পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। যে উৎসব সবার। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রীষ্মের কাঠিন্য ভেদ করে বৈশাখের প্রাণবন্ততায় জেগে ওঠে লাখো হৃদয়। পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে ১৪৩২ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানাতে উৎসবের আমেজে মুখরিত হয়ে ওঠে রাজধানী। বিশেষ এই দিনে নারী-পুরুষ সবাই রঙিন পোশাকে সেজে ওঠে। কিন্তু সর্বজনীন এই উৎসবের রয়েছে আরেক ভিন্ন চিত্র। একদিকে যখন বাঙালি মেতে উঠেছে তাদের সর্বজনীন উৎসবে, রঙিন পোশাকে সেজেছে সবাই, ঠিক তখনই আরেকদল মানুষ জীবন সংগ্রামে লিপ্ত। এই বৈশাখী আনন্দ-উল্লাসের মাঝেও কারও কারও কাছে তা কেবলই টিকে থাকার লড়াই।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) রাজধানীর রমনা পার্কে কথা হয় ফেরি করে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করা কিছু শিশু-কিশোরের সঙ্গে।
রমনা পার্কে বাবা-মায়ের সঙ্গে বর্ষবরণ উৎসবে এসেছে শিশু সোহানা জাহান। সোহানা বলেন, আমি বাবা মায়ের সঙ্গে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে বেড়াতে আসি। রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ঘুরে বেড়াই। আমার এই দিনটা খুবই ভালো লাগে।
নতুন পোশাক পরে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া আরিবা আদনান। আরিবা বলে, পহেলা বৈশাখ আমাদের সবার উৎসব, সবাই মিলে পালন করি। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের আগে আব্বু আমাকে নতুন জামা কিনে দেয়। আব্বু বলেছে নতুন বছর নতুনভাবে শুরু করতে হয়। তাই নতুন জামা কিনি। আমার এই দিনটা অনেক আনন্দে কাটে। বছরের প্রথম দিনে আম্মু-আব্বু বকা দেয় না। ঘোরাঘুরি করি, এটাই মজা। প্রতিদিন এমন হলে ভালো হতো।’
সোহানা-আরিবার মতো আরও অনেক শিশু যখন বর্ষবরণ উদযাপনে মেতে ওঠে তখন তাদের মতোই অনেকেই নতুন বছরে সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ে জীবন সংগ্রামে। কথা হয় এমনই কিছু শিশুর সঙ্গে।
রমনা পার্কে বেলুন বিক্রি করছিল শ্যামলী। বয়স আনুমানিক ১৩-১৪ বছর। নিজের বয়সও জানে না। নিয়মিত বড় বোনের সঙ্গে আসে এই পার্কে ফুল বিক্রি করতে। আজ বিক্রি করছে বেলুন। এক ভাই তিন বোন আর মাকে নিয়ে তার পরিবার। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। তাদের এখন আলাদা পরিবার। আর বড় ভাই তাকে ও তার মাকে কোনও আর্থিক সহায়তাও করে না। শ্যামলীর মা কাজ করতে অক্ষম হওয়ায় জীবন যুদ্ধে নামতে হয়েছে তাকেই। তাই অন্য সব দিনের মতোই নববর্ষও তার কাছে একই, ভিন্ন কিছু না।
শ্যামলী বলে, পহেলা বৈশাখ তো আমারও পালন করতে ইচ্ছে হয়। নতুন জামা পরতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু টাকা না থাকলে বৈশাখ পালন করবো কীভাবে? টাকা না থাকলে মাকে খাওয়াবো কী! তাই বেলুন বিক্রি করছি। আজ মানুষ বেশি, বিক্রিও ভালো হবে। কিন্তু এখনও সেভাবে বিক্রি হয়নি। হয়তো হবে।
জান্নাতুল আক্তার আফরিন। বাসা সায়েদাবাদ। রমনা পার্কে এসেছে নানির সঙ্গে। টিস্যু আর মাস্ক বিক্রি করছেন নানি। মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো আফরিন। এখন পড়ছে না। আফরিন বলে, আমার বাবা নাই। মা অসুস্থ। কাজ করতে পারে না। আমাকেই কাজ করতে হয়। তাই পড়াশোনা বন্ধ।
নববর্ষে অন্য সব শিশুর মতো তারও মেতে থাকার কথা ছিল আনন্দে। কিন্তু সে এসেছে জীবন সংগ্রামে। আফরিন বলে, আমি পহেলা বৈশাখ পালন করি না। কীভাবে করবো? আফরিনের উত্তর জানা নেই।
মো. রাজিম, পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। থাকে মগবাজারের আমবাগান। রমনা পার্কে ঘুরে ঘুরে শসা-পেয়ারা বিক্রি করছিল। রাজিম বলে, আমি ক্লাস টুতে পড়ি। স্কুলের পর বিক্রিতে বাবাকে সাহায্য করি। আজ বন্ধ তাই সকালেই এসেছি।
পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে জানতে চাইলে রাজিম বলে, টাকা না থাকলে বৈশাখ পালন করা যায় না। যাদের টাকা আছে তারা এটা করবে।
শ্যামলী-আফরিন-রাজিমের মতো এমন অসংখ্য শিশু আছে এই শহরে, এই দেশে, যাদের প্রতিটি সকালই শুরু হয় সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। কেবল পহেলা বৈশাখই না সব বিশেষ দিনই তাদের কাছে একইরকম।