আদালতঙ্গনে নারী বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি শুধু নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নয়, বরং সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচারের অভিগম্যতা নিশ্চিতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন আপিল বিভাগের নবনিযুক্ত বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
রবিবার (২০ এপ্রিল) সকালে আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবর্ধনায় তিনি এ মন্তব্য করেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব আপিল বিভাগে নিয়োগ পাওয়ায় প্রথা অনুসারে এ সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।
এদিন প্রথা অনুসারে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন দুই বিচারপতির জীবনী তুলে ধরে বক্তব্য দেন। তারপর সংবর্ধনার জবাবে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বক্তব্য রাখেন।
ফারাহ মাহবুব বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে যারা সুবিশাল মহীরুহের মতো ছায়া দিয়েছেন, আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাদের স্মরণ করতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যয়নের মাধ্যমে ১৯৮৬ সালে আইনাঙ্গনে আমার যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু আদালতের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ছোটবেলা থেকেই। আমার বাবা অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন স্বনামধন্য আইনজীবী ছিলেন। যার জন্য বাল্যকাল থেকে আইনের সঙ্গে আমার সখ্যতার সেতুবন্ধন তৈরি হয়।’
তিনি বলেন, ‘আইন পেশায় আমার প্রথম হাতেখড়ি হয় বাবার কাছে। এছাড়া, পেশাগত জীবনে আমার প্রথম সিনিয়র ছিলেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুল মালেক স্যার। আমি সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফ স্যারের সাহচর্য লাভ করি, যা আমার পেশাগত জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি। ব্যারিস্টার রফিকুল হক স্যারের কাছে বিচারক হিসেবে আমার কর্মজীবন শুরু হয় ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট, হাইকোর্ট বিভাগে নিযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে। সেসময় বিচারপতি আনোয়ারুল হক স্যারের জুনিয়র জাজ হিসেবে তার তত্ত্বাবধানে থেকে আদালত পরিচালনা, আইনের ব্যাখ্যা ও রায় লেখার কৌশল শেখার সুযোগ পাই।’
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, ‘আমাদের দেশে এক সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণা ছিল— আইন পেশা নারীদের জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে, আমাদের দেশের নারীরা সেই অচলায়তনকে অতিক্রম করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী আইনজীবী রয়েছেন, যারা আদালতে মামলা পরিচালনায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে মোট বিচারকের প্রায় ৩৫ শতাংশ নারী বিচারক। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে নারী বিচারকের সংখ্যা বর্তমানে ১০ জন। এই সংখ্যা ভবিষ্যতে বৃদ্ধি পাবে শুধু নারীর ক্ষমতায়নের জন্যই নয়, বরং সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচারের অভিগম্যতা নিশ্চিতের জন্য। এমন অনেক মামলার বিষয়বস্তু রয়েছে, যেখানে বিশেষভাবে নারীরাই ভিকটিম অথবা বিচার প্রার্থী হন। এসব ক্ষেত্রে নারী আইনজীবী বা নারী বিচারক বিচারকার্যের সঙ্গে জড়িত থাকলে বিচার-প্রার্থীর জন্য তা স্বস্তিদায়ক হয় এবং বিচারপ্রক্রিয়াকে আরও জনমুখী ও সৌহাদ্যপূর্ণ করে তোলে।’
এই নারী বিচারপতি বলেন, ‘সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য শুধু বিজ্ঞ বিচারকরা নয়, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে বিজ্ঞ আইনজীবীরাও অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। আদালতের অফিস সহায়ক থেকে শুরু করে সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এই মহাযজ্ঞের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটি সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে দিয়ে প্রতিটি মানুষের আইনের আশ্রয় লাভ ও বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব।’
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচার বিভাগকে একটি আধুনিক, সময়োপযোগী ও গতিশীল বিভাগ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে ইতিমধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে চলেছেন। আমি বিশ্বাস করি, প্রধান বিচারপতির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিচার প্রার্থী জনগণ অচিরেই এই রোডম্যাপের সুফল ভোগ করতে পারবেন। আমাদের বিচার বিভাগ দেশ ও জনগণের আইনি ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করে যাবে।