করোনা মহামারির পর থেকে দেশে কমেছে নারী অভিবাসন। মহামারির আগে দেশের মোট অভিবাসনের ১০ শতাংশ নারীকর্মী হলেও মহামারির পর তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২২ সালে নারীকর্মী অভিবাসনের হার হঠাৎ বেড়ে গেলেও পরবর্তী বছর ২০২৩ সালে আবার কমে যায়। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে তা আরও কমেছে। ২০২৩ সালের তুলনায় তা ১৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম।
অভিবাসন-সংশ্লিষ্টদের মতে, শোভন কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তা, নারীকর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত না করা, দক্ষতা না থাকা, বিদেশে নির্যাতনের শিকারসহ নানা কারণে অভিবাসনের হার কমেছে।
রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ২০২৪ সালের ‘বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের গতি প্রকৃতি’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫৪ হাজার ৬৯৬ জন নারীকর্মী কাজের উদ্দেশে বিদেশে গেছেন। অর্থাৎ এ সময়ের মোট অভিবাসীর ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ ছিলেন নারীকর্মী। কোভিডকালীন সময় বাদ দিলে গত ১০ বছরে এটি নারী অভিবাসনের সর্বনিম্ন রেকর্ড। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে নভেম্বর পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ ২২ শতাংশ কমেছে। রামরুর এক গবেষণা মতে, শোভন কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তার কারণে নারীকর্মীরা ক্রমশই অভিবাসনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।
বিএমইটি’র তথ্য বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নারী অভিবাসন এক লাখের বেশি ছিল, কিন্তু করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে নারী অভিবাসনের ধারা কমে গিয়েছিল। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে মোট ১ লাখ ৫ হাজার ৪৬৬ জন নারীকর্মী কাজের জন্য বিদেশে গেছেন। ২০২১ সালের তুলনায় নারী অভিবাসনের হার ওই বছর ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
অপরদিকে, ২০২৩ সালে কাজের উদ্দেশে বিদেশে যাওয়া নারীকর্মীর হার কমেছে ২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ২০২৩ সালে ৭৬ হাজার ১০৮ জন নারীকর্মী বিদেশ গেছেন, যেখানে ২০২২ সালে বিদেশ যাওয়া নারী কর্মীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ৫ হাজার ৪৬৬। গেলো বছর ২০২৪ সালে নারী অভিবাসন হয়েছে ৬১ হাজার ১৫৮ জনের। যা ২০২৩ সালের তুলনায় ১৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম।
ফিরে আসা নারীকর্মীর সংখ্যা জানে না কেউ
২০০৪ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত শুধু সৌদি আরবে নারীকর্মী গেছেন ৫ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৮ জন। তবে সে দেশ থেকে নানা কারণে ফেরত এসেছেন অনেকে। বিদেশ থেকে ফিরে আসা কর্মীদের কোনও হিসাব নেই সরকারি সংস্থার কাছে। তবে যারা পাসপোর্ট হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আউটপাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) নিয়ে ফিরে আসেন, তাদের হিসাব রাখে বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক।
বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা জানান, বিদেশ গিয়ে প্রত্যাশিত কাজ না পাওয়া, ঠিকমতো বেতন না পাওয়া, অতিরিক্ত কাজের চাপে অসুস্থতা, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা, শারীরিক নির্যাতন, স্বাস্থ্যগত সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা ও ভাষাগত প্রতিবন্ধকতাসহ নানা কারণে নারীকর্মীরা ফেরত আসেন।
নারীকর্মী বেশিরভাগই যায় সৌদি আরবে
নারীকর্মীরা যেসব দেশে কাজের উদ্দেশে যান তার মধ্যে সবার ওপরে সৌদি আরবের অবস্থান। গত ২০ বছরে ৫ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৮ জন নারীকর্মী সৌদি আরব গেছেন। তাদের বেশিরভাগই গৃহকর্মী। এরপর নারী কর্মীদের গন্তব্য হচ্ছে জর্ডান। ২০০৪ সালে থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১ লাখ ৯৪ হাজার নারীকর্মী সেদেশে গেছেন। জর্ডানে বেশিরভাগ নারীকর্মী যান গার্মেন্টসের কাজে। এরপরে আছে দুবাই। গত ২০ বছরে দুবাই গেছেন ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৩ জন নারীকর্মী। দুবাইয়ের পর আছে ওমান। তবে বেশ কিছু দেশে ভিসা বন্ধ থাকায়— তার প্রভাবও পড়েছে অভিবাসনের হারে।
দেশে ফিরে আসা নারীকর্মীরা গন্তব্য দেশের কাজ নিয়ে নানা অভিযোগ করেন। কেউ কেউ নির্যাতন-নিপীড়নের নানা অভিযোগ করেন। যৌন নির্যাতনের শিকার কেউ কেউ ফিরছেন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে। কাজের নিরাপদ পরিবেশ না থাকায় সৌদি আরব থেকে প্রায় প্রতি মাসেই নারী গৃহকর্মীরা ফিরে আসতে বাধ্য হন বলে জানান তারা।
১৯৯১ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে নারীকর্মী পাঠানো শুরু হয়। নির্যাতনের অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। নারীকর্মীদের বেশিরভাগই সৌদিআরবে যান গৃহকর্মী হিসেবে। কর্মী বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থতা, বাড়ির জন্য কাতর হওয়া, কম বেতন, কিংবা বিনা বেতনে কাজ করা, খাদ্যাভ্যাস ও ভাষার সমস্যার পাশাপাশি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ বাড়তে থাকে ব্যাপক হারে।
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের (বিএনএসকে) নির্বাহী পরিচালক ও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য সুমাইয়া ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নারী অভিবাসনের সবচেয়ে বড় কারণ আমরা অ্যানালাইসিস করে দেখেছি যে, নারীদের জন্য যে সাপোর্ট দরকার সেটি নাই। নারীরা বিদেশে চলে গেলে তার সন্তান কে দেখবে, ডে কেয়ারগুলোতে তাদের জন্য সাপোর্ট নেই। তেমনিভাবে বিদেশে যাদের সাপোর্ট দরকার, সেটি তো দেওয়া যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘আরেকটি কারণ হতে পারে মার্কেটটি ডাইভার্ট হয়ে গেছে। দুই বছর আগে যখন সৌদি আরবের বাজার পরিদর্শনে গেলাম, তখনই তারা বলছিল যে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে লোক নেওয়ার কথা। আমার মনে হয়, সৌদি আরব সেখান থেকে গৃহকর্মী নেওয়া শুরু করেছে। নিয়োগকর্তারা বলছিল যে, আমাদের কর্মীরা অদক্ষ হয়ে যাচ্ছে সেখানে। তারা দক্ষকর্মী অভিবাসনের দিকে যেতে চায়। সুতরাং, একটা কারণ হতে পারে যে, দক্ষকর্মী না পাঠাতে পারায় নারীকর্মী কমে যাচ্ছে। আরেকটা কারণ হচ্ছে— নারীকর্মীর যে সাপোর্ট দরকার সেটা সরকার, পরিবার কিংবা সমাজ দিতে পারছে না। এজন্য তৈরি পোশাক খাতেও কিন্তু নারীকর্মীর সংখ্যা কমে গেছে।’
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘যেহেতু আমাদের নারীকর্মীরা বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যে যায়, সেখানে তাদের সুরক্ষা মেকানিজম, কাজের মান ও পরিবেশ কতটা উন্নতি হয়েছে— সেটি আমাদের নজরদারি করা উচিত। তবে আমাদের মনোযোগী হতে হবে দক্ষকর্মী তৈরির দিকে। কত সংখ্যক নারী শ্রমিককে সৌদি আরবে বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে পাঠালাম, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো— বিকল্প হিসেবে যদি গার্মেন্টস শ্রমিক বা দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারি, তাহলে সংখ্যায় কম গেলেও বেশি রেমিট্যান্স আনতে পারি। সুরক্ষাটাও ভালো থাকে এবং সেদিকেই দৃষ্টি দেওয়া উচিত।’
রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘নারীকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে এক মাসের প্রশিক্ষণ বাড়িয়ে দুই মাস করা হয়েছে, তাতে প্রক্রিয়াগত সময় বেড়েছে। তাছাড়া সৌদি আরব থেকেও এখন সেভাবে চাহিদা আসছে না।’