আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস

শুধু রোপণই নয়, গাছকাটা বন্ধের এখনই সময়

চলতি বছরের এপ্রিলে প্রায় প্রতিদিনই হিট স্ট্রোকের খবর এসেছে। তীব্র তাপপ্রবাহে এবার দেশের বেশিরভাগ এলাকা নাকাল ছিল। সারা বিশ্বে যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় এরমধ্যে ১৫ ভাগই খরা সম্পর্কিত। আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘করবো ভূমি পূনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা/ অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’। প্রতিপাদ্যে ভূমি পূনরুদ্ধার, মরুময়তা রোখা এবং খরা সহনশীল হওয়ার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাপী খরার কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে বলেই তাপপ্রবাহের শিকার হচ্ছে সবাই।

‘জাতীয় খরা সম্মেলন ২০২৩’ এর বিষয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী তারা জানায়, ১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এককভাবে খরার কারণে সারা পৃথিবীতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ। এই সময়কালে আবহাওয়া, জলবায়ু এবং পানির কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়ের অর্ধেকই খরার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এসব দুর্যোগে নিহতদের মধ্যে ৪০ শতাংশই খরার কারণে মারা যান। এই ধরনের ১০টি মৃত্যুর মধ্যে ৯টিই হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।

২০০০ সাল থেকে শুরু করে খরার পৌনঃপুনিকতা এবং মেয়াদকাল তার আগের দুই দশকের তুলনায় ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আজকের দিনে সারা পৃথিবীর ২৩০ কোটিরও বেশি মানুষ খরায় আক্রান্ত। প্রতিবছর খরার কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আনুমানিক ৫০ মিলিয়ন মানুষ। খরার কারণে ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রায় ১২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। কেবলমাত্র মানুষই নয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই খরা ফসল এবং পশুসম্পদের গুরুতর ক্ষতি করে আসছে।

১৯৯৭ সালেও খরার কারণে ১০ লাখ টন ধানের ক্ষতি হয়, যা বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বড় প্রভাব ফেলে। সব মিলিয়ে কৃষিতে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ কোটি ডলার। ১৯৭২, ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৮২ বছরগুলোতে উত্তরাঞ্চলে খরার ব্যাপক প্রভাব পড়লেও খরা মোকাবিলায় যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এই বছরগুলোতে উত্তরের জেলারগুলোর প্রায় ৪৭ শতাংশ জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৯০ এর দশকে খরার প্রভাবে ৩.৫ মিলিয়ন টন চাল কম উৎপাদন হয়।

কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা

কীভাবে ক্ষরার ক্ষতি রুখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করা যায় এ সস্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা) ড. মো. সোহরাব আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মরুময়তা এবং ভূমির অবক্ষয় সারা বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশ এই বাইরে না। এটি দুইভাবে মোকাবিলা করা হয়- এক স্থানীয়ভাবে এবং দুই আন্তর্জাতিকভাবে। এটি একার পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব না। সবাই মিলেই কাজটি করতে হবে।

তিনি জানান, এই ভূমির অবক্ষয় রোধ করার মধ্য দিয়ে মরুময়তা মোকাবিলার জন্য ইউনাইটেড ন্যাশনস কনভেনশন টু কমবেট ডেজার্টিফিকেশন (ইউএনসিসিডি) গঠন করা হয়। এতে বাংলাদেশও সদস্য। ১৯৯৬ সালে কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। সে অনুযায়ী কনভেশনে যা যা সিদ্ধান্ত হবে তার সবই বাংলাদেশসহ সব সদস্য দেশ বাস্তবায়ন করবে। তারই অংশ হিসেবে জলবায়ু সম্মেলন কপ ২০১৩’তে সিদ্ধান্ত হয়, প্রত্যেক দেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে ভূমি অবক্ষয় নিরপেক্ষতা অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশও সেই লক্ষে কাজ শুরু করেছে। এতো গেলো আন্তর্জাতিক পর্যায়। এদিকে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাকশন প্রোগ্রাম ফর কমবেটিং ডেজার্টিফিকে্শন, ল্যান্ড ডিগ্রেশন অ্যান্ড ড্রট ২০১৫-২০২৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি একটা রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা (এসএলএম) শনাক্ত করা হয়েছে। কিছু এসএলএম আমরা প্রদর্শনী করেছি। এছাড়া বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ইকোসিস্টেম বেসড অ্যাপ্রোচেস টু অ্যাডাপটেশন (ইবিএ) প্রকল্প এখন চলমান আছে। এই প্রকল্পের অধীনে মরুময়তা রুখতে মজা পুকুর পুনখনন, পানি সংরক্ষণ, বৃষ্টির পানি ধরে রাখাসহ নানা কাজ করা হচ্ছে।

এদিকে মঙ্গলবার (৪ জুন) পরিবেশ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, সরকার বনায়ন ও বন সংরক্ষণ, অবক্ষয়িত বন পুনরুদ্ধার এবং টেকসই বন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ২০০৯-২০১০ হতে ২০২২-২৩ আর্থিক সাল পর্যন্ত মোট ২ লাখ ১৭ হাজার ৪০২ হেক্টর ব্লক এবং ৩০ হাজার ২৫২ সিডলিং কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান সৃজন এবং ১১ কোটি ২১ লাখ চারা বিতরণ ও রোপণ করা হয়েছে।

পরিবেশ সংরক্ষণ ও ভূমির অবক্ষয় রোধে সরকারের বিভিন্ন  উদ্যোগের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভূমি অবক্ষয় কমিয়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প যেমন টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করছে। ইটভাটায় টপ সয়েলের ব্যবহার কমাতে সরকারি নির্মাণ কাজে ইটের পরিবর্তে ব্লক ব্যবহারের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। জবরদখলকৃত বনভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে অক্টোবর ২০২০ হতে এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৩০ হাজার একর বনভূমি জবরদখলমুক্ত এবং বনায়ন সম্পন্ন হয়েছে।

অন্যদিকে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও ওয়াটার কিপারস বাংলাদেশের সমন্বয়কারী শরীফ জামিল বলেন, সরকার মরুময়তা বা খরা রোধে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিচ্ছে, সেটা ভালো কথা। কিন্তু এই মরুময়তার জন্য দায়ী যেসব বিষয় সেগুলো আগে ঠিক করা দরকার বলে আমি মনে করি।

তিনি বলেন, খরা থেকে রক্ষা পেতে হলে সবার আগে গাছকাটা বন্ধ করতে হবে। খালবিল ভরাট বন্ধ করতে হবে, উজানে পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এসব আগে না করে শুধু বৃক্ষরোপণ দিয়ে মরুময়তা রোধ করা সম্ভব না।

ইতিহাস

১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে প্রতিবছর ৫ জুন সারা বিশ্বে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে।

কর্মসূচি

দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ বুধবার (৫ জুন) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে পরিবেশ মেলা ও বৃক্ষমেলার উদ্বোধন করবেন। প্রধানমন্ত্রী এদিন পলাশ ও বেল গাছের দুটি চারা রোপণের মাধ্যমে জাতীয় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিরও শুভ উদ্বোধন করবেন।

শেরেবাংলা নগরে অনুষ্ঠিতব্য পরিবেশ মেলা চলবে ৫ থেকে ১১ জুন এবং বৃক্ষমেলা চলবে ৫ থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন মেলা চলবে সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন ২০২৩ ও ২০২৪, জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৩, বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার ২০২২ ও ২০২৩ এবং সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের মাঝে লভ্যাংশের চেক বিতরণ করা হবে।

৮ কোটি বৃক্ষরোপনের লক্ষ্য নির্ধারণ

এ বছর বর্ষা মৌসুমে সারা দেশে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ২৭ হাজার চারা রোপণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।