জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘যদি সত্যি ভাষা আন্দোলনের চেতনা আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকতো, তবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালাগুলো বাংলায় রচিত হতো, জনগণের জানার সুযোগ থাকতো। অথচ আজও শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে প্রশাসনের নীতিনির্ধারণ পর্যন্ত, সবক্ষেত্রে ইংরেজির আধিপত্য। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে হবে। বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নাহলে ভাষার জন্য এত সংগ্রাম, এত আত্মত্যাগ, সবই অর্থহীন হয়ে যাবে।’
শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদ আয়োজিত ‘ভাষা আন্দোলন ও মওলানা ভাসানী’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী সব দলিল, পরিকল্পনা, এমনকি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও ইংরেজিতে প্রণীত হয়। নদ-নদী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি কিংবা স্বাস্থ্য খাত—সবক্ষেত্রেই সরকার যে নীতি নির্ধারণ করে, তা ইংরেজিতে রচিত হয়। ফলে জনগণের সঙ্গে এর সংযোগ তৈরি হয় না। জনগণ জানেই না, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী পরিকল্পনা হচ্ছে, কী পরিবর্তন আসতে চলেছে। এটি জ্ঞানের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করছে, যা প্রকৃত অর্থে জনগণকে রাষ্ট্রের মূল চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।’
রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় জনগণের সম্পৃক্ততা নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক থাকা জরুরি। কিন্তু আজও রাষ্ট্র যে নীতি নির্ধারণ করছে, তা জনগণের কাছ থেকে গোপন বা দূরে রাখা হচ্ছে। এমনকি অর্থনীতি বিষয়ক নীতিমালাগুলোও সাধারণ জনগণের জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হয় না। অথচ এটি অত্যন্ত জরুরি, যাতে দেশের মানুষ তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত থাকতে পারে।’
শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষার অবহেলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার বেশিরভাগ রেফারেন্স বই ইংরেজিতে হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ভাষার জন্য আলাদা পরিশ্রম করতে হয়, যা তাদের জ্ঞানের সঙ্গে প্রকৃত সংযোগ স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করে। মাতৃভাষায় শিক্ষার যে সুবিধা থাকার কথা, তা উপেক্ষিত হচ্ছে। অথচ সত্যেন বসু, জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ—সবাই একবাক্যে বলেছেন, মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রকৃত জ্ঞানার্জন সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘মওলানা ভাসানীসহ বামপন্থী নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ফলে ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার অধিকার নয়, বরং রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথ তৈরি করেছিল। ভাষা আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মোড় নেয়, যুক্তফ্রন্টের উত্থান ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রশস্ত হয়। অথচ এত সংগ্রামের পরও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান আজও প্রশ্নবিদ্ধ।’
আয়োজক সংগঠনের সভাপতি এ এস এম কামালউদ্দিনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ।