ক্রেতা কমেছে চকবাজারে

‘রোজা খোলাই’ শব্দটি পুরান ঢাকার স্থানীয়দের মধ্যে বেশ পরিচিত। মূলত ঐতিহ্যগতভাবে ইফতারকে বিশেষ এই শব্দে ডাকার প্রচলন আদি ঢাকার মানুষের মাঝে। আর এই রোজা খোলাইয়ে গোটা ঢাকাবাসীর কাছে অন্যতম আকর্ষণ থাকে চকবাজারের বিখ্যাত ইফতার বাজার। ঐতিহ্য, বৈচিত্র, স্বাদ সব মিলিয়ে পুরান ঢাকার স্থানীয়দের চেয়ে ঢাকার অন্য এলাকার মানুষের কাছে এই বাজারের কদর বরং বেশিই বলা যায়। বাহারি সব ইফতারের স্বাদ নিতে ঢাকা ছাড়াও দেশের নানা প্রান্তের মানুষ ছুটে আসেন চার শত বছরের পুরোনো এই বাজারে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭০২ সালে ঢাকার দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খাঁ চকবাজারকে আধুনিক বাজারে পরিণত করেন। আর এই চকবাজারের শাহী মসজিদের সামনে ছিল একটি কূপ। তার চারপাশেই চেয়ার-টেবিল বিছিয়ে বিক্রি করা হতো ইফতারের বিভিন্ন উপকরণ। নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ১৮৫৭ সালের আগেই চকবাজার জমজমাট হয়। রোজার সময় মোগলাই খাবার এবং রকমারি ইফতার বিক্রি করা হতো এখানে।

শত বছরের এই ঐতিহ্যে চলতি বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে রমজানের প্রথম তিন দিন দেখা গেছে, এই বাজারের চিরচেনা জমজমাট দৃশ্যে অনেকটাই ছেদ পড়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবছর রমজানের শুরুর দিন থেকেই জমজমাট থাকে বাজারটি। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষের পদচারণায় থাকে উপচে পড়া ভিড়। তবে এ বছর এখনও মানুষের চিরচেনা উপস্থিতি দেখা যায়নি।

এই বাজারে প্রায় ২০ বছর ধরে হালুয়া, জরদা, ফিরনি বিক্রি করছেন মো. সোহরাব হোসেন। তিনি বলেন, ‘এবার লোক কম আছে। তিন দিনের মধ্যে আজ একটু লোক আসছে। এর আগে এমন হয়নি। আপনি (প্রতিবেদক) এখানে দাাঁড়াতে পারতেন না লোক হলে। প্রতিবছর রোজার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন ভিড় শুধু বাড়েই।’

পছন্দের সব ইফতার বিক্রি করছেন তারা

দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষের চাহিদা কমেছে কিনা জানতে চাইলে এখানকার এক ইফতার বিক্রেতা জানান, গত বছরের তুলনায় ইফতার সামগ্রীর দামে খুব বেশি পার্থক্য হয়নি। কিছু পণ্যের বিশেষ করে মাংসের আইটেমগুলোর দাম কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া অন্য পণ্যের দাম আগের মতোই। ইফতার আইটেমের দাম না বাড়লেও আকারে ছোট করা হয়েছে।

শাহী পরোটা বিক্রেতা রানা বলেন, ‘দাম এবার তেমন বাড়েনি। মাংস আর মিষ্টি জিনিসগুলোর দাম বেড়েছে। এগুলা প্রতিবছরই বাড়ে। তবে অন্য যে আইটেমগুলো আছে সেগুলোর কিছু কিছুর দাম এবং সাইজের উনিশ-বিশ হয়েছে। বাকিগুলো আগের বছরের মতোই আছে।’

দোকানিরা জানান, তন্দুরি চিকেন এবার প্রতি পিস ৪০০ টাকা রাখা হচ্ছে, গতবার যা ছিল ৩০০ টাকা। ছোট আকৃতির কোয়েলের রোস্ট প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা। গত বছর যা ছিল ৬০ টাকা। পাকিস্তানি মুরগির আস্ত রোস্ট আকারভেদে প্রতিটি ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবার। গত বছর যার দাম ছিল ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এছাড়া আলুর চপ প্রতি পিস ৫ টাকা, বেগুনি ৫ টাকা, পেয়াজু ৫ টাকা, ডিম চপ আকারভেদে ২০ থেকে ৪০ টাকা, চিকেন বল ৩৫ টাকা, চিকেন কাকোজ পিস ৪০ টাকা, চিকেন শর্মা ৪০, চিকেন ফ্রাই ৪৫ টাকা, সাসলিক ৩৫ টাকা, অনথন ২০ টাকা, মাল পোয়া পিঠা ২৫ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে।

এছাড়াও প্রতি পিস মুরগির রোস্ট ৩০০ টাকা, কোয়েল পাখির রোস্ট ১০০ টাকা, গরুর কারি ১৬০ টাকা, আস্ত গ্রিল ৭০০ টাকা, টিকা কাবাব ৩০ টাকা পিস, ভেজিটেবল রোল ৩০ টাকা, চিকেন রোল প্যাটিস ৪০ টাকা, চিকেন প্যাটিস ৫০ টাকা, চিকেন শর্মা ৭০ টাকা, চিকেন ললিপপ ৪০ টাকা, চিকেন রেশমি কাবাব ৫০ টাকা, মিনি পিজ্জা ৭০ টাকা, চিকেন টিক্কা ২০০ টাকা, মুরগির কাঠি ৮০ টাকা, বিফ জালি কাবাব ১২০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি, চিকেন তন্দুরি ১৫০ টাকা, চিকেন কারি ১৫০ টাকা, শাহী পরোটা ৮০-১২০ টাকা, স্পেশাল পরোটা ১৫০ টাকা, টানা পরোটা ৪০ টাকা, চিকেন নাগেট ৮০ টাকা, চিকেন লেগ ১০০ টাকা, বাটিতে বাটিতে সাজানো দই বড়ার দাম ১২০ থেকে ২৪০ টাকা। শাহী জিলাপি প্রতি কেজি সাড়ে ৩০০ টাকা, মাঠা ১০০ টাকা কেজি এবং হালিম প্রতি বক্স বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ৮০০ টাকা।

গরম গরম জিলাপি ভাজা হচ্ছে

তাহলে ঠিক কী কারণে চাহিদা এখনও জমে ওঠেনি বিখ্যাত এই বাজারে, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত দেশে চলমান মূল্যস্ফীতি এর অন্যতম কারণ। এছাড়া মাসের শুরুতেই রমজান শুরু হওয়াকে কারণ হিসেবে মনে করছেন কেউ কেউ। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে বেতন হতে মাসের ১০ তারিখ লেগে যায়। তাই কয়েক দিন বাদে পুরোনো রূপে ফিরবে ঐতিহ্যবাহী এই বাজার, এমনটাই প্রত্যাশা তাদের।

শরবত বিক্রেতা রুদ্র বলেন, ‘প্রতিবছর একইরকম ভিড় না-ই হইতে পারে। মানুষের হাতে টাকা নেই, সব জিনিসের দাম বেশি। এখানে স্থানীয়দের চেয়ে বাইরের মানুষ বেশি আসে। ঢাকার শেষ প্রান্ত থেকেও আসে। সিলেট, চিটাগাং থেকেও অনেকে আসেন এখানে একবার ইফতার করতে। এসব মানুষ তো টাকা না থাকলে আসবে না, সহজ হিসাব। আর মাসের শুরুতে এবার রোজা পড়ছে, বেতন হয়নি। দুই-চার দিন পর ভিড় বাড়বো এমনিতেই।’

শাহী পরোটা বিক্রেতা রানা অবশ্য ভিন্ন একটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এখানকার খাবার এখন ঢাকার সবখানেই পাওয়া যায়। ইউনিক দু-একটা আইটেম ছাড়া সবখানে পাবেন। শাহী পরোটা এখন গুলশান-বনানীতেও পাওয়া যায়।’

তবে স্থানীয়রা আরও কয়েকটি বিষয়ে নজর এনেছেন। তারা এখানকার খাদ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পাশপাশি যানজটের বিষয়টিও মনে করিয়ে দিচ্ছেন। যদিও এখানকার দোকানগুলোতে বিক্রেতাদের হাতে ও মাথায় সুরক্ষা গ্লাভস পরতে দেখা গেছে। কিন্তু অধিকাংশ খাবারই খোলা অবস্থায় বিক্রি হচ্ছে।

ইফতারের বৈচিত্রময় সব আইটেম বেচাকেনা চলছে

স্থানীয় বাসিন্দা শোয়াইব আখতার বলেন, ‘চকবাজারে ভাজাপোড়া সাধারণত আমরা স্থানীয়রা খাই না। এর কারণ বলতে পারেন স্বাস্থ্য ঝুঁকি। আপনি যতগুলো খাবার দেখবেন, অতিরিক্ত তেল। যতগুলো মাংসের জিনিস দেখবেন, এরা ভালো মাংস এনেছে না কী করেছে আমাদের জানা নেই। এদের সব জিনিস দিনের দিন বিক্রিও হয় না। খোলা জায়াগায় ধুলাবালির মধ্যে বিক্রি করছে। রোজার সময় স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে আগে। এদের জিনিস খেয়ে অসুস্থ হওয়ার দরকার নেই। মসজিদে যতজন মুসল্লি আসছে, তাদের কতজন এখান থেকে কিনে আপনি (প্রতিবেদক) দাঁড়ালেই দেখতে পারবেন। কেউই কেনে না।’

তবে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এই বাজারের আকর্ষণের ভিন্ন ভিন্ন কারণ। কারও মতে ঐতিহ্য, কারও কাছে সৌখিনতা, আবারও কারও কারও মতে ট্রেন্ড।

বংশালের বাসিন্দা আলিম উদ্দিন বলেন, ‘রমজানে ছোটবেলা থেকেই চকবাজারের ইফতার খাওয়া হয়। আগে বাবা আনতেন, এখন আমি নিতে আসি। এখানকার খাবারগুলো মসলাদার, আমাদের বাড়ির সবার পছন্দ। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ইফতার আইটেম পাওয়া যায়। যেটা অন্য কোনও বাজারে পাওয়া যায় না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ঋদ্ধ শাহী বলেন, ‘আমি ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার পর প্রতিবছরই বন্ধুদের সঙ্গে একবার করে চকবাজারে ইফতার করতে আসি। ছোটবেলা থেকে টেলিভিশন, পত্রিকায় সংবাদ দেখতাম এখানকার বাহারি ইফতারের। তখন থেকেই মনে মনে ইচ্ছা ছিল সুযোগ পেলে এখানকার ইফতারের স্বাদ নেওয়ার। এবার রোজার শুরুতেই সুযোগ হলো আসার। ভিড় কমের কারণে ভালো লাগছে। আর বিশেষত্ব হলো অন্য জায়গা থেকে বেশি বাহারি খাবার পাওয়া যায়।’

বনশ্রী থেকে আসা তাইফুর রহমান বলেন, ‘এমনিতে সব সময় ফেসবুক-ইউটিউবে নাম শুনেছি। খুব ট্রেন্ডি একটা ইফতার মার্কেট। চকবাজারে আসার ইচ্ছা অনেক দিনের। কিন্তু আসবো আসবো করে এতদিন আর আসা হয়ে ওঠেনি। সুযোগ পেয়েই তাই বন্ধুদের সঙ্গে চলে এলাম। ভিন্ন রকমের খাবার দেখে ভালো লাগছে।’

চকবাজারের ইফতারের এই আইটেমগুলো একটু বেশিই স্পেশাল

বড় বাপের পোলায় খায়

চকবাজারের প্রধান আকর্ষণ থাকে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নামে বিশেষ ইফতার আইটেম। হাঁটতে হাঁটতে মসজিদের সামনে যেতেই কানে আসে, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়’, ‘ধনী-গরিব সবাই খায়, মজা পাইয়া লইয়া যায়’, ‘মজার খাওন খাইয়া যান, প্যাকেট ভইরা লইয়া যান’, ‘আসল খাওন দেইখা যান, বাসার লাইগা নিয়া যান’। এভাবেই ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ছন্দ মিলিয়ে হাঁকডাক দিচ্ছেন ৬০ পেরোনো বিক্রেতা হোসেন মিয়া। তিনি জানান, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে বিশেষ এই খাবার বিক্রি শুরু করেন।

হোসেন মিয়া আরও জানান, ‘পুরান ঢাকাসহ গোটা রাজধানীতে একটি আকর্ষণীয় ইফতারির আইটেম হিসেবে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ অত্যন্ত পরিচিত। এটি তৈরিতে মাংস, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, ডাবলি, বুটের ডাল, ডিম, মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনা মরিচসহ নানা পদের খাবার আইটেম এবং হরেক ধরনের মসলা প্রয়োজন হয়। দোকান ও মানভেদে ৮০০-১২০০ টাকা কেজি দরে এই খাবার বিক্রি হয়।

বিখ্যাত এই খাবার কিনতে আসা সাইফুদ্দিন বলেন, ‘চকবাজারের বিখ্যাত আইটেম এটা। পরিবারের সবার জন্য প্রায়ই কেনা হয়। একটু ভিন্ন ধরনের খাবার। অনেক কিছু মেশানো থাকে, তাই স্বাদটা পছন্দ সবার।’