বেইলি রোড ট্র্যাজেডির এক বছর

রেস্তোরাঁপাড়ায় অগ্নিনিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত হলো

গত বছর লিপ ইয়ারের দিনে (২৯ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নারী-শিশুসহ ৪৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। এই ট্র্যাজেডির পর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে এবং রাজধানীসহ সারা দেশে অনুমোদনহীন রেস্তোরাঁগুলোতে দফায় দফায় চালানো হয় অভিযান। বিশেষ করে বেইলি রোড ও ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের অধিকাংশ রেস্তোরাঁয় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় সেগুলো সাময়িক বন্ধ করা হয়েছিল। তবে অভিযান বন্ধ হওয়ার কিছুদিন পরই আবারও খোলা হয়েছে সেসব রেস্তোরাঁ। চলছে আগের মতোই। অগ্নি-সচেতনতা কিছুটা বাড়লেও বেশিরভাগ রেস্তোরাঁতেই নেই বহির্গমন সিঁড়ি বা স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংকলার ব্যবস্থা। এমনকি কোনও কোনও রেস্তোরাঁয় পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশারেরও অভাব রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের মধ্যে অগ্নি-সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে, তবে তা সন্তোষজনক নয়। ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৫০ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে বেড়ে ৬০-৬৫ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে ঝুঁকি পুরোপুরি কাটেনি।

সরেজমিনে যা দেখা গেলো

বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে সরেজমিনে যা দেখা যায়, এই সড়কের দুইপাশে বেশ কিছু ভবনের শতাধিক রেস্তোরাঁ রয়েছে। এসব রেস্তোরাঁগুলো গত বছরের তুলনায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা কিছুটা উন্নত হয়েছে, কিছু ভবনে রেস্তোরাঁর সংখ্যা কমানো হয়েছে। তবে এখনও অনেক জায়গায় গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হচ্ছে বহির্গমন সিঁড়ির নিচে এবং পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশার ও সেন্ট্রাল পানির সংযোগেরও অভাব রয়েছে।

মার্শাল প্লাজা: ছয়তলা ভবনটিতে পিৎজা হাট, ডোসা এক্সপ্রেস, পিৎজা বার্গ ক্যাফে-এর মতো জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ রয়েছে। ভবনে মাত্র একটি লিফট ও সিঁড়ি থাকায় অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে নিরাপদে বের হওয়ার সুযোগ নেই।

তৃতীয় তলার ডোসা এক্সপ্রেসের ম্যানেজার জানান, ‘বেইলি রোডের ঘটনার পর তারা ফায়ার এলার্ম, বহির্গমন পথ ও অগ্নিনির্বাপণের প্রাথমিক সরঞ্জাম সংযোজন করেছেন’। তিনি এমন দাবি করলেও বাস্তব চিত্র কিছুটা ভিন্ন।

রূপায়ণ জেড আর প্লাজা: একসময় ১৩টি রেস্তোরাঁ থাকলেও অভিযানের পর অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে এখানে চারটি রেস্তোরাঁ রয়েছে, ভবনের মালিকপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে নতুন করে রেস্তোরাঁর জন্য ভাড়া দেওয়া হবে না।

কেরি ক্রিসেন্ট টাওয়ার: বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনটিকে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয় এবং ২০২৩ সালের ৪ মার্চ সিলগালা করা হয়। তবে মাত্র ১৫ দিনের মাথায় আবার চালু করা হয় এ ভবনের রেস্তারাঁগুলো। এখনও এখানে ১০টি রেস্তোরাঁ চলছে, যেগুলোর কোনওটিরই ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন নেই।

ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টার: এখানে ১৫টি রেস্তোরাঁ ও লাউঞ্জ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দ্য ফরেস্ট লাউঞ্জ, দ্য ক্যাফে রিও, অ্যামব্রোসিয়া ইনফিনিটি লাউঞ্জ, দ্য বুফে স্টোরিজ, গ্র্যান্ড লাউঞ্জ, ধাবা, গার্লিক ইন জিঞ্জার, হান্ডি ইত্যাদি। ভবনটির বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে, তবে এখনও বেশিরভাগ রেস্তোরাঁতেই আধুনিক অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। ফলে যেকোনও সময় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে এই ভবনটি।

কেরামত আলী ভূঁইয়া (কে বি) স্কয়ার: ১৩ তলা ভবনটিতে আগে ১৩টিরও বেশি রেস্তোরাঁ থাকলেও বর্তমানে সাতটি চালু আছে। ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ফায়ার অ্যালার্ম ও বালতি ভরা বালি থাকলেও জরুরি বহির্গমন সিঁড়ির অবস্থান সুবিধাজনক নয়। একই সঙ্গে এ ভবনের থাকা রেস্তোরাঁগুলোর কিচেনের ভেতরে নেওয়া হয়নি পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।

পরিবর্তন কতটুকু?

সাত মসজিদ রোডের বেশ কিছু ভবনে ফায়ার এলার্ম, বহির্গমন ব্যবস্থা এবং অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম সংযোজন করা হলেও ঝুঁকির মূল কারণগুলো রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় এসব রেস্তোরাঁ এখনও ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।

বেইলে রোডের ঘটনার পর রেস্তারাঁগুলোতে অগ্নিনির্বাপর ব্যবস্থা নিশ্চিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একযোগে অভিযান শুরু করেছিল। তবে কিছুদিন পরই থেমে যায় সেই অভিযান। এ বিষয়ে গত বছরে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (চলতি দায়িত্ব) মো. আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘ধানমন্ডির কোনো ভবনেই রেস্তোরাঁ পরিচালনার অনুমতি নেই, তবে আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবনের ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত রেস্তোরাঁ হতে পারে। পুরো ভবনজুড়ে রেস্তোরাঁ হলে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস যৌথ অভিযান চালায়, যা পরে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির আবেদনে স্থগিত করা হয়। তারা দ্রুত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁর তালিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু এক বছর পার হলেও সেই তালিকা পাওয়া যায়নি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্টের আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সঙ্গে আমরা একাধিকবার বৈঠক করেছি। তখন একটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁগুলোর তালিকা তৈরির কাজ শুরু করার কথা ছিল। তবে সরকার পরিবর্তনের পর সেই কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেছে। বর্তমানে আমরা সরকারের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। যখনই আমাদের ডাকা হবে, তখনই আমরা আলোচনায় বসতে প্রস্তুত।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় ৪ লাখ রেস্তোরাঁ রয়েছে, এর মধ্যে মাত্র সাড়ে ৩শ’ রেস্তোরাঁ ফায়ার লাইসেন্স নিয়েছে। বেশিরভাগই নির্দেশনা মানছে না, বিশেষ করে ভবন মালিকরা অগ্নিনিরাপত্তায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না।’

বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের এক বছর পরও রাজধানীর রেস্তোরাঁগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। কিছু রেস্তোরাঁ প্রাথমিক পদক্ষেপ নিলেও সার্বিক নিরাপত্তা এখনও অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়মিত তদারকি না করলে আরেকটি বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ।