বইমেলায় অভ্যুত্থানের স্মৃতি, থাকছে ‘জুলাই চত্বর’

বছরজুড়ে পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে শুরু হয়েছে ‘অমর একুশে বইমেলা-২০২৫’। শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) বিকাল ৪টায় বইমেলার এবারের আসরের উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস। বইমেলায় এবারের প্রতিপাদ্য ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। প্রতিপাদ্যের মতোই বইমেলার এবারের আসরে গুরুত্ব পেয়েছে জুলাই আন্দোলন। আন্দোলনের স্মৃতিকে চির-অম্লান ও আন্দোলনের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে এবছর বইমেলায় থাকছে ‘জুলাই চত্বর’।

গতবারের চেয়ে এবারের বইমেলায় বেড়েছে পরিধি ও স্টল সংখ্যা। আয়োজকদের তথ্য অনুযায়ী, এবছর মেলায় অংশ নিচ্ছে ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। যেখানে গত বছর অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৩৫টি। এবছর মেলায় স্থান পাওয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকছে ৬০৯টি প্রতিষ্ঠান। আর মোট ৩৭টি প্যাভিলিয়নের ৩৬টিই থাকবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে থাকছে ১টি। এবছর লিটল ম্যাগাজিন চত্বর সোহারাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছে ১৩০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিশুচত্বরে মোট প্রতিষ্ঠান ৭৪টি এবং ইউনিট ১২০টি।

বইমেলায় জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

মাসব্যাপী এই মেলা প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। তবে রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না। ছুটির দিন বইমেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।

বিগত এক দশকের মতো এবারও বইমেলা হচ্ছে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশ নিয়ে। বইমেলার বিন্যাস গতবছরের মতোই রাখা হলেও আঙ্গিকগত কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে গতবারের মেলার বাহির পথ এবার কিছুটা সরিয়ে মন্দির গেটের কাছাকাছি নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া টিএসসি, দোয়েল চত্বর, এমআরটি বেসিং প্ল্যান্ট এবং ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অংশে মোট চারটি প্রবেশ ও বাহির পথ থাকছে। 

বিভিন্ন ব্যানার-পোস্টারে স্থান পেয়েছে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন স্লোগান

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমনা কালিমন্দির সংলগ্ন গেইট দিয়ে প্রবেশ করলেই ভেতরের উন্মুক্ত জায়গাটিকে ‘জুলাই চত্বর’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন বই মেলার তথ্য কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা আলামিন সরকার। তিনি জানান, জুলাই শহীদদের স্মরণেই এই চত্বরটি রাখা হবে। তবে সেটি রবিবার থেকে ঘোষণা করা হবে। এখন পর্যন্ত এই চত্বর দৃশ্যমান নয়।

বিকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘অমর একুশে বইমেলা-২০২৫’ এর উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসময় তিনি জুলাইয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে যে দুঃসাহসী ছাত্র-জনতা-শ্রমিকরা প্রাণ দিয়েছেন এবং নির্মমভাবে আহত হয়েছেন তাদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। এসময় তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় নিয়ে এসেছে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার ইস্পাত কঠোর প্রতিজ্ঞা। তাই মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত অভ্যুত্থান এবারের বইমেলায় নতুন তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে এসেছে।

প্রথম দিন বইমেলায় উপস্থিতি কম থাকলেও শুরু হয়েছে বেচাকেনা

বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ জুড়ে ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন ব্যানার ও পোস্টার। ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘যখন জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়, ইতিহাস নতুন পথ তৈরি করে’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তুমিই বাংলাদেশ’, ‘হামার বেটাক মারলু ক্যানে?’ স্লোগান সম্বলিত পোস্টার টানানো হয়েছে।

এবারের মেলায় বেশিরভাগ স্টল সাজানোর রং হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে লাল, কালো ও সাদা। দোকানিরা বলছেন, বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে লাল, শোকের প্রতীক হিসেবে কালো ও আশার প্রদীপ হিসেবে সাদা রং ব্যবহার করা হয়েছে।

বইমেলার বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে স্টল বরাদ্দ নিয়েছে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জুলাই আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ের ছবিসহ প্ল্যাকার্ড দিয়ে সাজানো হয়েছে তাদের স্টলের আশপাশ। স্টলের এক কর্মী জানান, জুলাই অভ্যুত্থানকে স্মরণ করিয়ে দিতেই স্টল ও সংলগ্ন এলাকা এভাবে সাজানো হয়েছে।

উদ্বোধনী দিনে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, পরিসর বাড়ানো হলেও অধিকাংশ স্টল এখনও সাজানো হয়নি। দোকানিরা বলছেন, তাদের সব বই এখনও আনা হয়নি। তবে দুয়েকদিনের মধ্যেই স্টলের বাকি কাজ সম্পন্ন হবে।

সময় প্রকাশনীর বিক্রেতা আরিফ জানান, তাদের অধিকাংশই বই আসেনি। এখনও স্টল সাজানোর কাজ চলছে। জুলাই অভ্যুত্থানের নিয়ে তাদের প্রকাশিত একাধিক বই থাকছে এবারের মেলায়। তবে এখনও সেগুলো স্টলে আসেনি। 

আদর্শ প্রকাশনীর এক বিক্রেতা বলেন, জুলাই নিয়ে আমাদের ‘সংবাদপত্রের স্মৃতিতে জুলাই’ নামে একটি বই আছে। তবে স্টলে এখনও আসেনি।

অধিকাংশ স্টল পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত না হলেও কিছু স্টলে বই বিক্রি শুরু হয়েছে। প্রথম দিনে বইমেলায় মানুষের উপস্থিতি ছিল কম। যারা এসেছেন তারা বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে বই দেখছেন। দর্শনার্থীরা বলছেন, মেলা এখনও সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে প্রথম দিকে এলে নতুন বইয়ের একটা সুবাস পাওয়া যায়। যা প্রকৃত বইপ্রেমীদের টেনে নিয়ে আসে।