটা বন্ধ করার কোনও উদ্যোগ নেবেন কিনা?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্রথম কথা হচ্ছে, এখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা যে পর্যায়ে রয়েছে, তাতে এই ধরনের অভিযানের জন্য আমি হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করবো। যখন ২০০৪-২০০৬ সালে দেশে পলিথিন ব্যাগ উঠে গিয়েছিল, ওইটা বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে হয়েছিল। সে সময়ের মন্ত্রী যিনি ছিলেন, তিনি প্রত্যেক বাজারে বাজারে গিয়ে পলিথিন তুলে নিয়ে আসতেন। উৎপাদনের জায়গায় অনেকবারই হাত দেওয়া হয়েছে, তেমন ফল পাওয়া যায়নি। সেটার অনেক কারণ থাকতে পারে, অসচ্ছতা থাকতে পারে, দুর্নীতি থাকতে পারে। একটা কথাতো ঠিক— পলিথিন ব্যাগ নিয়ে মানুষেরওতো অভ্যাস হয়ে গেছে। মানুষ ভেবে নেয়, পলি ছাড়া বাজার থেকে মাছটা, মুরগিটা বাসায় আনা যাবে না। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন প্রত্যেক শুক্রবার বাবাকে বলতে শুনতাম, ‘বাজারের ব্যাগটা দাওতো’। আবার বাজার করে এসে বলতেন, ‘ব্যাগটা ধুয়ে দাও’। ব্যাগটা ছিড়ে গেলে সেটা সেলাই করা হতো। মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন আনার জন্য সুপারশপ দিয়ে ঢাকায় এই উদ্যোগ শুরু করলাম। সুপারশপের যারা ক্রেতা তাদের বাড়তি ২০-৩০ টাকা দিয়ে বিকল্প ব্যাগ কিনতে খুব একটা কষ্ট হবে না। এটা সমাজে শক্তিশালী বার্তা দেবে। আমরা একইসঙ্গে বলেছি, অক্টোবরের ১ তারিখ থেকে অভিযান শুরু করবো। অভিযান কোনও দোকানে হবে না। উৎপাদনের কেন্দ্রে গিয়ে এই অভিযান করা হবে। অক্টেবরের ১ তারিখ থেকে আমরা কোনও না কোনও জায়গায় যাবো। ব্যবহার, বিক্রয় ও উৎপাদন নিয়ে কথা বলবো। প্রকারান্তরে তিনটাই বন্ধ করা হবে। হঠাৎ করেই বড় পরিসরে অভিযানের জন্য যে পরিমাণ জনবল লাগে, এ মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনে সেটা নেই। ফলে এভাবে শুরু করি, একটা বার্তা যাক। স্কুলে স্কুলে বলা হবে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি অফিস, হোটেল, রেস্টুরেন্টে ক্যাম্পেইন হবে। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটায় সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন হবে।

বাংলা ট্রিবিউন: আরেকটু স্পষ্ট হয়ে নেই। সুপারশপ থেকে পলিথিন সরানোর উপায় কী? কেননা, আমরা দেখি— প্রাণ, স্কয়ার, এসিআই, ফ্রেস থেকে শুরু করে বড় বড় কোম্পানির প্রায় সব পণ্যের প্যাকেজিং তো পলিথিনেই করে। সেক্ষেত্রে সুপারশপ কী করবে?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমাদের প্রথম টার্গেট পলিথিন শপিং ব্যাগ। সেটা দিয়েই শুরু করি। আর যেগুলো মাল্টিলেয়ার প্যাকেজিং করে, সেটা রিসাইক্লিং হয় না। কতগুলো জায়গাতে যদিও এটা আইনত অনুমোদিত। যেমন- চানাচুর, চিপসের প্যাকেট। লিগ্যালি পারমিটেড করা হয়েছিল, বিকল্প না আসা পর্যন্ত। এখন এই মাল্টিলেয়ার প্যাকেজিং বিদেশে অনেক বদলে গেছে। সেখানে এই প্যাকেটগুলো সংগ্রহ করা হয়, যেটাকে এক্সটেনডেড প্রডিউসার রেসপনসিবিলিটি (ইপিআর) বলে। সংগ্রহ করে নিয়ে রিসাইকেল করে। সেগুলো আমাদের পরের ধাপ। আমরা ইপিআর নির্দেশিকা চূড়ান্ত করবো।

বাংলা ট্রিবিউন: সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও কুয়াকাটা পলিথিন-মুক্ত করতে পরিকল্পনাটা কী?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় যাবে, চিপসতো খাবেই শিশুরা। ললি খাবেই। এগুলো নিয়ে এক্সপোর্টারদের (যেসব ব্যবসায়ী সেখানে পাঠায়) সঙ্গে একটা চুক্তিতে আসার চেষ্টা করবো। কারণ তাদের কাছে পরিমাণের বিষয়ে তথ্য থাকে। ওসব জায়গায় কতগুলো বোতল যাচ্ছে, প্যাকেট ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলো তারা সংগ্রহ করবেন। আমরাই পৃথক বক্স রাখবো। পরীক্ষামূলক চালু করে দেখবো। ইপিআর এখনই না।

বাংলা ট্রিবিউন: এটা গেলো পলিথিনের বিষয়। এই মুহূর্তে পরিবেশের আর কোন বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসেবে মাথায় থাকছে।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: সবই মাথায় রাখছি। সারাজীবন এই নিয়েই কাজ করলাম। আমি বায়ুদূষণও মাথায় রাখছি। মুশকিল হলো, বায়ুদূষণে ৫-৭ বছরের আগে দৃশ্যমান কিছু পাওয়া সম্ভব নয়।

তবে বায়ুদূষণ ঠেকাতে নতুন কোনও ইটভাটার অনুমোদন দেওয়া হবে না। ঢাকার আশেপাশের যেসব অবৈধ ইটভাটা আছে, সেগুলো অক্টোবর থেকেই ভাঙা শুরু করবো। নির্মাণ কাজ পরিচালনা করতে হবে সম্পূর্ণ আচ্ছাদিত করে। পানি ছিটানোর কাজও অক্টোবর থেকেই শুরু হবে। এটা সিটি করপোরেশন করবে।

আজকে (১১ সেপ্টেম্বর) চায়নিজ রাষ্ট্রদূত বললেন, টেমস নদীর দূষণ ঠেকাতে ১০ বছর লেগেছে। আর আমাদের কাছে নদীদূষণ রোধের কোনও পরিকল্পনাই নাই। কোনও ম্যাপিং নাই যে, কোথায় কোথায় দূষণ হচ্ছে। প্রাথমিক পরিকল্পনা হলো— ৬৪ জেলার অন্তত একটি করে ৬৪টি নদীর দখল ও দূষণমুক্ত করার কর্মপরিকল্পনা করা। সেটা নিয়ে কাজ শুরু করবো। আমরা যতদূর পারি করবো, তারপরে যারা আসবেন, তারা সেটা চালিয়ে নেবেন। কিন্তু আমরা অন্তত একটা নদী দূষণমুক্ত করতে চাই। বুড়িগঙ্গা হলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা হবে না এখনই। সেক্ষেত্রে বালু ভাববো না শীতলক্ষ্যা, সেটা নিয়ে আলাপ চলছে। দেখি, জেলা থেকে প্রশাসন কী পাঠায়, নদী অধিকারকর্মীরা কী বলেন, সেটা দেখি। একটা নদীও যদি দূষণমুক্ত করতে পারি।

বাংলা ট্রিবিউন: আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে একজনের শুরু করে দেওয়া কাজ পরে যিনি আসেন, তিনি চালিয়ে নেন না। যা পরিবর্তন করবেন, শুরু করবেন, সেটা চলবে? এটা নিশ্চিত করার কোনও পদ্ধতি আছে কি?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: না, এটা নিশ্চিত করার কোনও পদ্ধতি নাই। একটাই উপায়— গণমাধ্যমকে সজাগ থাকতে হবে। তারা যেনো কোনও গোষ্ঠীর ভেতরে ঢুকে না যায়, নিরপেক্ষভাবে আমরা যেনো আমাদের স্বার্থ দেখতে পারি। যেখানে সেটা বিঘ্নিত হবে বলে মনে হবে, সেখানেই যেনো কথা বলতে পারি। আমরা যে আমাদের সংস্কারের কথা বলছি— সেটার একটা উদ্দেশ্য গণতন্ত্র ও উদারতাটাকে আনা। এটা সহজ না। এখানে রাজনৈতিক মতৈক্যের ব্যাপার আছে। এর আগে তিন দল রূপরেখা দিয়েছিল, মনে আছে নিশ্চয়। কিছু হয়েছিল কি। কিছু হেলো না, কোনও দল করেনি।

এবার দলগুলোর বুঝা উচিত— তারা যে রাজনীতি করেছে, জনগণের কাছে সেটার জনপ্রিয়তা নেই। দুই রাজনৈতিক দলেরই অভিজ্ঞতা হওয়া উচিত। বিএনপিকে এর আগে দুই আমলেই অসম্মান নিয়ে সরে যেতে হয়েছে। আওয়ামী লীগও দেখলো, তাদের দোসররাও দেখছে। নতুন একটা জেনারেশনের চাহিদা অনুযায়ী, তাদের চলতে হবে। তা না হলে, এই পরিণতিই হবে। সংস্কার যদি সত্যিকার অর্থে হয় এবং সেখানে মতৈক্য থাকে, তাহলে হয়তো কাজগুলো হবে। আমি এসে সাবের ভাইয়ের (সাবের হোসেন চৌধুরী) কোনও কাজ বাতিল করিনি। আমি সেটুকুই রিভাইজ করছি, যেটুকু রিভাইজ করলে, আমি তাড়াতাড়ি কিছু কাজ দেখাতে পারবো। জনগণের মধ্যে একটা আশা জাগাতে পারবো। ওরা হয়তো ৫ বছর সময় আছে ভেবেছিল, কিন্তু আমারতো সেটা ভাবার কোনও অবকাশ নেই।

বাংলা ট্রিবিউন: সংস্কারের কথা যখন বললেন, ১১ সেপ্টেম্বর সংস্কারের জন্য ৬টি কমিশনের কথা বলা হলো— এরমধ্যে শিক্ষা সংস্কার কমিশন পেলাম না।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: হবে হবে হবে। যেগুলো খালি নির্বাচন সংক্রান্ত, সেগুলোতে প্রথমে হাত দেওয়া হয়েছে। সবার কাছ থেকেই সংস্কার প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। কেউতো দিচ্ছে না প্রস্তাব। এখনও রাজনৈতিক দলগুলো লিখিতভাবে দিচ্ছে না। কাজেই অন্যগুলোও হবে। বিদ্যুৎ কমিশনও নেই কেন, সে প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন করতে হবে— টাকাগুলো কোথায় গেলো। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। রাজনৈতিক মতৈক্য করাটাই হবে আমাদের কাজের বড় জায়গা।

বাংলা ট্রিবিউন: এবারে একটু পানিসম্পদের দিকে যেতে চাই। দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রথম ধাক্কা হয়ে এলো বন্যা। সেটার বড় কারণ ছিল অভিন্ন নদী। অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা নিয়ে আলাপ না তুলতে পারার কারণ কী?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমরা আলাপ তুলেছি, তুলিনি তা না। মনে রাখতে হবে, আমরা উজানের অংশ না। প্রাকৃতিকভাবেই আমরা নিচে অবস্থান করছি। ওপরের ওরা সবসময় সুবিধা পাবে, স্বাভাবিক। আমরা দাবি তুলিনি সেটা ঠিক না। আমার কাছে মনে হয়, গত ১৫ বছরে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিটা খুব বেশি অধিকারের পক্ষে অ্যাগ্রেসিভ ছিল না। আমি বলছি না কোনও রাষ্ট্রের বিপরীতে অ্যাগ্রেসিভ হওয়ার কথা। বলছি, আমাদের অধিকারের পক্ষে জোরালো ছিল না। যেটুকু দেবে সেটুকু নেবো। ফেনীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে কিন্তু চুক্তি হয়ে গেছে।

এখন আমরা জোরালোভাবে অধিকারের কথা বলবো। জোরালোভাবে বললেই যে পাবো, তা নয়। কিন্তু পাবো না বলে কি বলবোও না? বলতে হবে। এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানাতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানেই ইউরোপ- আমেরিকা তা নয়। আমার চীনকেও জানাতে হবে, সেও আমার উজানের দেশ। নেপালকে জানাতে হবে, সেও আমার উজানের দেশ। আমাদের দাবির সপক্ষে জনমত তৈরি করতে পারি।