শনিবার বিকাল ৪টা ৮ মিনিট। রাজধানীর পান্থকুঞ্জ পার্কের পশ্চিমের খোলা গেট দিয়ে প্রবেশ করে হোপ ভ্রাম্যমাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি বাস। গাড়িটির দরজায় উঁকি দিতেই দেখা যায় ৪ থেকে ১০ বছরের শ খানেক শিশু। গাড়ি থেকে এক এক করে নেমে পার্কের দিকে হেঁটে যায় তারা। কারও হাতে স্কুল ব্যাগ, কারও হাতে বই, কারও হাতে আবার নানান রং-বেরঙের পেন্সিল। ভ্রাম্যমাণ ওই স্কুল থেকে নেমেই পার্কের ভেতরে বাচ্চাদের ছুটাছুটি আর হৈ-হুল্লোড়। হেঁটে পার্কের আরেকটু ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখে মেলে আরও শ খানেক শিশুর। যাদের সবাই এসেছে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন স্কুল থেকে। পার্কে আসা এসব ছোট শিশুদের উদ্দেশ্য একই– পান্থকুঞ্জ পার্ককে রক্ষা করা। এ সময় শিশুরা পার্কে একসঙ্গে জড়ো হয়ে কীটপতঙ্গ, গাছ-গাছালিসহ প্রকৃতির নানান ছবি আকঁতে দেখা যায়। শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর কাওরান বাজার এলাকার পান্থকুঞ্জ পার্কে বিকালে সরেজমিন ঘুরে এমনই দৃশ্য দেখা যায়।
সাড়ে ৬ বছরের শিশু আজওয়াদ হাসনাইন। রাজধানীর একটি স্কুলে কেজিতে পড়ে। মিরপুর থেকে মায়ের হাত ধরে এসে বিকালে পার্ক রক্ষার আন্দোলনে অংশ নেয় সেও। মা ফাহমিদা ইসলাম বলেন, আমরা পরিবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছি। প্রকৃতি বাঁচাতে আজ বাচ্চাকে নিয়ে হাজির হলাম। আজ শিশুদের সঙ্গে এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন গণসংগীত ও চিত্রশিল্পী কফিল আহমেদ।
পান্থকুঞ্জের পার্কের এই দৃশ্যটি শুধু আজকের না। টানা ৫১ দিন ধরে ‘বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন’-এর ব্যানারে মিলিত হয়ে শত শত পরিবেশবাদী কর্মী বিভিন্ন শিল্পকর্মে, সভা-সমাবেশে ও মানববন্ধনে পান্থকুঞ্জ পার্কটির প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ পার্কের ভেতরে তাঁবু পেতে ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করছেন। শত কষ্ট হলেও তাদের লক্ষ্য পার্কটি রক্ষার। রক্ষা না হওয়া পর্যন্ত তারা পিছু হটবে না বলে অঙ্গীকার করেছে।
পার্কে ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করা আন্দোলনকারীদের একজন ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট ও পরিবেশকর্মী সৈয়দ মো. জাকির। তিনি বলেন, আমাদের সবারই ব্যক্তিগত কাজকর্ম আছে। তারপরও প্রকৃতিকে বাঁচাতে কেউ না কেউ এগিয়ে আসতে হবে।
অন্যান্যদের পাশাপাশি আমরা ১০ জনের একটি দল রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা পার্কে অবস্থান করছি পার্কটিকে রক্ষা করতে। তিনি বলেন, এখন আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। রাজধানীতে আরও যে সকল পার্ক আছে সেগুলোকে নানাভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। বায়ুদূষণ নিয়ে প্রতিদিন আমাদের ওয়ার্নিং দিচ্ছে। তবে আমাদের কোনও খবর নেই। জনগণের পার্ক ধ্বংস করে হচ্ছে তাও আবার বিদেশি ঋণে। নতুন সরকারে উচিত ছিল বিষয়টি পর্যালোচনা করা। আসল কথা আমাদের সবুজ বাঁচাতে হবে। এটাতে আপনারা হাত দেবেন না। করোনার সময় আমরা দেখেছি অক্সিজেনের জন্য কী আকুলতা।
সেখানে বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারী আমিরুল রাজিব বাংলা ট্রিবিউন বলেন, আমরা গাছের মতো বসে আছি। আমরা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে এ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। এটা আমাদের অধিকার। হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জ ছাড়া ২০ লাখ লোকের আর কোনও খোলা জায়গা নেই। এতগুলো মানুষ কোথায় যাবে, কোথায় দাঁড়াবে। তিনি বলেন, এখন কোনও পার্কের আদর্শ নেই। এখন এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, একটা পাতা যদি ছেঁড়া হয় তাহলে রেড অ্যলার্ট জারি করা উচিত। গণঅভ্যুত্থানের যে অঙ্গীকার তাতে দেখা যাচ্ছে প্রাণ, প্রকৃতি-পরিবেশ উপেক্ষিত।
অচিরেই সরকারের সুবুদ্ধি উদয় হওয়া উচিত। অবিলম্বে পান্থকুঞ্জ এবং হাতিরঝিল থেকে সকল প্রকৃতি বিধ্বংসী ও জনবিরোধী স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে। ধার করে-বিদেশি ঋণে ঘি খাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে আজকের নতুন বাংলাদেশে।
এরআগে সেখানে এক প্রতিবাদী সমাবেশে বক্তারা বলেন, আন্দোলনের শুরুর দিকে তিন উপদেষ্টা এসেছিলেন।
তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক করার কথাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু, এখনও সে বৈঠক হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না, থাকলে প্রকল্প পর্যালোচনার উদ্যোগ নিতো।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এই আন্দোলনের শুরুর কিছুদিনের মধ্যে সরকারের তিন উপদেষ্টা এসে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ৪০ দিন পার হলেও সেই অর্থে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করা হয়নি। সরকারের দিক থেকে কোনও নড়াচড়া নেই। পান্থকুঞ্জ অংশে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ বন্ধ থাকলেও হাতিরঝিল অংশের কাজ চলমান। এটা প্রমাণ করে যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরের সরকার, যারা নিজেদের জনমানুষের সরকার বলে দাবি করে, বিগত সরকারের স্বার্থের প্রকল্প বাতিলের কথা ছিল তাদের; কিন্তু সে উদ্যোগের লক্ষণ নেই।
এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ চুক্তি পর্যালোচনা করার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এলাকাবাসী, পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিলকে মুক্তি দিন। এই প্রকল্পের সময় পরিবেশগত সমীক্ষার নামে যা হয়েছে, সেখানে কোনও নগর পরিকল্পনাবিদ ও এলাকাবাসীর যুক্ততা ছিল না। এই প্রকল্প থেকে বিদেশি কোম্পানির মুনাফা হচ্ছে। আর সুফল পাবে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী।