জুলাই আন্দোলনে একজনকে হত্যার ঘটনার আট মাস পর এশিয়াটিক ৩৬০–এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অভিনেতা ইরেশ জাকেরসহ ৪০৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
চাঞ্চল্যকর তথ্য আলোচিত এই মামলার সাক্ষীদের অনেকে মামলার কার্যক্রম বা অভিযুক্তদের পরিচয় সম্পর্কে অবগত নন বলে জানা গেছে।
মাহফুজ আলম শ্রাবণ নামে বিএনপির এক কর্মীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মাহফুজের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পি চলতি মাসের শুরুতে মামলাটি করেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট মিরপুরে ছাত্র আন্দোলনের সময় শ্রাবণ পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাপ্পি ২০ এপ্রিল মামলা আবেদন করেন। আদালত সেদিন তার জবানবন্দি রেকর্ড করে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নিয়মিত মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করতে নির্দেশ দেন।
মামলার অভিযোগপত্রে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতার নামও রয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল আলম, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তাফা কামাল, ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর আলী, ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের মালিক দিলীপ কুমার আগরওয়াল, বিশ্বাস বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দুলাল বিশ্বাস, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরামউদ্দিন আহমেদ, এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং সিকদার গ্রুপের দুই পরিচালক রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার।
মামলার বিস্তারিত কিছুই জানেন না সাক্ষীরা
মোট আটজনকে মামলার সাক্ষী করা হয়েছে। এদের মধ্যে চারজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগই মামলার বিষয়ে কিছু জানেন না। মামলায় কাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তাও জানেন না তারা।
মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কিছুই জানি না। কিসের মামলা, তা–ও জানি না।‘
মামলাটি সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য দেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘আমার কাছ থেকে একজন নাম নিয়েছিলেন। আন্দোলনে আমাদের মিরপুরে একটি ছেলে মারা গেছে। সে জীবিকার জন্য চাকরি করতো।’
মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলাম। এখন ভাড়ায় গাড়ি চালাই। আমাকে একজন নাম দিতে বলেছিল তাই নাম দিয়েছিলাম।‘
মামলার কপি অনুযায়ী, অভিযোগকারী দাবি করেছেন, প্রথম অভিযুক্ত শেখ হাসিনাসহ সবাই রাষ্ট্রক্ষমতা অবৈধভাবে ধরে রাখার জন্য গণহত্যা, সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত।
মামলায় পেশাভিত্তিক অভিযুক্তদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যেমন— ২ নম্বর থেকে ১০৫ নম্বর পর্যন্ত অভিযুক্তরা আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী, এমপি এবং কেন্দ্রীয় ও মহানগর পর্যায়ের নেতা। ১০৬ থেকে ১১১ এবং ২৪০ নম্বর পর্যন্ত অভিযুক্তরা সাবেক নির্বাচন কমিশনার। এদেরেকে প্রহসনমূলক নির্বাচনের ‘কারিগর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মামলার কপিতে।
১৫০ থেকে ২১১ নম্বর পর্যন্ত অভিযুক্তরা বিভিন্ন ব্যবসায়ী, যাদের বিরুদ্ধে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি, অবৈধ দখল ও ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
২১২ থেকে ২৩৬ নম্বর পর্যন্ত অভিযুক্তরা সাংবাদিক, যাদের বিরুদ্ধে অনৈতিক সাংবাদিকতা ও সরকারপন্থি প্রচারণার অভিযোগ করা হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় হতাহতের ঘটনায় এর আগে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক ব্যক্তির নামে একাধিক মামলা দায়ের করা হলেও এই মামলার বাদী ক্যাটাগরিক্যালি আসামিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উল্লেখ করে মামলা করেছেন। বাদী দাবি করেছেন— এই ৪০৮ জনের সবাই তার ভাই বিএনপিকর্মী মাহফুজ আলম শ্রাবণসহ আন্দোলনের সব হতাহতের জন্য দায়ী।
পত্রিকা দেখে অভিযুক্তদের তালিকা তৈরি
মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে ছাত্রদের পক্ষে স্লোগান দিতেন শ্রাবণ। গত ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে মিরপুর শপিং কমপ্লেক্স ও মডেল থানার মধ্যবর্তী সড়কে ছাত্র মিছিলে যোগ দিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন তিনি। তখন অভিযুক্তদের নেতৃত্বে ৫০০–এর বেশি আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মী মিছিলে হামলা চালায়। তারা শান্তিপূর্ণ মিছিলে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট, রাইফেল, শটগান ও পিস্তল থেকে গুলি ছোড়ে, ককটেল ও হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
বাদী আরও অভিযোগ করেছেন, এলোপাতাড়ি গুলির মধ্যে একটি গুলি শ্রাবণের বাম বুকে লাগে এবং শরীরের অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি মিরপুর মডেল থানার সামনে রাস্তায় পড়ে যান। সেখান থেকে সহযোদ্ধারা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগকারী মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পি বলেন, ‘পত্র-পত্রিকায় যাদের নাম পেয়েছি তাদের উল্লেখ করে মামলা করেছি। একটু সময় লাগছে মামলা করতে। আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। আরও বিভিন্ন বিষয় ছিল।’
মামলার আসামিদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘শুধু তো রাজনীতিবিদরা নয়, আরও অনেকেই দোষী। যারা অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন, তথ্য গোপন করেছেন। অনেকেই তাদের সহযোগিতা করেছেন তাহলে তো তারাও অপরাধী। এরা কোনও না কোনোভাবে সংযুক্ত আছেন।’
মামলায় যাদের নাম দেওয়া হয়েছে তাদেরকে কীভাবে চিহ্নিত করেছেন- এমন প্রশ্নে জবাবে বাদী বলেন, ‘আমি নিজে নামগুলো ঠিক করেছি। আমার সঙ্গে বিভিন্নজন ছিল, যারা নামগুলো ঠিক করতে সহযোগিতা করেছেন। বিভিন্ন পেপার-পত্রিকা দেখে এসব নাম ঠিক করা হয়েছে। এজাহারটি সম্ভবত কোনও উকিল লিখেছেন।