বেবিচকের এভসেক বিভাগের আন্দোলনের নেপথ্যে কারা

বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) গ্রাসের উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ বাহিনীর ষড়যন্ত্রের’ অংশ হিসেবে বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি ফোর্স (বিএএসএফ) গঠনের চেষ্টা চলছে— এমন অভিযোগ তুলে ‘বিক্ষোভ কর্মসূচি ও প্রতিবাদ সভা’ করেছে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত ১৭ মার্চ (সোমবার) সকালে সিভিল অ্যাভিয়েশন হেডকোয়ার্টার প্রাঙ্গণে কর্মসূচিতে ‘দখলদার হঠাও, সিভিল অ্যাভিয়েশন বাঁচাও’ ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। এসময় তারা সংস্থাটির চেয়ারম্যানের পদত্যাগও দাবি করেন। এমনকি আন্দোলনকারীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানাতে এসে কর্মীরা চেয়ারম্যানের সঙ্গে ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ’ করেন উল্লেখ করে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি সিভিল এভিয়েশনের ইতিহাসে ‘নজিরবিহীন’ ঘটনা।

তবে এই আন্দোলন নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। বেবিচক সংশ্লিষ্টদের দাবি, আন্দোলন কর্মচারীদের নানাভাবে উসকে দেওয়া ও মারমুখি যারা আচরণ করেছেন তাদের অধিকাংশই ভাড়া করা।

বেবিচকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বহিরাগতরাই আন্দোলনে আসা কর্মীদের উসকে দিয়েছে। তারাই মারমুখি আচরণ করেছেন। চেয়ারম্যানের সামনে অসৌজন্যমূলক আচরণের মূল হোতা তারাই ছিলেন।

ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঘটনার দিন বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট ‘হারুন’ ও ‘অলক’ নামে দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান থেকে আউটসোর্সিংয়ের প্রায় ১২০ জন শ্রমিক নিয়ে আন্দোলনে কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এরই মধ্যে আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেককেই ছবি ও ভিডিও দেখে এরইমধ্যে চিহ্নিত করেছে। ঠিকাদারের গাড়ি চালকও আন্দোলনে অংশ নেন। এছাড়া সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা শহীদুল্লাহর ভাই সাদ্দামসহ কিছু স্থানীয় লোকজন যারা বেবিচকের কোনও কর্মীই নয়, তাদেরও উপস্থিতি দেখা যায়। 

বিমানবন্দরে ‘অনিয়ম ও দুর্নীতির’ সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন— এমন কিছু বেবিচক কর্মীও আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ে বিভিন্ন সময় ধরাপড়া কর্মীও রয়েছেন। আন্দোলনে অংশ নেওয়া ওই কর্মীরা বিভিন্ন সময় আটকও হয়েছিলেন। তাদেরও চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা।

যদিও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেবিচকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এটি নিয়ে আলোচনা করছি। তাদের যুক্তিযুক্ত দাবিগুলোর ব্যাপারেও আমরা কাজ করবো। সেটি পূরণও হবে।’

‘অনিয়ম ও দুর্নীতির’ সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন— এমন কিছু বেবিচক কর্মীও আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন

বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫ আগস্টের পর বিমানবন্দরের নাজুক পরিস্থিতিতে বিমান বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যরা এসে দায়িত্ব নেওয়ার পর সেখানকার নানা ধরনের অসঙ্গতি দূর হয়েছে। এর মধ্যে লাগেজ কাটা ছিল অন্যতম। মাঝে মধ্যে লাগেজ কাটা নিয়ে প্রবাসীদের অভিযোগ ছিল। এছাড়াও লাগেজ দেরি করে পাওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হলেও প্রবাসী বা যাত্রীরা তাদের লাগেজ পেতেন না। সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে পাশাপাশি ইমিগ্রেশনের ফরম পূরণ সেখান থেকে নানা উপায়ে যাত্রীদের নিকট থেকে টাকা আদায় ছিল কিছু কর্মীদের উপরি আয়ের পথ। বিমান বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব নেওয়ার পর সেটি বন্ধ হয়ে গেছে।

বেবিচকের আরেক কর্মকর্তা দাবি জানান, কোনও ঘুষ কিংবা হয়রানি ছাড়া যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দে বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারছেন। বিমানবন্দর নিয়ে নানা জন-উদ্যোগ দেশ ও দেশের বাইরে ব্যাপক সুনামও ছড়িয়েছে। দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সামগ্রিকভাবে বিমানবন্দরের পরিবেশ আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় ভালো। বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়ার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, অন্যান্য কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার ফলে শাহজালালে যাত্রী সেবার বিশ্বমানের বলেই অনেকে মনে করছেন।

তিনি বলেন, এভিয়েশন সিকিউরিটির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। এমনকি তারা স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গেও যুক্ত। গ্রেফতারেরও নজির রয়েছে। এমনকি কিছু কর্মচারী অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে রাজধানীতে বাড়িও করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এরাই এই আন্দোলন সংগঠিত করেছেন। বিমান বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব নিয়ে বিমানবন্দরের সেবা নিয়ে যখন দেশ বিদেশে সুনাম কুড়াচ্ছিলেন ঠিক সেই সময় থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ এর বিরোধিতা শুরু করে। এদের উপরি ইনকাম বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে বিমান বাহিনীর সদস্যের ওপর নানা সময় ক্ষিপ্ত হয়। তারাই গত ১৭ মার্চ এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে বেবিচকের একাধিক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চলতি বছরের শেষে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এই দৃষ্টিকোণে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ নতুন জনবল নিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। এর ফলে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের অসৎ উদ্দেশ্য সফল করতে সাধারণ কর্মচারীদের উসকানি দিয়ে আন্দোলনে অংশ নেয়।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আন্দোলনকারী এভসেক কর্মকর্তা মাসুদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের ন্যায়ঙ্গত দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছি। আন্দোলনে শুধু এভসেক বিভাগ নয়, সিভিল এভিয়েশনের অন্যান্য বিভাগও যোগ দিয়েছিল।’

আন্দোলনকারীদের আরেকজন সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা চাই, সিভিল এভিয়েশন তার নিজস্ব কর্মী দ্বারা পরিচালিত হোক। এখানে চেয়ারম্যান, সিকিউরিটি মেম্বার ছাড়া অন্য পোস্টগুলোতে বাইরে সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব লোক থাকবে। আর বিমান বাহিনী আমাদের গর্বের বাহিনী। তাদের ব্যাপকভাবে বিমানবন্দরে নিয়ে আসাও আইন ও বিধিসম্মত নয়। তাই আমরা কারও সঙ্গে বৈরী আচরণ না করে আমরা আমাদের মূলত দাবিগুলো জানিয়েছি। আমাদের দাবিগুলোর সঙ্গে যারাই একমত হয়েছেন, তারাই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন।’

অভিযোগ রয়েছে, আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এভসেকের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড সার্টিফিকেশন) ইফতেখার জাহান। যদিও তা অস্বীকার করে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি ওইদিন চেয়ারম্যান স্যারের নির্দেশেই উত্তেজিত কর্মীদের নিবৃত করার চেষ্টা করেছি। আমি এই আন্দোলনের সঙ্গে ওইভাবে জড়িত নই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সিভিল এভিয়েশন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যাত্রী এবং কার্গো টার্মিনালগুলোতে নিরাপত্তার জন্য আইকাও এনেক্স-১৭ অনুসরণ করছে প্রধানত এয়ারফোর্স কর্মীদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও কঠোর পরিশ্রমের কারণে। এর ফলে, লন্ডন, ম্যানচেস্টার, টরন্টো ফ্লাইট এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এবং যুক্তরাজ্যের জন্য কার্গো চলাচল করছে। শিগগিরই নিউ ইয়র্ক ফ্লাইটও শুরু হবে।’

তিনি আরও বলেন, গত বছর সিভিল এভিয়েশনের ইতিহাসে শুধু হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সর্বোচ্চ ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব অর্জন করেছে। সর্বোচ্চ যাত্রী সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২৫ লাখ। যারা এই সাফল্য সহ্য করতে পারছেন না, তারাই নানাভাবে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এর গতি রোধ করতে চাইছে। আমরা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরকে বিশ্বের দরবারে আরও উঁচু করে মেলে ধরতে চায়, সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাবো।’